সালাহউদ্দিন বাবর
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে জাতীয় ঐক্য, বিভিন্ন সংস্কারের প্রয়োজন, প্রতিশ্রুতি ও শুদ্ধ নির্বাচন, জাতির এ তিন আকাক্সক্ষার কোনটি এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেতে পারে- এমন প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ, প্রাজ্ঞজনের অভিমত এ সময়ে কোনোটিই উপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা সময়ের প্রেক্ষাপটে বহুমুখী হয়েছিল। চূড়ান্তে সেটা বহুমুখী থেকে রাজনীতিমুখী হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সেটি হয়ে উঠেছিল আগস্ট বিপ্লবের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য। সে বিপ্লবের সাথে মিলেমিশে ছিল সব শ্রেণী-পেশার মানুষের হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন। মানুষের মন-মস্তিষ্কের স্পন্দনকে শূন্যতে পেয়ে তরুণ বিপ্লবীরা তাদের আন্দোলনের গতিবেগ আরো বেগবান করেছিল। তার প্রতিফল ছিল স্বৈরতন্ত্রের পতন।
স্মরণ রাখতে হবে, বিপ্লবের অংশীজনরা ছিল আপসহীন। তাদের কারো কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল না। জনগণও ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে দেশের সর্বত্র রাজপথে নেমে এসেছিলেন। ঘরে ছিলেন না কোনো নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা। যদিও তখন বিপ্লবীদের সাথে একান্ত হতে রাজপথে ছিল মৃত্যুছোবলের শঙ্কা। বিপ্লবীদের কথা ছিল- হায়েনা সরলে তারাও ঘরে ফিরে যাবেন। দেশ হায়েনামুক্ত হলেও, হায়েনার অপছায়া এখনো অপসারিত হয়নি। যে বিবেচনায় ছাত্র-জনতার ঘরে ফেরা হয়নি। স্বৈরতন্ত্র ও তার মদদদাতা সম্প্রসারণবাদীদের অপছায়া দেশের চারপাশে এখনো বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। পতিত স্বৈরাচার সাঙ্গপাঙ্গসহ হটে গেছে বটে। কিন্তু দেশকে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো অথবা কঙ্কালসার প্রাণীর মতো ফেলে গেছে। আওয়ামী লীগ নেত্রীর অনির্বাচিত সরকার ২৮ লাখ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করেছে।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা তার স্নেহভাজন ও অনুগতদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থ আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিলিবণ্টন করেছেন বেসুমার। সেই সাথে রাষ্ট্রের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে গেছেন। অথচ রাষ্ট্রীয় এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর ভর করে একটি দেশ টিকে থাকে। এ ধ্বংসযজ্ঞের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ লক্ষ্য পতিত নেত্রীর সাম্প্রতিকালের কোনো চিন্তা নয়। ফেরারি জীবনের ইতি টেনে দেশে পা দিয়ে অনেকটা উন্মত্তের মতো ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি পিতৃ হত্যার প্রতিশোধ নিতে রাজনীতিতে এসেছেন। প্রতিশোধ নিতে দেশের সব মানুষকে নিঃস্ব করলেন।
অথচ তার পিতৃ হত্যার কুশীলব যারা ছিলেন তারা গোকুলে তার পিতার আশপাশে থেকে বেড়ে উঠেছিলেন। যারা কম্বল চোর, রাষ্ট্রীয় অর্থ অর্থাৎ জনগণের সম্পদ লুটপাটকারী, তারা চোরতন্ত্রের অবিশ্বাস্য এক রাজতন্ত্র কায়েম করেছিল। সাধারণ নাগরিককে নিপীড়ন নিষ্পেষণ তথা তাদের মুখের গ্রাস চুরির কারণে দেশের লাখ লাখ অভুক্ত মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। তাদের অতৃপ্ত আত্মার করুণ আর্তি পতিত নেত্রীর পিতার মৃত্যুর অন্যতম কারণ। যারা পতিত নেত্রীর পিতৃহত্যার পটভূমি রচনা করেছিলেন, জনগণকে ভোটবঞ্চিত করে ক্ষমতায় গিয়ে হন্তারকদের কোলে তুলে নিয়ে উপহার দিলেন মন্ত্রিত্বের। কী বিচিত্র এই নেত্রী ও দলতন্ত্র। পালানোর পরও নেত্রীর অপছায়া দেশে এখনো অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
