মুহা. আবুল কালাম আজাদ।।
“কৃষি জমিতে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তা সর্বনাশ” অবিলম্বে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা চুড়ান্ত করা হোক। এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে ধারণ করে ২০২৫ সালে ‘জাতীয় তামাক মুক্ত দিবস’ পালন করেছে বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট ও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নকারী সংগঠন গুলো। সরকারি ভাবে এমন গুরুত্বপূর্ন দিবস পালন করা হয় না।
তবে সরকার ৩১ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস পালন করলেও ৯ অক্টোবর জাতীয় ভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেই! বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট ও সংগঠন গুলো ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর দেশে ৯ অক্টোবর জাতীয় তামাক মুক্ত দিবস পালন করে আসছে। সারাদেশে আগ্রাসী ভাবে তামাক চাষ বৃদ্ধি পাওয়াতে খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। নষ্ট হচ্ছে ভুমির উর্বরতা। যা কৃষি জমি এবং খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাক চাষ অবিলম্বে বন্ধ করা উচিৎ। যে পণ্য ক্ষতিকর সেই পণ্য চাষ দেশে কেন হবে? রাষ্ট্রের জনস্বার্থ বিবেচনায় তামাক চাষ করার অনুমতি দেয়া উচিৎ নয় বলে মনে করি। জনস্বাস্থ্য পরিবেশ সুরক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের ইতিবাচক নীতিগত পদক্ষেপ সমূহ প্রশংসিত হলেও কোম্পানি গুলোর কৌশলের কারণে কৃষকরা তামাক চাষের চক্র থেকে বের হতে পারছেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাক চাষে স্বাভাবিক ফসলের তুলনায় ৮/১০ গুণ বেশি রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা মাটি ও পরিবেশকে দূষিত এবং জমির উর্বরতা নষ্ঠ করছে। ফলে রবি মৌসুমে খাদ্য ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকরা আটকা পড়ছে ঋণের ফাঁদে। অপর দিকে, কীটপতঙ্গ, গবাদি পশু ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর তামাক চাষের নেতিবাচক প্রভাব দেশের কৃষি জমি, মৎস্য প্রাণী সম্পদ, খাদ্যনিরাপত্তা এবং পরিবেশ কে হুমকীর সম্মুখীন করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রমাগত তামাকচাষ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ কোম্পানি গুলোর আগ্রাসী বিপনন কৌশল, বিদ্যামান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন বিধান না থাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যথাযথ উদ্যোগের অভাব, দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা, তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতি চুড়ান্ত করণে বিলম্ব এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নীতির অসামঞ্জস্যতা। উল্লেখ্য তামাক রপ্তানীতে শুল্ক ছাড়ের কারণে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশে প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। উক্ত সংকট থেকে উত্তরণে দ্রæত তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা (খসড়া) চুড়ান্ত করা জরুরী। সংবিধান ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষ ধীরে ধীরে বন্ধ করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এজন্য তামাক বিরোধী জোটের প্রস্তাবনা হলো, (১) সরকার কর্তৃক প্রণীত তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা (খসড়া) অবিলম্বে চুড়ান্ত ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের কারিগরি সহায়তা, উন্নত বীজ, সার ও স্বল্পসুদে ঋণ প্রদান নিশ্চিত করা। (২) বিকল্প ফসল চাষে কৃষকদের কারিগরি সহায়তা, (৩) তামাক চাষের জমিতে দ্বিগুণ হারে ভুমি কর আরোপ করা। (৪) সংরক্ষিত বনভুমি ও সরকারি খাস জমিতে তামাক চাষ বন্ধে প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। (৫) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা ও (৬) তামাক পাতার উপর মওকুফকৃত ২৫% রপ্তানি শুল্ক পুনর্বহাল করা
অর্থনীতিতে তামাক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে, এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা মাত্র। তামাক পন্যের ওপর তামাক ব্যবহারকারী ব্যয় প্রকান্তরে সরকারের রাজস্ব আয়, তামাক শিল্পের মুনাফা, তামাক চাষী ও কারখানা শ্রমিকের আয়ের উৎস। জাতীয় আয় গণনায় এ ব্যয় অন্তর্ভুক্ত হলেও আদতে এটি তামাক ব্যবহারকারী পরিবারে মূল্যবান সম্পদের অপচয়, যা অন্যান্য উত্তম বিকল্প তথা স্বাস্থ্যকর দ্রব্য ও সেবা ক্রয়ে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল। সার্বিক ভাবে এ পরিবার সমূহ একদিকে তামাক পণ্য ক্রয়ে অর্থ ব্যয় এবং অকাল মৃত্যু ও অক্ষমতা জনিত আয় হারানোর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়।
তামাক শিল্প বরাবরই দাবী করে আসছে যে তামাক উৎপাদন ও বিক্রয় প্রক্রিয়া রাজস্ব আয় ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখে। বাস্তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব মতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এখাত হতে আহরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা, এ সময়ে তামাক জনিত বিপুল স্বাস্থ্য ব্যয় ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। যার গুরুত্বকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।
গবেষনায় তামাক চাষের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, তামাক চাষে দুলর্ভ কৃষি জমি ব্যবহারের ফলে খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি অগ্নিকান্ডের আশংকা ও ক্ষতি, যত্রতত্র সিগারেটের পরিত্যাক্ত অংশ নিক্ষেপজনিত পরিবেশ দূষণ এবং অন্যান্য ক্ষতি পরিমাপ করা হয়নি। যা ভবিষ্যৎ গবেষনার আওতায় আসতে পারে। তবে এটি সত্যি যে, তামাক ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি ও পরিবার সমূহের প্রকৃত ভোগান্তি পরিমাপ করা কখনই সম্ভব নয়। তামাকজাতদ্রব্য ব্যবহার আর্থ সামাজিক অবস্থা, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ও যে বিরূপ প্রভাব ফেলে তার প্রতিকার করা অত্যন্ত জরুরী।
২০৪০ সালের মধ্যে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন প্রয়োজনকেই প্রতিফলিত করে। তবে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সে অর্জনের পথ দুরূহ কেবল দ্রæত ও কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।
বাংলাদেশে তামাক জনিত রোগে বছরে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনস্বাস্থ্য অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্র, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তামাকজাত দ্রব্য জনস্বাস্থ্যের সকল দিক দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করে মানুষের মৃত্যু ঘটায় রোগে শোকে ভোগায় তবুও কেন এই পণ্য বাংলাদেশের মাটিতে চাষ করার অনুমতি মিলছে? ২০২৫ এ জাতীয় তামাক মুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টি আমলে নিয়ে অবিলম্বে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা চুড়ান্ত করা সময়ের দাবী। দেশের স্বার্থে মানুষের কল্যাণে তামাক চাষ বন্ধ করা হোক।
লেখক উন্নয়নকর্মী।