
মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত পলাতক শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে ‘মাফিয়াতন্ত্র’ কায়েম করেছিলেন। প্রতিটি সেক্টরে দলীয়করণ করে প্রশাসনে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদের আওয়ামী লীগের চাকরে পরিণত করেছিলেন। এমনকি ভারতের নীলনকশায় প্রশাসন এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যে, সরকারি চাকুরেরা দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা পালানোর পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কী প্রশাসনের কর্মরত বিভিন্ন সেক্টরের সরকারি কর্মকর্তা দলনিরপেক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন? নাকি কোনো রাজনৈতিক দলের কোটারি হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন? এ নিয়ে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ উঠেছে। বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপির বিরুদ্ধে প্রশাসনকে দলীয়করণের অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কারা অনুগত আমলাদের প্রমোশন ও পদ-পদবিতে বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে? জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিরুদ্ধে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠলেও বিএনপির দাবি প্রশাসনকে জামায়াতিকরণ করা হয়েছে। আবার জামায়াতের অভিযোগ, প্রশাসনে বিএনপিকরণ হয়ে গেছে। কোন দলের বক্তব্য সত্য? এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী নির্বাচনের সময় ‘প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা’ ফাঁস করে দিয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে কিভাবে প্রশাসনে কর্মরত ডিসি-এসপি, রিটার্নিং, প্রিজাইডিং ও পুলিশ অফিসারদের দাঁড়িপাল্লা মার্কার প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করাবেন সে গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। দলের প্রার্থীদের শিখিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে প্রশাসনকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বস্তরে জামায়াতপন্থিদের যে প্রাধান্য তা ওপেন সিক্রেট। গত এক বছরে ইনকিলাবসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রশাসনে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিপন্থি কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কব্জা করেছে জামায়াত। শুধু তাই নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সেক্টর, করপোরেশনে জামায়াত অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও সেটি উঠে এসেছে। অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য প্রফেসর আনু মুহাম্মদ বলেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আমরা তিনটি দলের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর আওয়াজ বেশি এবং তাদের কর্তৃত্ব বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রশাসনযন্ত্রে জামায়াতে ইসলামীর যে দাপট, সেটি তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রচার করতে চায়। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কাজে লাগিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায় দলটি।
ভূমিকম্প নিয়ে যখন সারাদেশের মানুষ উদগ্রীব, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে ভীতি আতঙ্ক; তখন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর একটি বক্তব্য ভাইরাল হয়। জামায়াতের সাবেক এমপির এই বক্তব্য এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। গত শনিবার চট্টগ্রামে জামায়াত আয়োজিত ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলন’ শাহজাহান চৌধুরীর নির্দেশনা নিয়ে সর্বত্রই চলছে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক। জামায়াত নেতা বলেছেন, ‘নির্বাচন শুধু জনগণ দিয়ে নয়...যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় ওঠবে, আমাদের কথায় বসবে। আমাদের কথায় গ্রেফতার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে। যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারকে দাঁড়িপাল্লার কথা বলতে হবে। পুলিশকে আপনার পেছনে পেছনে হাঁটতে হবে। ওসি সাহেব আপনার কী প্রোগ্রাম, তা সকালবেলায় জেনে নেবেন আর আপনাকে প্রটোকল দেবেন।’
