আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ন্যায়বিচারের দাবিতে গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বরের ঘটনা, পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা রাজধানীতে সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে শেখ হাসিনাকে দ্রুত দেশে ফেরানোর দাবি জানিয়ে গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারের দাবী জানানো হয়।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে নিহতদের পরিবারের সদস্য, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগ রেজিমে বলপূর্বক গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এই সমাবেশের আয়োজন করে।
‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জুলুমের ভুক্তভোগী গণজমায়েত’ শীর্ষক এ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের হাতে বিভিন্ন ছবি ও প্ল্যাকার্ড ছিল। তারা ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচনায় পিলখানা হত্যাকাণ্ড, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেওয়া, বিভিন্ন সময় পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, জুলাই গণহত্যা, শাপলা চত্বর গণহত্যা, ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যা, আয়নাঘর, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, বাংলাদেশের সীমান্ত হত্যা, আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের বিচারসহ একাধিক বিষয় উঠে আসে। প্রায় সব বক্তাই গুমÑখুনের হোতা শেখ হাসিনা ও তার অলিগার্কদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান। পাশাপাশি সব দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মায়ের ডাকের প্রধান সমন্বয়ক সানজিদা খানম তুলি।
সমাবেশটি কার্যত রাজনীতিক, পেশাজীবী, মানবাধিকারকর্মী, ছাত্র সংগঠনের নেতা, গণমাধ্যম কর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সবার মুখে এক আওয়াজ ভারতকে রুখতে হবে। হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচার করতে হবে। ভারতের চোখ রাঙানি সহ্য করা হবে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, গত ১৫ বছরে অনেকেই কথা বলতে পারেনি। বিরোধী দলের নেতা, হেফাজত ইসলামীর নেতাদের হত্যা করা হয়েছিল। আমরা গুম কমিশনের পক্ষ থেকে যত কাজ করছি, ততই ভয়াবহ তথ্য পাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা এমন গোপন কারাগারের সন্ধান পেয়েছি, যেখানে কয়েদিরা দিনের হিসাব জানতেন না। তারা আদিম মানুষের মতো দেয়ালে আঁচড় দিয়ে দিন গুনেছেন। কেউ কেউ দেয়ালে লিখে রেখেছেন ‘আমি দেশকে ভালোবাসি, আমি পরিবারকে ভালোবাসি’। আমরা শীঘ্রই এসব তথ্য উপস্থাপন করব ।
জোনায়েদ সাকি বলেন, গুম পৃথিবীর সর্বনিকৃষ্ট অপরাধ। কারণ গুমের পর তার পরিবার আর তাকে পায় না। ন্যায়বিচার হবে নতুন বাংলাদেশের যাত্রার প্রধান ভিত্তি। আর কোনো ফ্যাসিবাদ যেন কায়েম না হয়। জনআকাক্সক্ষা যেন বেহাত না হয়। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। বাংলাদেশের সীমান্তে মানবাধিকারের চূড়ান্ত লংঘন হয়। স্বর্ণা দাশ, ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ও শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার ভিডিওবার্তায় বলেন, বিগত সরকারের আমলে ২২ লাখ মানুষের ওপর মিথ্যা মামলা হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার এলেও যারা গুম করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। সরকারের কাছে দাবি থাকবে, এই গুমে জড়িতদের যেন বিচারের আওতায় আনা হয়। একইসঙ্গে যেসব পরিবার দীর্ঘদিন যন্ত্রণা ভোগ করছে, তাদের যেন যথাযথ সহযোগিতা করা হয়। জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেল প্রফেসর মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, কত শত গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা।
হেফাজতের হত্যাকাণ্ড এবং ২০১৪ সালে সাজানো মামলায় ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের জুডিশিয়াল কিলিং করা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে খুন করা হয়েছে। এর বিচার না হলে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে একটি জাতীয় ঐক্য পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিদায় দিতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসরদের না সরিয়ে নির্বাচন দিলে তা নিরপেক্ষ হবে না।
শেখ হাসিনাকে ভারতের কর্মচারী আখ্যা দিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ভারতের প্রেসক্রিপশনে আলেম ওলামাদের হত্যা করা হয়েছে। তারা এখন খুনিদের আশ্রয় দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভারত অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ইতিহাসের কোনও দেশে নাই রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পেশাজীবী, নায়ক ফ্যাসিস্টদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে কারা খুনিদের ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় দিয়েছে। কারা পুলিশ ভাইদের, বিজিবিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গুলির নির্দেশ দিয়েছে। সেই সাংবাদিকদের কলম ভেঙে দিতে হবে যারা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পক্ষে লিখে গেছে। শহীদের রক্ত শুকানোর আগে অনেক মুরুব্বি আওয়ামী লীগকে ক্ষমার কথা বলছেন, নির্বাচনে আনার কথা বলছেন। আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতের আগে তাদের পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে সেটি শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে।
