ড. ইউনূস-তারেক রহমান মুখোমুখি হবেন লন্ডনে, ঐতিহাসিক বৈঠক আজ


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ১৩, ২০২৫, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ /
ড. ইউনূস-তারেক রহমান মুখোমুখি হবেন লন্ডনে, ঐতিহাসিক বৈঠক আজ

গ্লোবালাইজেশনের যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তপাত ঘটিয়ে বিজয়ের চেয়ে টেবিলে বসে সংলাপযুদ্ধে সমঝোতা-বিজয় গৌরব বেশি। পৃথিবীর বহু দেশের ভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে অন্যদেশে টেবিল সংলাপে। এক্ষেত্রে লন্ডন প্রসিদ্ধ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ’৭১ সালের ১৬ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তর ইস্যুতে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। ২১ মার্চ শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে অনির্ধারিত বৈঠক হলো। ২৪ মার্চ শীর্ষ দুই নেতার পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিলের চূড়ান্ত ফলাফল অগ্নিঝরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়।

ইয়াহিয়া-মুজিবের ওই বৈঠক সফল হলে পরিস্থিতি যুদ্ধে গড়াতো না, যা নিয়ে এখনো পাকিস্তানের নেতাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। নেতাদের ব্যর্থতার দায় গোটা জাতির ওপর পড়েছিল। বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশের ভাগ্য অতীতেও বহুবার লন্ডনে নির্ধারিত হয়েছে। এমনকি পাকিস্তান কারাগার থেকে বের হয়ে শেখ মুজিব প্রথমে লন্ডন হয়েই ঢাকায় ফিরেছিলেন। অর্ধশত বছর পর আরেকবার বাংলাদেশের ভাগ্য লন্ডনে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে হাঁটবে; নাকি ফের দেশের রাজপথ উত্তপ্ত হবে বিশৃংখল পরিস্থিতির পথে যাবে তারই ফয়সালা হবে।

আজ লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠিতব্য এ বৈঠক কি ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের মতো ‘ট্র্যাজেডি’ হবে নাকি ১২ কোটি ভোটারের প্রত্যাশিত নির্বাচন উৎসবের চারা রোপিত হবে? ড. ইউনূস-তারেক রহমান বৈঠকের দিকে গোটা দেশ তাকিয়ে। বিশ্বের যে সব দেশের নেতারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র-আইনের শাসন ও ভবিষ্যত নিয়ে যারা ভাবেন তারাও লন্ডন বৈঠকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ওই বৈঠক নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-উচ্ছ্বাস-আশাবাদ সবকিছুই রয়েছে। দার্শনিক গেয়র্গ ভিলহেল্ম ফ্রিডরিখ হেগেলের মতে, ‘ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না’।

কার্ল মার্ক্স বলেছেন, ‘ইতিহাসে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। ঘটলে সেটা ট্র্যাজেডি আকারে হতে পারে, তেমনি প্রহসন রূপেও হয়’। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ ইয়াহিয়া-মুজিবের বৈঠকের মতো কার্ল মার্ক্সের উক্তি ‘ইতিহাসে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে না’ দেখতে চায়। মানুষ চায় ৮৬ বছর বয়সী ড. ইউনূস লন্ডন বৈঠকে নির্বাচন ইস্যুতে সংকটের সুরাহা করে ইতিহাস হয়ে থাকার পথে একধাপ এগোবেন। ৬০ বছরেরও কম বয়সী রাজনীতিক তারেক রহমানও দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন। দুই পক্ষ কিছু ছাড় দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের ঐক্যের বিভেদের বেড়াজাল ছিঁড়ে ফেলবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা অবশ্য ল-ন বৈঠক নিয়ে প্রচ- আশাবাদী। সবাই বলছেন বৈঠক সফল হবে। তাদের মতে, বয়সে পিতা-পুত্র সমতুল্য ড. ইউনূস-তারেকের বৈঠকের দিকে তাকিয়ে গোটা জাতি। তারা মানুষকে আশাহত করবেন না।

লন্ডন বৈঠক প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বৈঠকে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই একটা যৌক্তিক সমাধান আসবে। সংকট সুরাহায় সমঝোতার পথ খুলবে। যার মধ্যদিয়ে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার পথ খুলবে’। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর রহমান বলেন, ‘দেশ ও জাতির স্বার্থে দুই পক্ষকে ছাড় দিতে হবে এবং তারা সেটা দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্তর্বর্তী সরকারের এপ্রিল এবং বিএনপির ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি থেকে দুই পক্ষই সামান্য ছাড়া দিলে রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের সিদ্ধান্ত হবে সে প্রত্যাশা করছি। নির্বাচন এগিয়ে নিতে হবে এটার বিকল্প নেই।’

