অন্তর্বর্তী সরকার এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে জোর দেবেন। লন্ডনের হোটেল ডোরচেস্টারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে তারেক রহমানের বৈঠকটি হবে ওয়ান টু ওয়ান। আগামীকাল শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টার এই দীর্ঘ বৈঠকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সব বিষয় উঠে আসবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। তবে মূল ফোকাস থাকবে নির্বাচন প্রসঙ্গ।
জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে জোর দেবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন। গণহত্যার বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে সরকারকে দলের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি কিভাবে এই দু’টি বিষয়ে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যায়, তাও তুলে ধরবেন তারেক রহমান।
বিএনপির পাশাপাশি রাজনৈতিক মহলও আশা প্রকাশ করছেন, তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট কেটে যেতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ বৈঠকটিকে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘একটা সুযোগ’ বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং আগামী নির্বাচনে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সরকারের জন্য নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাব বোঝা খুব দরকার। অন্য দিকে সরকারও কী কী করতে চায়, সেটাও তারেক রহমানের জানা দরকার।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে যে, বিগত দুই মাসব্যাপী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পর সরকারও নির্বাচন নিয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে। সম্ভবত সরকারের অভ্যন্তরে এই উপলব্ধি হয়েছে যে, এখন বিএনপির সাথে কনফ্রন্টেশল মোড থেকে রিকন্সিলিয়েশন মোড-এ আসা প্রয়োজন।’
অন্তর্বর্তী সরকার আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটিকে যৌক্তিক মনে করছে না বিএনপি। দলটি মনে করে, নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময়। তবে নির্বাচন আগামী বছরের জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে অর্থাৎ রোজার আগে হলেও আপত্তি থাকবে না বলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দলটির অভিমত, সর্বোচ্চ এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। ড. ইউনূসের সাথে বৈঠকে তারেক রহমান এ বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার সাথে কথা বলে জানা গেছে।
গত কয়েক মাস ধরে ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতের রায় আসার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, এটিকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে রাজধানীতে অচলাবস্থা তৈরি এবং এর রেশ ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সাথে বিরোধে জড়ানোসহ সরকারের সাথে একধরনের তিক্ততা তৈরি হয় বিএনপির। এমন একটি পরিস্থিতিতে গত ২৮ মে নয়াপল্টনে বিএনপির বড় সমাবেশ থেকে তারেক রহমান স্পষ্টভাবেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে। দলটির একাধিক সূত্র মতে, এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য দুই মাস দেখার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এ সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে কিংবা নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠলে দাবি আদায়ে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আগামী জুলাই থেকে মাঠের কর্মসূচিরও পরিকল্পনা করছিল দলটি।
বিএনপির এমন অনড় অবস্থানের মধ্যে ঈদুল আজহার আগের দিন গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানেই তিনি ঘোষণা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর ওই রাতেই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সরকারের এ ঘোষণার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়। স্থায়ী কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে এক দিকে আবহাওয়ার সঙ্কট এবং অন্য দিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সরকার ও বিএনপির মধ্যে এমন টানাপড়েনে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘিরে সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকে। আদৌ এপ্রিলে নির্বাচন হবে কি না, কিংবা নির্বাচন কবে হবে- তা নিয়ে বিএনপিতে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়। এরই মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের লন্ডন সফরে তারেক রহমানের বৈঠকটি আলোচনায় উঠে আসে। প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে এ বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। জানা গেছে, এই আমন্ত্রণের পর গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা হয়। বৈঠক থেকে তারেক রহমানকে নির্বাচন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা থেকে শুরু করে সব স্তরের নেতাকর্মীরা এখন লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠেয় বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সবার প্রত্যাশা, এই বৈঠক থেকে একটি ইতিবাচক ফল বেরিয়ে আসবে। আর এ বৈঠকের পরই বিএনপি তাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।
জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার- মূলত এই তিনটি ইস্যু প্রাধান্য পাবে। ডিসেম্বরে না হলে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগে যাতে নির্বাচনটা হয়ে যায়, সে বিষয়টিতে তারেক রহমান সর্বোচ্চ জোর দিতে পারেন বৈঠকে। অন্য দিকে সরকারি সূত্র বলছে, সরকারও কেন আগামী এপ্রিলে নির্বাচন করতে চায়, সেটা ড. ইউনূস তার ভাষণে যেমন তুলে ধরেছেন; সংস্কার ও বিচারের পাশাপাশি তারেক রহমানের সাথে বৈঠকেও এই বিষয়টি তিনি তুলে ধরবেন। এ ছাড়া বৈঠকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়েও আলোচনা হতে পারে বলে সূত্র বলছে।
নির্বাচন নিয়ে সিদ্ধান্তের কর্তৃত্ব তারেক রহমানকে দেয়া হয়েছে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠেয় প্রস্তাবিত বৈঠকটিকে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক উন্নয়ন হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি এই বৈঠকের মাধ্যমে গঠনমূলক আলোচনার পথ তৈরি হবে, যা রাজনীতিকে সামনে এগিয়ে নিতে এবং একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। এটি বর্তমান সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার জন্য আশার আলো জ্বালাবে।’
ড. মোশাররফ জানান, আলোচনায় নির্বাচন ইস্যু থাকবে কেন্দ্রবিন্দুতে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরবেন। আমরা মনে করি ডিসেম্বর হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়, কারণ এপ্রিল মাসে নানা বাস্তবিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা আশা করি প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনসূচি পুনর্বিবেচনা করবেন।
রমজান, পাবলিক পরীক্ষা ও প্রতিকূল আবহাওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিলে বিএনপি তাতে সম্মত হবে কি না জানতে চাইলে ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ কর্তৃত্ব দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, গোটা জাতি এখন লন্ডনের দিকে তাকিয়ে। বিশ্বাস করি, এটি হবে ঐতিহাসিক বৈঠক এবং এ বৈঠকের মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে।
সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই সুযোগ : বৈঠকটিকে সরকার ও বিএনপি উভয়ের জন্যই ‘সুযোগ’ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের অবস্থান, নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, দেশকে স্থিতিশীল রাখা, বিএনপির সাথে সরকারের কোনো দূরত্ব নেই অর্থাৎ একটা ঐক্য অবস্থা প্রকাশ করা- এগুলো সবই এখন সরকারের জন্য প্রয়োজন। তা ছাড়া এই অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান অবস্থা থেকে বের হয়ে একটা নির্বাচিত স্বাভাবিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নিতে হবে। এমন অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে শুক্রবার অনুষ্ঠেয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সামনে নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। সুতরাং এই সরকারের জন্য সেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মনোভাবটা বোঝা দরকার। যদিও ঢাকায় বিএনপির প্রতিনিধিদলের সাথে সরকারের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে তাদের কেউ দলটির হাইকমান্ড নন। হাইকমান্ডের সাথে কথা বলা আর অন্যদের সাথে কথা বলা এক রকম না। সেই জায়গা থেকে বলতে গেলে সরকার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক আরো বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্যেরও একটা সূচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে একটা বার্তাও যাচ্ছে যে, বিএনপি ও সরকার পথ চলছে একসাথে। না হলে তো তারা বসত না। আর বসার মানেই হলো এখানে একটা ইতিবাচক দিক আছেই।
আপনার মতামত লিখুন :