ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পারমাণবিক আলোচনা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মে ২০, ২০২৫, ৭:৫৩ পূর্বাহ্ণ /
ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পারমাণবিক আলোচনা

মীযানুল করীম

  • তেহরান বারবার বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘শান্তিপূর্ণ’, পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর লক্ষ্য নেই তাদের। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে বের করে নেয়ার পর ইরানও চুক্তিতে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন শুরু করতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে নাটকীয়ভাবে বাড়াতে বাড়াতে ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধতার মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে মোটামুটি ৯০ শতাংশ লাগে, বলছে জাতিসঙ্ঘের আণবিক শক্তি সংস্থা। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে আশপাশের রাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব পড়বে ইতিবাচক। তখন ট্রাম্প আরো নমনীয় হতে বাধ্য হবেন

পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সাথে প্রায় এক মাস ধরে চার দফা আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। ইরানের সামরিক বাহিনীর সমরাস্ত্রবিষয়ক গবেষণা সংস্থা অর্গানাইজেশন অব ডিফেন্সিভ ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চকে (এসপিএনডি) নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য করা হয়েছে। ইরানি সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট তিন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নিষেধাজ্ঞায় ইরানের তিনজন কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই তিন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা যাবতীয় সম্পদ ইতোমধ্যে করা হয়েছে। যত দিন নিষেধাজ্ঞা থাকবে তত দিন তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ ছাড়া কোনো মার্কিন প্রতিষ্ঠানও তাদের সাথে কোনো প্রকার আর্থিক চুক্তি করতে পারবে না বলেও জানানো হয়। বলা হয়, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে চলেছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে অব্যাহত রেখেছে গবেষণা ও উন্নয়ন। ইরান বিশ্বের একমাত্র দেশ যাদের পারমাণবিক অস্ত্র না থাকলেও ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেছে। আরো বলা হয়, তেহরান বিদেশী সরবরাহকারীদের কাছ থেকে দ্বৈত ব্যবহার অর্জনের প্রচেষ্টাকে আড়াল করার জন্য ফ্রন্ট কোম্পানি এবং ক্রয় এজেন্টদের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে।

পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হলো, পারমাণবিক অস্ত্র গবেষণা ও উন্নয়ন পরিচালনায় এসপিএনডির ক্ষমতা বিলম্বিত ও কমানো। ইরান যাতে কখনো পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন না করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুত এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার পাশ্চাত্যপন্থী প্রধান ইরান পরিদর্শন করে পত্রিকাগুলোতে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইরানিরা জানে কখন কী বলতে হয়।

মার্কিন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সর্বপ্রথম তিন রাষ্ট্রের সফরে মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন। সৌদি আরবে তিনি বাদশাহ সালমানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। সৌদি যুবরাজ মুহম্মদ বিন সালমানের উপস্থিতিতে প্রেস ব্রিফিং করেন তিনি। ব্রিফিংয়ে বলেন, ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির কাছাকাছি তিনি পৌঁছে গেছেন। তবে তিনি এও বলেন, ইরান বেশকিছু শর্তে চুক্তিতে রাজি হয়েছে। ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কমান্ডার মেঞ্জেনাল হোসেন সালামি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো চলবে না ইরান। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চায় না ইরান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক।

তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে দুইপক্ষের মধ্যে যে বিরোধ তা কমিয়ে আনতে আলোচনায় বসার কথা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি ও ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ ওমানি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে চতুর্থ দফার আলোচনায় বসার কথা।

বেশ কিছু ‘রেড লাইন’ বা ‘সীমারেখা’ নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে থাকলেও তেহরান ও ওয়াশিংটন বলছে, তারা তাদের কয়েক দশকের বিরোধ কূটনৈতিকভাবে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী। নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে পৌঁছাতে এবং সামরিক সঙ্ঘাত এড়াতে এখন ‘রেড লাইন’ নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের ভাবতে হচ্ছে। ওয়াশিংটন প্রকাশ্যে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে বলেছে। তেহরান তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থান আলোচনার জন্য সহায়ক নয়। ওয়াশিংটনের ‘রেড লাইন’ হচ্ছে ‘কোনো সমৃদ্ধকরণ নয়। অর্থাৎ, সমৃদ্ধকরণ বন্ধ, পারমাণবিক অস্ত্রধর হওয়া যাবে না।’ যার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইরানকে তার নাতানজ, ফরদো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা পুরোপুরি গুটিয়ে ফেলতে হবে।

ট্রাম্প এর আগে কূটনীতি ব্যর্থ হলে ইরানের ওপর সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। উইটকফের এ মন্তব্যের জবাবে আরাগচি বলেন, ইরান তার পারমাণবিক অধিকারের ব্যাপারে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। ইরান আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, তবে এ আলোচনার লক্ষ্য যদি হয় ইরানের পারমাণবিক অধিকার সঙ্কুচিত করা, তাহলে আমি স্পষ্টভাবে বলছি, ইরান তার কোনো অধিকার থেকে একচুলও পিছিয়ে আসবে না।

ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করতে আগ্রহী তেহরান, কিন্তু ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ কিংবা মজুদকৃত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মতো প্রসঙ্গ হচ্ছে ইরানের রেড লাইন, যা নিয়ে আলোচনায় কোনো ছাড় দেয়া হবে না। আলোচনায় অংশ নেয়া ইরানি দলের সাথে ঘনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ এক ইরানি কর্মকর্তা বলেছেন, শূন্য সমৃদ্ধকরণ ও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো গুটিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে দাবি তা আলোচনায় অগ্রগতি আনার বদলে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে তার সাথে আলোচনায় যা বলছে, তার মধ্যে পার্থক্য আছে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন ওই কর্মকর্তা। আলোচনা শুরুর পর বিষয়টি আরো স্পষ্ট হওয়ার কথা বলে মত তার। এ আলোচনা গত ৩ মে রোমে হওয়ার কথা থাকলেও ‘লজিস্টিক্যাল কারণে’ তা বাতিল করতে হয় বলে পরে ওমান জানিয়েছিল। ইরান তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়েও কোনো ধরনের আলোচনায় রাজি নয়; পাশাপাশি কোনো চুক্তি হলে ট্রাম্প যে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবেন না সে বিষয়েও নির্ভরযোগ্য নিশ্চয়তা চাইছে তারা।

ফেব্রুয়ারি থেকে ইরানের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া ট্রাম্প ২০১৮ সালে ওয়াশিংটনকে তার তিন বছর আগে তেহরানের সাথে ছয় বিশ্ব শক্তির করা পরমাণু চুক্তি থেকে বের করে আনেন এবং ইরানের ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেন।

তেহরান বারবার বলেছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ‘শান্তিপূর্ণ’, পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর লক্ষ্য নেই তাদের। তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে বের করে নেয়ার পর ইরানও চুক্তিতে দেয়া নানা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন শুরু করতে থাকে। ২০১৯ সাল থেকে নাটকীয়ভাবে বাড়াতে বাড়াতে ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধতার মাত্রায় নিয়ে গেছে, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে মোটামুটি ৯০ শতাংশ লাগে, বলছে জাতিসঙ্ঘের আণবিক শক্তি সংস্থা। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে আশপাশের রাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব পড়বে ইতিবাচক। তখন ট্রাম্প আরো নমনীয় হতে বাধ্য হবেন।