ছাত্র-জনতা হত্যায় একের পর মামলা, প্রভাবশালী আসামিরা লাপাত্তা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ৩১, ২০২৪, ৭:৩৩ পূর্বাহ্ণ /
ছাত্র-জনতা হত্যায় একের পর মামলা, প্রভাবশালী আসামিরা লাপাত্তা

ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দলটির বিভিন্ন সারির নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান নতুবা দেশ ছেড়ে পালান। সাবেক মন্ত্রী, এমপি, নেতা ও অনৈতিক সুবিধাভোগীদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হচ্ছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম ক্রীড়নক ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ সাবেক তিন আইজিপি, বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমারসহ হাই প্রোফাইল ব্যক্তিরা এখন কোথায়- এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষের মনে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে হত্যার জেরে হওয়া একের পর এক মামলায় আসামি এসব নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অবস্থান নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে। তারা কোথায় আত্মগোপন করেছেন? দেশে আছেন নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের পরিবারসহ দেশের অধিকাংশ মানুষ। হাইপ্রোফাইল এসব ব্যক্তির বর্তমান অবস্থানের বিষয়ে কোথাও কোনো তথ্য মিলছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপরই প্রাণ রক্ষার্থে ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাসে আশ্রয় নেন রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের কর্মকর্তাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি। সেদিন দুপুরে ঢাকার মিন্টো রোডের মন্ত্রী পাড়ার সরকারি বাসভবন থেকেও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী আত্মগোপনে চলে যান।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঘটনার দিন দুপুর থেকেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ডিএমপিসহ ঢাকায় কর্মরত পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বঙ্গবাজার এলাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে আশ্রয় নেন। ছাত্র-জনতা ঘেরাও করে পুলিশ সদর দপ্তরও। সন্ধ্যার পর দুটি হেলিকপ্টার এসে নামে পুলিশ সদর দপ্তরের ছাদে। পুলিশের তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা ও সরকারের সুবিধাভোগীদের অবস্থান ও অন্তর্ধানের বিষয়ে বিভিন্ন গুঞ্জন শুরু হলে গত ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের পর প্রাণ রক্ষার্থে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিচারক, পুলিশ সদস্যসহ ৬২৬ জন সেনানিবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৬১৫ জন স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছেড়েছেন। বর্তমানে ৭ জন সেনানিবাসে রয়েছেন। আশ্রয় দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত চারজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

আইএসপিআরের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের স্ব-উদ্যোগে সেনানিবাস ছাড়ার কথা বলা হয়েছে। তবে তারা এখন কোথায় অবস্থান করছেন- এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সংস্থা জানাতে পারেনি। মামলার আসামি সাবেক সরকারের প্রভাবশালী নেতা, সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ৫ আগস্টের পর আর জনসম্মুখেও দেখা যায়নি। তাদের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরও বন্ধ।

৫ আগস্টের পর চাকরিচ্যুত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর দুই কর্মকর্তা। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দেশত্যাগের চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য। গত ৬ আগস্ট সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে বিমানবন্দর থেকে আটক করা হয়। একই দিনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটকে দেওয়া হয় বলে একাধিক সূত্র জানায়।

প্রায় এক সপ্তাহ পর ১৪ আগস্ট জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু ও ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকতকে খিলক্ষেত থানার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত হাছান মাহমুদ সম্পর্কে কিছু জানায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের অবস্থান নিয়েও নানা কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ও মামলার আসামি সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অভিযান অব্যাহত রেখেছে। এখনো দেশের বেশিরভাগ থানা পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট পুরোদমে কাজে ফেরেনি। পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বিগত সরকারের সুবিধাভোগীদের সরিয়ে দেওয়া হলেও বেশির ভাগ পদে এখনো পদায়ন হয়নি। এসব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই পুলিশ মামলার আসামি ও অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে বলে জানা গেছে।

আটক ও আত্মগোপন নিয়ে নানা গুঞ্জন : পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ অবস্থান করছে সন্দেহে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর উত্তরা সেক্টর ১০-এর ১২ নম্বর রোডের একটি বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়রা। তবে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা ভবনে তল্লাশি চালিয়ে হারুনকে পাননি। এর আগে গত ৬ আগস্টও হারুন অর রশীদের আটক হওয়ার গুঞ্জন ওঠে। সেদিন তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তিনি আটক হননি। বাসাতেই আছেন। তবে এর পর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরও বন্ধ।

এদিকে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অবস্থান নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কী গোয়েন্দা জালে নাকি আত্মগোপনে রয়েছেন, সে বিষয়ে মুখ খুলছে না কেউই। তার সিঙ্গাপুর ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন শোনা গেলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওবায়দুল কাদের ভারতে কিংবা সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি গোয়েন্দা জালে রয়েছেন।

নিয়মিত বিরতিতে গ্রেপ্তার : আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও এমপিদের কেউ কেউ নিয়মিত বিরতিতে গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন।

ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে চাকরিচ্যুতির পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালতে তিনি বলেন, তাকে ‘আয়না ঘরে’ আটকে রাখা হয়েছিল। চাকরি থেকে অব্যহতি দেওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তিনি র?্যাবে কর্মরত ছিলেন। সবশেষ গত বুধবার রাতে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে গ্রেপ্তার করেছে র??্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র?্যাব)।

র?্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনিম ফেরদৌস বলেছেন, টিপু মুনশিকে ঢাকার গুলশান এক নম্বর থেকে গ্রেপ্তারের পর গুলশান থানায় সোপর্দ করা হয়। গত জুলাই মাসে রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত শ্রমিক মুসলিম উদ্দিন মিলন হত্যা মামলার আসামি তিনি।

আসামি গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান : ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। অস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সেগুলো থানায় জমা দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার হত্যা মামলার আসামি, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ধরতে শিগগিরই যৌথ অভিযান শুরু হচ্ছে।

জেলায় নতুন করে এসপি ও থানায় ওসিদের পদায়নের পাশাপাশি থানা কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলেই যৌথ অভিযান শুরু হবে। পুলিশ বলছে, আগামী ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অস্ত্র জমা না দিলে অবৈধ বলে গণ্য হবে। থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের পাশাপাশি দাগি অপরাধী ও ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের যৌথ অভিযান চালানো হবে।

গ্রেপ্তার হয়নি কোনো পুলিশ কর্মকর্তা : সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোট ৯১টি হত্যামামলা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হত্যা ও লুটপাটের অভিযোগে মামলার আসামি হয়েছেন অর্ধশতাধিক বর্তমান ও সাবেক প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা। বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, একেএম শহীদুল হক, বেনজীর আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, খোন্দকার ফারুক হোসেন, অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, মীর রেজাউল আলম, হাফিজ আক্তার ও আসাদুজ্জামান, যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নুরুন্নবী, সঞ্জিত কুমার রায়, বিপ্লব কুমার সরকার ও মেহেদী হাসানসহ অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। তবে গতকাল পর্যন্ত পুলিশের কোনো কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হননি। তারা দেশেই আছেন, নাকি বিদেশে পালিয়ে গেছেন- সে বিষয়েও তথ্য মিলছে না।