বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানী ঢাকার একটি স্কুলে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। তারপর কোমলমতি শিশুদের মৃত্যু আর আহতদের দগ্ধ শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। প্রিয়তম সন্তান হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি। দেশ শোকে মুহ্যমান।
আজ এই শোকের মধ্যেই জনবহুল এলাকায় বিমানের পাইলট প্রশিক্ষণ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ বন্ধের দাবি উঠেছে। সেই সঙ্গে ঢাকার মতো জনবহুল এলাকা থেকে বিমানবন্দর অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শতকোটি টাকা খরচ করার পরও ঢাকার বাইরে বিমানবন্দর সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ এখনও হিমঘরে।
পাইলট প্রশিক্ষণ কোথায় হবে, সে প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রটোকলগুলোতে বলা হয়েছে- ‘জনবহুল বা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিচালিত কার্যক্রমে ব্যক্তি আহত হওয়ার সম্ভাবনা এবং নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁঁকি বেড়ে যায়।’ এই কারণে ঝুঁকি-বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে পাইলটদের প্রশিক্ষণের জন্য গ্রামীণ বা কম জনবসতিপূর্ণ এলাকা, নদী ও চর এলাকা সুপারিশ করা হয়। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) পরিশিষ্ট ১৪ অনুযায়ী, গ্রামীণ ও জনবিরল এলাকাকে প্রশিক্ষণের জন্য সর্বোত্তম এলাকা হিসেবে বলা হয়েছে।
ঢাকার মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন হতাহতের স্বজন ও সহপাঠীরা। তারা বলেছেন, পৃথিবীর কোথায়ও এত ঘনবতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ পরিচালনা এবং বিমানবন্দর নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘ দূরত্বে বিমানবন্দরসহ এই ধরনের কার্যক্রম থাকে। এখন জনবসতি কম এলাকায় এই প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
এটা সিলেট-কক্সবাজারসহ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায় হতে পারে। বিমানের সব ধরনের প্রশিক্ষণ এবং বিমানবন্দরগুলো ঢাকার বাইরে সরিয়ে নিতে হবে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বিজয় আমাদের সময়কে বলেন, জনবহুল এলাকায় কেন বিমান প্রশিক্ষণ নেবে। যার কারণে নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের প্রাণ দিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের বিমানবন্দরগুলো হয়েছিল ৬০-৭০ বছর আগে। বিমানবন্দর যে সময় তৈরি হয়, তখন এলাকাগুলো অনেকটাই জনবিরল ছিল। কিন্তু জনবসতি ধীরে ধীরে বেড়ে গেছে। এখন ঝুঁকি বিবেচনা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ঢাকার বাইরে বিমানবন্দর নির্মাণ করা খুবই প্রয়োজন। ঢাকা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, দুর্ঘটনার কারণে বিমান ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিধ্বস্ত হলে হতাহতের সংখ্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে, যার প্রমাণ উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে প্রশিক্ষণের বিমান বিধ্বস্ত হওয়া। নানা মহল থেকে এসব প্রশিক্ষণ ঢাকার বাইরে করার দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের উচিত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে উদ্যোগ নেওয়া।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, ঘনবসতিতে নিচু এলাকা দিয়ে বিমান উড়ানো যায় না। এটা তো বিমান অবতরণের সময় দুর্ঘটনায় পড়েছে। ঢাকার বাইরেও বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ হয়। কিন্তু এটার ফাইটার স্কোয়াডন ঢাকায়।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ লেফটেন্যান্ট (অব.) সাইফুল্লাহ খান সাইফ বলেন, ২০২৪ সালের ৯ মে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদ প্রশিক্ষণ মিশনের সময় একটি যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ বিমানে প্রাণ হারান। শেষ মুহূর্তে তিনি নিজেকে না বাঁচিয়ে জনবহুল এলাকা থেকে বিমানের গতি ঘুরিয়ে দেন। বেঁচে যায় বহু প্রাণ। আবার একই দৃশ্য। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরও প্রাণ হারালেন অন্য একটি যান্ত্রিকভাবে ব্যর্থ বিমানে।
হতাহতের সংখ্যা এড়াতে পাইলট বিমানটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। সংস্থাটি জানায়, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে উক্ত বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল এবং কলেজের দোতালা একটি ভবনে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঢাকা থেকে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের সীমান্তঘেঁষে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সমীক্ষাও করা হয়েছে। এক লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বিমানবন্দরের ড্রয়িং-ডিজাইন ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকা। তবে একযুগ পরও বিমানবন্দর তৈরির পরিকল্পনা এখনও হিমঘরে।
আপনার মতামত লিখুন :