চলমান ধারাবাহিক বৈঠক, প্রকৃত ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বিএনপির 


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ৯:১৬ পূর্বাহ্ণ /
চলমান ধারাবাহিক বৈঠক, প্রকৃত ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বিএনপির 
  • শরিয়াহবিরোধী সিদ্ধান্ত না নেয়া, ইসলামবিরোধী কোনো কথা না বলা, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে ঐকমত্য

দেশের সাধারণ মানুষের মনে লালিত ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী মনোভাব, ইসলামী মূল্যবোধ ধারণ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিএনপি। প্রকাশ্য সমাবেশে জিয়াউর রহমান ঘোষণা করতেন, তিনি বুকে কুরআন ধারণ করেন এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর পক্ষে আছেন। তার ১৯ দফার পাশাপাশি এই আদর্শ দাগ কেটেছিল মানুষের মনে, পরিণত হয়েছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে। যেটি পরবর্তীতে বহন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

এর ফলে দেশের ইসলামপ্রিয় সাধারণ মানুষের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছেন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া। তাই বিএনপির দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলায় সবসময় সঙ্গী ছিল ইসলামপন্থী রাজনৈতিক বিভিন্ন দল, সমর্থন দিয়েছিল দেশের শত শত পীর-মাশায়েখ, দরবার-খানকা। বেগম জিয়া বলেছিলেন, ‘ডান কিংবা বামপন্থী আমরা নই। আমাদের ডানে যাদের অবস্থান তারা ডানপন্থী, আমাদের বামে যাদের অবস্থান তারা বামপন্থী। আমাদের অবস্থান ডানপন্থীর বামে এবং বামপন্থীর ডানে। আমাদের অবস্থান কেন্দ্রে এবং এদেশের রাজনীতির কেন্দ্র আমরাই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলই এ দেশের মূলধারা।’ বিগত কয়েক বছর বিএনপির সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে বিএনপির। বেশ কয়েকটি দল বিএনপির জোট ছেড়েও চলে যায়। দলের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার পরামর্শে দলটি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

যদিও বরাবরই তা ব্যর্থ হয়েছে; বরং এটি করতে গিয়ে বিএনপি তাদের প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শকেই ম্লান করেছে, দাঁড়িয়েছে আপামর জনতার মতামতের বিরুদ্ধে। তবে আবারো বিএনপি তার রাজনীতির মূলে ফিরছে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুসারী বেশ কয়েকজন নেতা কথা বলছেন ভারতের চোখে চোখ রেখে। আর জামায়াত ছাড়া অন্য ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে যোগাযোগ, এসব দলকে কাছে টানার চেষ্টা করছে দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলমান এবং ইসলামপ্রিয়। ফজরের নামাজ ও কুরআন পড়ে দিন শুরু করে মানুষ। শিশুরা ছুটে মক্তবে, শুক্রবারের জুমার নামাজ কিংবা ওয়াজ মাহফিলে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়।

এই দেশে ছড়িয়ে আছে শত শত পীর-আউলিয়া, দরবার, খানকা শরিফ। দেশের অধিকাংশ মানুষের আদর্শিক চিন্তা-চেতনা, মন-মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন এসব পীর-আউলিয়া, দরবার, খানকা ও মসজিদ-মাহফিলগুলো। ভোটের মাঠের জনপ্রিয়তা গড়ে তুলতে প্রভাব থাকে তাদেরই। নির্বাচনের প্রচারণাও শুরু হয় মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে। তাই ইসলামপ্রিয় এসব মানুষ ও ইসলামী দলগুলোকে অবজ্ঞা করা দূরদর্শী রাজনৈতিক দলের কাজ হবে না। এটিই বুঝতে পেরেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তাই যেকোনো নির্বাচন কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইসলামী দলগুলোতে সাথে নিয়েই এগিয়েছেন তারা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি বিগত কয়েক বছর ইসলামী দলগুলোকে দূরে রেখে চলার চেষ্টা করেছে। অবশেষে আবার সেসব দলগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্যে গতকাল সোমবার ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের আমীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম চরমোনাই পীর সাহেবের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই বৈঠকে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ে জাতীয় নির্বাচনে পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহবিরোধী সিদ্ধান্ত না নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে ইসলামী আন্দোলন ও বিএনপি। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশের আমীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম সাহেবের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। এই আলোচনায় আমরা মোটামুটি ১০টি বিষয়ে একমত হয়েছি।