জামায়াতের নেতার বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহিদ উর রহমান ইউটিউব চ্যানেল জাহিদ টকসে বলেন, হাসিনার সুর এখন জামায়াত নেতার মুখে শোনা যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার কিছুটা লজ্জাবোধ থাকলেও জামায়াত নেতাদের সেটিও নেই। জামায়াত যে কত হিং¯্র ফ্যাসিস্ট ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই সে আলামত প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ কেউ বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখেছি; একবার জামায়াতকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ দিয়ে দেখুন। জামায়াত এই ন্যারেটিভ মার্কেটিং করছে। ক্ষমতায় গেলে জামায়াত কী করবে, দলটির নেতাদের আচরণে বোঝা যাচ্ছে। ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক স্বার্থে জামায়াত নেতারা কখনো বিনয়ী হন বটে; কিন্তু তারা প্রতিপক্ষকে কোনোভাবেই মতামত দিতে দেন না। ইউটিউব চ্যানেলে আমার বক্তব্য প্রকাশের পর জামায়াত, শিবির নেতাকর্মী এবং তাদের বট বাহিনী যে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে, তা কোনো মানুষের মুখের ভাষা হতে পারে না। তারা মুখ দিয়ে বিষ্ঠা ছড়িয়ে দেয়। শিবির কি জিনিস তা কলেজ জীবনে দেখেছি। যারা একসময় জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি করেছেন এবং এখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন তারা জানিয়েছেন, দলটির নেতারা কত অসহিষ্ণু এবং হিংস্র। জামায়াত নেতা শাজাহান চৌধুরীর বক্তব্যে দলটির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। এখন সবাইকে জামায়াত নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনের সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টর, করপোরেশন, অধিদফতর, পরিদফতর, আইন ও বিচার বিভাগে বিচারক নিয়োগ, বিচারালয়ে আইন কর্মকর্তা (পিপি, এপিপি, জিপি) নিয়োগ, পুলিশ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন, পদোন্নতি, চুক্তিভিক্তিক নিয়োগে জামায়াত অনুসারীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এমনকি মাঠ প্রশাসনেও একই চিত্র। বিএনপি থেকে এসব তথ্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেয়া হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বিএনপি নেতারা এ তথ্য তুলে ধরেছেন। যার কারণে আসন্ন নির্বাচনে জেলা রিটার্নিং অফিসার পদে জেলা প্রশাসকের বদলে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। শুধু তাই নয়, ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষকদের প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার পদে না বসানোর আবেদন করা হয়েছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর মুখ থেকে প্রশাসনের জামায়াতিকরণের ভেতরের চিত্র উঠে এসেছে। তবে সরকার আগেই ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দলনিরপেক্ষতা দেখা হবে। সে জন্য ডিসি, এসপি পদে লটারির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হবে। সরকার ইতোমধ্যেই ডিসি, এসপি পদে রদবদল শুরু করেছে। প্রশাসনের এই উদ্যোগে জামায়াতের নেটওয়ার্ক ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। গত ১৯ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে অংশ নিয়ে এ উদ্বেগ জানান। তার দাবি, জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে সাম্প্রতিক সময়ে যে রদবদল চলছে, তা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তার ভাষায়Ñ বদলিগুলো এক মাস ধরে হয়নি, ২০ দিনও হয়নি, একজন ডিসি হঠাৎ করেই বদলি হয়েছেন, আবার খুব কম সময়ের মধ্যে অনেকে স্থানান্তরিত হয়েছেন। বিষয়টি যেন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য বা ডিজাইন অনুযায়ী হচ্ছে, যা নির্বাচনকে ঘিরে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ইনকিলাবকে বলেন, শাজাহান চৌধুরী চট্টগ্রামের যে অনুষ্ঠানে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জামায়াত নেতাদের নির্দেশে চলার কথা বলেছেন; সেখানে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন. নির্বাচনের দিন গণভোট আমরা ভালোভাবে দেখছি না। আমরা আগেই বলেছি, নির্বাচনের দিন গণভোট হলে নির্বাচনের জেনোসাইড হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর আগে প্রশাসনকে জামায়াতের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। মূলত দলটি পরিকল্পিতভাবে নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে, তারা ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায় ষড়যন্ত্র করছে। নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত সময়ে না হতে পারে, সে জন্য সঙ্কটময় পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে জামায়াত।