গণজমায়েতে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেছেন, আওয়ামী সরকারের আমলে পুলিশ দিয়ে জনগণের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে, নির্বিচারে গুম-খুন চালানো হয়েছে। পুলিশকে টিস্যুর মতো ব্যবহার করেছে আওয়ামী সরকার। তবে দল-মত নির্বিশেষে সবাই যখন ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছে, তখনই হাসিনা পালাতে বাধ্য হয়েছে। এখনও জুলাই আন্দোলন ঘিরে মামলা-বাণিজ্য হচ্ছে। তবে আমরা সেসব সফল হতে দেবো না।
তিনি আরো বলেন, জনগণের সঙ্গে না থাকলে হাসিনার মতো অবস্থা হবে। এখন আগের মতো আর অসমতার সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে নয়। কোনও ধর্ম বা জাতির নামে কেউ উগ্রবাদী কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা আমরা সফল হতে দেবো না। সবাই মিলে রুখে দেবো। আমরা কাউকে আবার ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে সুযোগ দেবো না।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী বলেন, বিগত ১৫/১৬ বছর নয় ৭১ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির গণভিত্তি ছিল না। তারা ভারতের সহায়তায় ক্ষমতা এসেছে। তাদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি, জাতীয় ঐক্য নস্যাতের চেষ্টা চলছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত খোকন চন্দ্র বর্মন বলেন, কেবল আমার মুখকে এমন করেছে তা নয়। আমার সামনে একজনের মুখের এক পাশে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাকে বলতে হবেই। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে হাসিনা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমি হাসিনার কঠিন শাস্তি চাই। তার ফাঁসি চাই।
জুলাইয়ে আন্দোলনের সময়ে পুলিশের গুলিতে আহত আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি সাধারণ একটি মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ করেই পুলিশ গুলি করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পায়ে বুলেট লাগে। আমার কোনও অপরাধ ছিল না। তারপরও কেন আমাকে গুলি করা হলো? এখনও এই পা নিয়ে আমি কষ্ট করছি। আমি এই ঘটনার বিচার চাই।
মায়ের ডাক সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে জুলুমের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এখানে জড়ো হয়েছেন। এখান থেকে আমরা পিলখানা হত্যাকাণ্ড, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, জুলাই গণহত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা, ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি জানাচ্ছি।
জামায়াতের ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের কাঁধে ভর করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসে। আমাদের ১২ জন নিরীহ ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়েছে খুনি হাসিনা সরকার। আয়নাঘরে বন্দী রেখেছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আমানউল্লাহ আমান আজমীকে। আমরা আর কোনো ফ্যাসিবাদের চেহারা দেখতে চাই না। আমরা ১৮ কোটি জনগণের মুখে হাসি দেখতে চাই।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিচারের দাবি জানিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র শামান্তা শারমিন বলেন, বিগত বছরগুলোতে গুম-খুনের সাথে জড়িত পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ সরকারকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে নিম্নস্তর পর্যন্ত যারা মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
আখতার হোসেন বলেন, ফ্যাসিবাদের সময়ে বাংলাদেশের মানুষ দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত, তাদের তো বিচার হয়নি। বরং বিচারের নামে প্রহসন করে বিডিআরের ভাইদের জেলখানায় বন্দি রাখা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ভিডিওবার্তা দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা হুমা খান, গুম কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ, সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল প্রফেসর মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এ বি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও গুম-খুনের শিকার কয়েকজনের স্বজন।
অনুষ্ঠানে গুম-খুনের শিকার কয়েকজনের স্বজন বক্তব্য রাখেন। এছাড়া আন্দোলনে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বাবা-মায়ের প্রতি শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের লেখা চিঠি পড়ে শোনান তার বাবা পলাশ।
আপনার মতামত লিখুন :