এ রচনার সূচনায় যে তিন বিষয় সম্মুখে আনা হয়েছে, তার পুনরুক্তি করছি। জাতীয় ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন। এর কোনটিকে এখন গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়ার আগে জানতে হবে জাতির মনোযোগ এখন কোথায়। জাতির মতামত সব সময় প্রতিফলিত হয়, রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে আর বোদ্ধাজনের অভিমতে। সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং বোদ্ধাজন এখন এক সুরে এক লয়ে উচ্চারণ করছেন জাতীয় ঐক্যের মজবুতির কথা। জাতীয় নেতারা বক্তৃতা-বিবৃতিতে, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভে এমন ঐক্যের কথা বলছেন। নিয়ত বলা হচ্ছে সেই ঐক্যের কথা। বোদ্ধা সমাজ তাদের লেখনীতে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন জাতীয় সংহতির কথা। সে জন্য এখন ঐক্যের অপূর্ব এক সোপান তৈরি হয়েছে দেশে। এ ঐক্য যেন ক্ষণিকের বিষয় না হয়ে থাকে। হতে হবে সুদূরপ্রসারী।
তাছাড়া এ ঐক্যকে প্রসারিত করে সবার আচার-আচরণে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমন কিছু করতে বলতে সতর্ক থাকতে হবে; যেন তার একটি বাক্য বা আচরণ কোনোভাবে অসংযত না হয়, যা ঐক্যে চিড় ধরাতে পারে। কোনো জাতির ঐক্যে কি অপরিসীম প্রয়োজন সেটি কবি দার্শনিক আল্লামা ইকবালের বিখ্যাত এক কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। ইকবালের ঐক্য সংশ্লিষ্ট ধারণা- কোনো জাতি যদি তার মৌলিক ইস্যুতে ঐক্যের মেলবন্ধন ছিন্ন করে; সে অনৈক্য জাতিকে দুর্যোগ-দুর্ভোগের শেষ সীমানায় নিয়ে যায়। সমুদ্রের তরঙ্গ যেমন একের পর এক আসতে থাকে। আজকে জাতির এ অপূর্ব ঐক্য টুটে গেলে একের পর এক সুনামির সৃষ্টি হবে। বহু জীবনের মূল্যে কেনা ঐক্যকে দৃশ্যমান রাখতে হবে, অদৃশ্য হতে দেয়া যাবে না। এ জন্য এখন সব ভেদাভেদ ভুলতে হবে। দেবে আর নেবে মিলায়ে মিলিবে এমন ইতিবাচক মনোভাব, এ দেশের সাহসী মানুষকে আরো শক্তি জোগাবে। একই সাথে যারা দেশের মানুষকে সারাক্ষণ এক নিরাপত্তার বলয়ে রেখে সুরক্ষা দিচ্ছেন, তারা তাতে উদ্দীপ্ত হবেন।
সম্প্রতি সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের সাথে রাজনৈতিক অংশীজনদের সাথে যেসব বৈঠক হয়েছে, তারা দলমত নির্বিশেষে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- সব কাজে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। এ প্রতিশ্রুতির মূল্য অপরিসীম। এ মুহূর্তে এটি অপরিহার্য। তাদেরও অভিন্ন কামনা, ঐক্যের আলোচনা এখানেই যেন শেষ না নয়। এর আরো বিস্তার ঘটাতে হবে। জাতীয় ঐক্য স্থায়ী এবং মজবুত করতে যে বক্তব্য জাতির বিজ্ঞজনদের কাছ থেকে পেয়েছি সেটি মূল্যায়নের পাশাপাশি আমাদের বুঝতে হবে; বাকি দুই প্রয়োজন পূরণে ঐক্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
পতিত সরকার স্বেচ্ছায় এবং তাদের পরদেশী বন্ধুদের কুপরামর্শে বাংলাদেশকে যে মাত্রায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল তা বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য কত জরুরি। এবার বাংলাদেশকে সফল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি দিতে ঐক্যের দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। আগস্ট বিপ্লব-উত্তর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে- রাষ্ট্রকে সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়া এক অনন্য সাধারণ উদ্যোগ। রাষ্ট্রের ধ্বংপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনির্মাণ করা, প্রজাতন্ত্রের প্রধান আইনগ্রন্থের পুনর্লিখন ইত্যাদি। এসব চাহিদা গোটা জাতির বহু দিনের চাওয়া।
দেশের প্রধান দুই দল- বিএনপি ও জামায়াত এবং অন্যান্য পক্ষ যেসব দফার কথা বলছে তা রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কার বলে যেভাবেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন, সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে তা উপস্থাপন করেছে। আশার কথা হলো- সব দল ও সরকারের লক্ষ্য অভিন্ন। বিশ্বের কাছে প্রমাণ করতে হবে জাতি এখন ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সব খাতে উন্নয়নের যে বাসনা, তাকে ‘প্রটেক্ট’ করতে হবে। কে সুরক্ষা দেবে এ পথযাত্রায়? অবশ্যই পুলিশ, বিজিবি ও সশস্ত্রবাহিনী। পুলিশ কোনো দলের নয়, জনগণের পুলিশ করার প্রক্রিয়া চলছে। এখানে জাতির মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রশ্ন নেই।
দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে পতিতজনেরা নিধিরাম সরদার করে রেখেছিল। সেখানে সংস্কার একান্ত জরুরি। সশস্ত্রবাহিনী জাতির সৌর্য-বীর্যের প্রতীক। পতিত সরকার ও তাদের দোস্ত বুজুর্গদের তাতে ছিল চরম অনীহা এবং প্রবল আপত্তি। তাদের মতলব ছিল আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে অগ্রসর করা নয়; বরং সব দিক থেকে পেছনে টেনে ধরা। এটিই ছিল পতিত স্বৈরাচারের দুরভিসন্ধি। ধসে পড়া সব খাতের সংস্কার কার্যকরভাবে এগিয়ে নেয়া তখনই সহজ ও সম্ভব হবে যখন সব দলের জাতির কল্যাণে সব দফার সাথে সরকারের সংস্কার কর্মসূচির মেলবন্ধন ঘটবে। ঠিক তখনই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে একজন উপদেষ্টা এ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ অবিলম্বে দারিদ্র্যবিমোচন করে ‘দরিদ্র দেশের তকমা ফেলে দিয়ে উপরের স্তরে পৌঁছে যাবে।’
বাংলাদেশের এমন ঊর্ধ্বমুখী অভিযাত্রা কখনো পড়শিরা ভালো চোখে দেখবে না। কারণ একে তারা নিজেদের জন্য দুই ধরনের বিপদ বলে মনে করে। প্রথমত, পড়শিরা সব সময় বাংলাদেশকে তাদের মুখাপেক্ষী করে রাখতে পছন্দ করে। কেননা, মুখাপেক্ষীদের সহজে ‘বশে’ রাখা যায়। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় যদি পড়শি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের ওপরে যায়; তাহলে সেই অঞ্চলে অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশ স্থিতিশীল হলে পড়শিদের গাত্রদাহ নিঃসন্দেহে বাড়বে। ইতোমধ্যে কোনো বা কোনো সূচকে বাংলাদেশ পড়শিদের সব অঞ্চলের ওপরে বা ছুঁয়ে গেছে। এটিও তাদের জন্য সহনীয় নয়। পতিত সরকার সব সূচকে বাংলাদেশকে পিছিয়ে রেখে পড়শিদের প্রীতিভাজন হয়েছিল। সেখানে ব্যত্যয় ঘটায় তাদের এখন আহার নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটছে।
সে কারণে এখানে সেখানে তাদের অসন্তুষ্টির আগুন ছড়াচ্ছে। তবে এসব অঘটন বাংলাদেশের জন্য প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করছে। প্রশাসন ও জনগণকে রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি তথা জাতীয় ঐক্যের শক্তি দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। একটি বোধ হচ্ছে- কারবালা কা বাদ বহুত কুছ জিন্দা হোতা হ্যায়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে নির্বাচন, এখানেও ঐক্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। গত সাড়ে ১৫ বছরে জাতির ভাগ্যে যত জুলুম-নির্যাতনের জঞ্জাল স্তূপকৃত হয়েছে; গণতন্ত্রের প্রশ্নে তথা নির্বাচন নিয়ে যে জুলুম করা হয়েছে- সেটি দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল। গণতন্ত্রের ওপর আরোপিত জুলুম প্রকৃতপক্ষে অন্যান্য যন্ত্রণার জন্ম দিয়েছে। গণতন্ত্রের শক্তি সব জুলুমের প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার শক্তি জোগায়। সেই গণতন্ত্র ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। গণতন্ত্র কখনো দৃশ্যমান হয় না বটে; কিন্তু গণতন্ত্রের অনুশীলন তথা নির্বাচন সবাই দেখতে পান। মানুষের অভিপ্রায় অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় নির্বাচনে, তার পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে পারেন ভোটপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
গত সাড়ে ১৫ বছর নির্বাচনের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছিল পতিত লীগ সরকার ও তার সৃহৃদ সুজন। ইলেকশন রূপ নিয়েছিল সিলেকশনে। আওয়ামী লীগ যাকে সিলেকশন করেছে পতিত যুগের ইলেকশন কমিশন তাকে ইলেকটেড বলে ঘোষণা করেছে। এখন এ সিস্টেম পাল্টাতে হবে। নির্বাচনকে সঠিক স্থানে পৌঁছে দিতে কী করতে হবে এবং কিভাবে করতে হবে তা বাতলাতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের প্রয়োজন। সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা উচিত, বিগত সাড়ে ১৫ বছরে পতিত সরকার নির্বাচনের নামে যতগুলো তামাশা করেছে তার প্রতিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন জনগণ। তা সত্ত্বেও আমাদের এক পড়শি দেশ তাকে দ্রুত স্বীকৃতি দিতে কোনো কুণ্ঠা বা গ্লানিবোধ করেনি।