সিভিল প্রশাসন জামায়াতিকরণ : প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াতিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় বেশ সফল হয়েছে জামায়াত। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো জামায়াতি চেতনার আমলারা দখল করেছেন। তবে প্রশাসনযন্ত্রে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আমলা রয়েছেন। এখনো জামায়াতপন্থিরা নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সূত্রের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা আসার পরপর প্রশাসন পুরো দখলে নিয়েছেন জামায়াতপন্থি আমলারা। প্রশাসনে স্বাস্থ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বড় বড় ৩০টি মন্ত্রণালয়ের জামায়াত অনুসারী সচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ জামায়াতপন্থি হিসেবে চিহ্নিত। তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব হওয়ার পরে জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। এছাড়াও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকসুদ জাহেদী, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ, জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর একান্ত সচিব) গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলোয়া আক্তার, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামাল উদ্দীন, সেতু বিভাগ সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব আসাদ আলম সিয়াম, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব উল আলম এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব মো. সাইফল্লাহ পান্না (কখনো জামায়াত ও কখনো বিএনপি, এর আগে বিএনপির ক্ষমতা থাকার সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন)। বর্তমানে এরা জামায়াতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
আইনাঙ্গনের দখলিকরণ চিত্র : প্রশাসনের মতো বিচার বিভাগেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জামায়াতের শক্ত নিয়ন্ত্রণ। গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর পালিয়ে যান বিচার বিভাগের অনেক কর্মকর্তা। এ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সরকারি স্বার্থ ক্ষুণœ হচ্ছিল। আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় সারাদেশে জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং বিভিন্ন ট্রাইব্যুনালে সরকারি আইন কর্মকর্তা, যেমনÑ পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), সরকারি কৌঁসুলি (জিপি), অতিরিক্ত পিপি, অতিরিক্ত জিপি, সহকারী পিপি ও সহকারী জিপি পদে আইনজীবীদের নিয়োগ দেয়া হয়। সারাদেশে নতুন করে অন্তত তিন হাজার আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বরে ২৫টি জেলায় এক হাজার ২৯৯ জন আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিভিন্ন আদালতে নিয়োগ দেয়া হয় ৪৫৪ জন আইন কর্মকর্তা। ময়মনসিংহ ও মৌলভীবাজারে যথাক্রমে ১৫৬ ও ৪২ জনসহ ১৯৮ জন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বগুড়ায় ১০৭ জন, ঠাকুরগাঁওয়ে ২১ জন এবং ঝিনাইদহে ৭২ জনসহ আরো ২০০ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। রংপুরে নিয়োগ দেয়া হয় ৩৪ জন। গত বছর নভেম্বরে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে ২৭৪ জন অ্যাটর্নি নিয়োগ দেয়া হয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে এখন ৩৩৬ আইন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবী বলে অভিযোগ রয়েছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১০০ আইনজীবীকে। এর মধ্যে ৩৭ জন জামায়াত-সমর্থক আইনজীবী। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেয়া হয়েছে ২৩৬ জনকে। এর মধ্যে ৮৯ জন জামায়াত-সমর্থক। অথচ সুপ্রিম কোর্ট বারে জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবীর সংখ্যানুপাত ৯১:০৯। অর্থাৎ বিএনপি-আ.লীগ ও অন্যান্য দল সমর্থিত আইনজীবীর সংখ্যা শতকরা ৯১ জন হলেও জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী সংখ্যা ৯ শতাংশ। অথচ আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে অনুপাতে অনেক বেশি।
এ ছাড়া হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জামায়াত সমর্থক বিচারক ও আইন কর্মকর্তা থাকার অভিযোগ ও বিতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিলেট জেলা ও মহানগর দায়রা জজ আদালতের ১০৩ জন সরকারি কৌঁসুলির (পিপি ও জিপি) মধ্যে ৯০ জন বিএনপি-সমর্থক হিসেবে পরিচিত এবং ১২ জন জামায়াত-সমর্থক। এই নিয়োগুলো আইন উপদেষ্টার টেবিল দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে। জামায়াত সমর্থক আইনজীবী বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের নৈতিকতা নিয়ে জামায়াত যে ‘মিথ’ প্রচার করে আসছে, সেটি অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। গত আগস্টে পটুয়াখালী জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারককে ঘুষ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) রূহুল আমিনের নিয়োগ বাতিল করা হয়। তিনি জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবী হিসেবে পরিচিত।