১০ দফার যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- আধিপত্যবাদ, স¤প্রসারণবাদ ও সামাজ্যবাদমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম টেকসই রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, খুনি ও টাকা পাচারকারীদের দ্রæত বিচার, ভোটাধিকারসহ সব মানবাধিকার রক্ষায় জাতীয় ঐকমত্য গড়া, ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ, দ্র্রব্যমূল্যের ঊধর্বগতি রোধে ও সব অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিককরণ, আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আঘাত করে কথা না বলা, আগামীতে আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী শক্তি যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেই ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং প্রশাসন বিদ্যমান ফ্যাসিবাদের দোসরদের দ্রæত অপসারণ করা। ইসলামী শরিয়াহবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া এবং ইসলামবিরোধী কোনো কথা কেউ বলবে না, এ ব্যাপারে দু’দলই ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।

ইসলামী আন্দোলনের আমীর ও চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, দেশ, মানবতা ও রাজনীতির ব্যাপারে আমাদের সাথে তাদের কথাগুলো হয়েছে এগুলো বিএনপি মহাসচিব আপনাদের (গণমাধ্যমে) উপস্থাপন করেছেন। এগুলো আমাদেরও একই কথা।

দ্রæততম সময়ের নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে আমীর বলেন, এটি আমরা আগের থেকেই বলেছি যে, দ্রুত সময়ে আমরা যে শব্দটা ব্যবহার করেছি যে, খুব বেশি সময় না নিয়ে যৌক্তিক, সেই যৌক্তিক সময়টা আমরা বলেছি, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে, এরকম একটি কথা আমরা বলেছি। আর ছয় মাস তো প্রায় চলেই গেল, আর এক বছরের মধ্যেই সুন্দর একটি জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেÑ এটিই মূলত আমাদের কথা। চরমোনাই পীর বলেন, আমাদের দু’দলের মধ্যে আলোচনা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।

এর আগে রেলা ১২টায় পুরানা পল্টনে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু। এই বৈঠকে ইসলামী আন্দোলনের আমীরের সাথে ছিলেন, মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুস আহমাদ, সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম।

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে দলটি। পর্যায়ক্রমে আরো দলের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা। বিএনপি ও খেলাফত মজলিসের বৈঠকে দুই দলই দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ সাতটি বিষয়ে একমত হয়। সেগুলো হলো- দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে উদ্যোগ নেয়া; ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত ও ধর্মীয় সম্প্রীতির রক্ষায় সবার ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখা; পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য জাতীয় ঐক্য অটুট রাখা; খুন, গুম, হত্যা, নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করা; বিগত আওয়ামী সরকারের সময় আলেম-ওলামা ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা।

এক সময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দল। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিসের দুটি অংশ উল্লেখযোগ্য। শেষ পর্যন্ত এই সব কটি দল ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে বিএনপির জোট ছেড়ে যায়। যদিও যে কয়টি ইসলামী দল ২০-দলীয় জোটে ছিল, সেগুলো মূলত জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া দলগুলোর খণ্ডিত অংশ। যাদের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে প্রথম বিএনপি জোট ছেড়ে যায় মরহুম মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট।

শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও বহু আগে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনার পর জোট ছাড়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস। এখন এই দলগুলোর কোনো কোনোটির সঙ্গে বিএনপি যোগাযোগ শুরু করেছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গেও বিএনপির যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, বিএনপির সঙ্গে একটা বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কথা বলার পর যদি চিন্তাচেতনার ঐক্য তৈরি হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে আমরা আপনাদের জানাব।