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দু’জনই পরিপক্ব ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। ড. ইউনূস যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানে সোনা ফলিয়েছেন; তারেক রহমানও তাই। ছাত্রজনতার অভ্যুত্থান এবং ভারতের গভীর ষড়যন্ত্রে দেশ যখন চরম ক্রান্তিকালে পড়ে তখন ফ্রান্স থেকে উড়ে এসে জাতির হাল ধরেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়। ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক কানেকশন কাজে লাগিয়ে মেধা ও মনন দিয়ে দেশ পরিচালনা করায় জাতি আশার আলো দেখতে থাকে।

তবে শেখ মুজিবের ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’ এবং ‘সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ৮ কোটি কম্বল, গাজী আমার কম্বল গেল কই’ ঐতিহাসিক উক্তির মতোই অঘটন ঘটে গেছে। পশ্চিমা ও ভারতের কিছু এজেন্ট, এনজিও কর্মী এবং গোত্রপরিচয়হীন ব্যক্তিকে সরকার ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে বসানোয় বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসন গতি হারিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল সেটাতে ছন্দপতন ঘটেছে। তবুও মানুষ ড. ইউনূসের উপর আস্থাশীল এবং আশাবাদী। অবশ্য টিভি ব্যক্তিত্ব জিল্লুর রহমান বলেছেন, ‘ড. ইউনূসের প্রতি জাতি নিরপেক্ষতা আশা করেছিল। যেকোনো কারণেই হোক তিনি নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। এনসিপির প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব দেখা গেছে।

বিএনপির মতো দলকে পাত্তা না দিয়ে জামায়াতের প্রস্তাব অনুযায়ী তিনি এপ্রিলে নির্বাচনের অবাস্তব প্রস্তাব দিয়েছেন। ওই জামায়াতের বি-টীম সি-টীম হচ্ছে এনসিপি ও এবি পার্টি। দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর যে অবস্থা তাতে ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচন যে দুইতিন বছর পিছিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না’। লন্ডনে দেয়া ড. ইউনূসের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেছেন, ‘ড. ইউনূস লন্ডনে বসে গণতন্ত্রের সঙ্গে ব্লাসফেমি করেছেন। সাংবাদিক যখন প্রশ্ন করলেন সংস্কার ইস্যুতে নির্বাচন দিচ্ছেন না কেন? জবাবে ড. ইউনূস বলেন-নির্বাচনে টাকার লেনদেন হয়। টাকা দিয়ে ভোট কেনা যায়। কে কত টাকা ভোটারদের দিয়ে মতামত তাদের দিকে নেবে সে প্রতিযোগিতা হয়। এমন বক্তব্য দিয়ে তিনি ভোটারদের অপমান করেছেন; এটা ব্লাসফেমি’।

লন্ডনে ড. ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠক নিয়ে এখন সর্বত্রই আলোচনা চলছে। বৈঠকে কি হবে কারা কারা উপস্থিত থাকবেন নাকি দুই নেতা একান্তে রুদ্ধদার বৈঠক করবেন তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। এই বিশ্লেষক বলছেন, ষড়ঋতুর দেশে এপ্রিলে নির্বাচন কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ঝড়বৃদ্ধি এবং পাবলিক পরীক্ষা রয়েছে। এ ছাড়াও এপ্রিলের আগে রমজান মাস। রোজার মাসে নির্বাচনী প্রচারণা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। দুই নেতা ছাড় দিয়ে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে একমত হলে আগস্ট মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের টাইম ও ফ্রেম ঘোষণা করতে পারবে। দুই নেতারই এ বাস্তবতা মাথায় নেয়া উচিত। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, ‘রমজান মাসে কোনো ভাবেই নির্বাচনী প্রচারণা সম্ভব নয়’। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রোহিন হোসেন প্রিন্স গতকালও বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক দলগুলোর মতো সিপিবিও ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। ডিসেম্বরে নির্বাচন করা না গেলে অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এবং নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে’।

বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, ডরচেস্টার হোটেলের আজকের বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেতে পারে। এ ছাড়া চলমান সংস্কার ও বিচারের বিষয়ও আলোচনায় থাকবে। এর আগে লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘তারেক রহমান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলের নেতা এবং প্রফেসর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তারা যখন বসবেন, তখন বাংলাদেশের এখনকার যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচন, জুলাই চার্টার (জুলাই সনদ) এগুলোর যেকোনো বিষয়ে আলাপ হতে পারে।’ বৈঠক একান্তে হবে নাকি অন্যান্যরা উপস্থিত থাকবেন সেটা দু’নেতাই সিদ্ধান্ত নেবেন।