আওয়ামী জমানায় বিচার বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পোস্টিং রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে দেয়া হতো। এই ধারার প্রভাব বিচার বিভাগের কোনো কোনো ক্ষেত্রেও থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ। জামায়াত তার ‘রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা’য় উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সুষ্ঠু ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এক আদেশে এক সাথে ২৫২ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে বদলি করে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ‘পরামর্শক্রমে’ এসব বদলি করা হয়েছে মর্মে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছে। বদলি হওয়াদের মধ্যে জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং সিনিয়র সহকারী ও সহকারী জজ রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাসহ ১৯টি জেলায় ৪১ জন জেলা জজসহ মোট ২৩০ জন বিচারককে বদলি করা হয়। গত ২ জুন ২৫২ বিচারককে একযোগে বদলি করা হয়। এর মধ্যে ৩০ জন জেলা ও দায়রা জজ রয়েছেন। চলতি বছর ১ সেপ্টেম্বর বদলি করা হয়েছে ১০ বিচারককে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগে ১০৭ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে ছয় জন আপিল বিভাগের বিচারপতি এবং হাইকোর্ট বিভাগে ১০১ জন বিচারপতি রয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগে কর্মরত ৭৬ জন স্থায়ী বিচারপতি এবং ২৫ জন অতিরিক্ত বিচারপতি। সর্বশেষ গত ১১ নভেম্বর অতিরিক্ত ২৫ বিচারপতির মধ্য থেকে ২২ জনকে হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী করা হয়েছে। নতুন নিযুক্ত হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যেও জামায়াত সমর্থক রয়েছেন অর্ধেকের কাছাকাছি।
পুলিশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা : সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৪ মাস পরেও এসপি (জেলা পুলিশ সুপার) পদে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীপন্থি পুলিশ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। একই সাথে জামায়াতপন্থি পুলিশ কর্মকর্তারা রেঞ্জ ডিআইজি, মেট্টোপলিটন কমিশনার ও এসপি (জেলা পুলিশ সুপার) পদে রয়েছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব পুলিশ কর্মকর্তা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রতিবেদন পাঠানো হলো। মাঠপর্যায়ের তদন্ত এবং ওই তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর যাচাই-বাছাই করে অতিগোপনীয়তার সাথে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে ওই গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মো. মঞ্জুর মোর্শেদ আলম জামায়াতপন্থি। তার বাবা জামায়াতের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আরপিএমপির (রংপুর মেট্টো) কমিশনার মো. মজিদ আলী বিপিএম জামায়াতপন্থি। তিনি শিক্ষা জীবনে জামায়াতের ছাত্র-রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। অন্যদিকে, জেলার পুলিশ সুপারদের মধ্যে জামায়াতপন্থি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন নরসিংদী জেলার এসপি মেনহাজুল আলম, মানিকগঞ্জের এসপি ইয়াছমিন খাতুন, টাঙ্গাইলের এসপি মিজানুর রহমান, রাজবাড়ীর এসপি কামরুল ইসলাম, কক্সবাজার জেলার এসপি সাইফ উদ্দীন শাহীন, রাঙ্গামাটি জেলার এসপি এস এম ফরহাদ হোসেন, রাজশাহী জেলার এসপি ফারজানা ইসলাম, চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার এসপি রেজাউল করিম বিপিএম সেবা, জয়পুরহাট জেলার এসপি মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব, খুলনা জেলার এসপি টি এম মোশাররফ হোসেন, ঝিনাইদহ জেলার এসপি মনজুর মোর্শেদ বিপিএম সেবা, নড়াইল জেলার এসপি রবিউল ইসলাম, মায়মনসিংহ জেলার এসপি কাজী আকতার উল আলম ও দিনাজপুর জেলার এসপি মারুফাত হুসাইন।
অতিগোপনীয় ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় আওয়ামীপন্থি ও সুবিধাভোগী পুলিশ কর্মকর্তারাও জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাঠ প্রশাসনে এ ধরনের কর্মকর্তা থাকলে জনসাধারণ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। একই সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হতে পারে। আওয়ামীপন্থি ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে বর্তমানেও যারা জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা হলেন মাদারীপুর জেলার এসপি মোহাম্মদ নাঈমুল হাসান, কুমিল্লার এসপি মোহাম্মদ নাজির আহম্মেদ খান, খাগড়াছড়ির এসপি আরেফিন জুয়েল, নওগাঁর এসপি সাফিউল সারোয়ার বিপিএম সেবা, ঝালকাঠির এসপি উজ্জল কুমার রায় ও সুনামগঞ্জ জেলার এসপি তোফায়েল আহম্মেদ।
জামায়াতের চট্টগ্রামের নেতা শাজাহান চৌধুরীর ভিডিওর বক্তব্য প্রসঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য যে ধরনের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকা দরকার, সেটি দেখতে পাচ্ছি না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, চট্টগ্রাম এক জামায়াত নেতা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন, প্রশাসনকে কীভাবে দখল করতে হবে, প্রশাসনকে কীভাবে হাতে রাখতে হবে।