ড. ইউনূস লন্ডন সফরে যাওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে যে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক না হওয়া নিয়ে যে প্রচারণা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সেটা তেমন গুরুত্ববহন করছে না। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুক্তরাজ্য সব সময় যুক্তরাষ্ট্রের লেজুড়বৃত্তি করতে অভ্যস্ত। শেখ হাসিনা রেজিমে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি ও শেখ মুজিব পরিবারের সদস্যরা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে যুক্তরাজ্যে নিয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সেই পাচার করা টাকা ফেরত আনতে লন্ডন গেছেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী দেখা করতে আগ্রহী নন তবুও সে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আওয়ামী লীগের নেতাদের লুটের টাকায় গড়ে তোলা অট্টালিকা, সম্পদ জব্দ করছে।

লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার যাকে সব সময় ছাড়া দিয়েছেন এমপি টিউলিপ সিদ্দিকীকে। সেই টিউলিপকে বাংলাদেশে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ায় মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলছে। ফলে বোঝাই যায় লেবার পার্টি, কিয়ের স্টারমার আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকীর প্রতি সহানুভূতিশীল। শুধু তাই নয়, য্ক্তুরাজ্য সব সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেও কাজের সঙ্গে মিল নেই। ভারতের নীল নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনগুলোর বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে ওই সব পাতানো নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার পক্ষে লন্ডনে লেবারপার্টি সমাবেশ ও প্রচারণা চালিয়েছে।

অন্যদিকে তারেক রহমান পোড়-খাওয়া রাজনীতিক। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি শেকড় পর্যায় তথা উপজেলা শাখার সদস্য হয়ে বিএনপির রাজনীতি শুরু করেছেন। দিল্লির নীল নকশায় সংঘটিত ওয়ান ইলেভেনের পর তার এবং তার পরিবারের উপর বয়ে গেছে সুনামি। জেল-জুলুম-নির্যাতনে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে উঠে এসে দীর্ঘ ১৭ বছর লন্ডনে বসবাস করলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা-প্রত্যাশা সম্পর্কে তিনি ওয়াকেবহাল। বছরের পর বছর ধরে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি গ্রাম পর্যায়ের দলের নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

হাসিনা রেজিমে তার পরিবারকে ধ্বংসের চেষ্টা হয়েছে এবং বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গুম-হত্যা-হামলা-মামলা ও কারাভোগ করতে হয়েছে। রাজনীতির চলার পথের বাঁকে বাঁকে তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেখান থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। জুলাইয়ে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের সময় তিনি লাখ লাখ নেতাকর্মীকে রাস্তায় নামিয়েছেন। তার নির্দেশনায় বিএনপি, যুবদল ছাত্রদলসহ বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তারেক রহমান প্রায় প্রতিদিন ভার্চ্যুয়ালি আন্দোলনের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে বক্তব্য দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। যা হাসিনার পতন ত্বরান্বিত করেছেন। ফলে তারেক রহমান এখন অনেক পরিপক্ব রাজনীতিক। তিনি দেশের মানুষ আবারো বিপদের মুখোমুখি হতে পারে এমন একগুঁয়েমি করবেন না। তাছাড়া ড. ইউনূস ও তারেক রহমান দু’জনের কমন শত্রু আওয়ামী লীগ ও ভারত।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে তারেক রহমান বলছেন, ‘কোনো ভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না’। শুধু কি তাই! ফ্যাসিস্ট হাসিনা যখন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতনে মেতে উঠেছিলেন তখন তারেক রহমানের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ড. ইউনূসের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ড. ইউনূস বিএনপি বা তারেক রহমানের প্রতি বিক্ষুব্ধ এমন নয়। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই লন্ডন বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। ড. ইউনূস ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে বেগম খালেদা জিয়াকে পেয়ে যেভাবে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেছিলেন এবং বেগম জিয়ার প্রশংসা করে বক্তৃতা করেছেন তার সচিত্র খবর জাতি দেখেছে। ফলে দুই নেতাই ল-ন বৈঠকে পজেটিভ চেতনা নিয়েই মিলিত হবেন এমন প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের।

লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেছেন, লন্ডন বৈঠক হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতির নিয়ামক। তবে ওয়ান-টু-ওয়ান বৈঠক হতে হবে। দু’পক্ষেই কিছু চাটুকার রয়েছে যারা সব সময় নেতাদের বিপথগামী করার চেষ্টা করে। ড. ইউনূস ও তারেক রহমান একে অন্যকে ভাল চেনেন। ফলে তারেককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সাত/পাঁচ বুঝিয়ে যেমন ড. ইউনূসের গোল দেয়া সম্ভব নয়; তেমনি ড. ইউনূসও চাইবেন না দেশে ফের অস্থিরতা সৃষ্টি হোক। তবে আমার মনে হয় ড. ইউনূস নির্বাচনের পর সেফ এক্সিট পাওয়াটা নিশ্চিত করবেন বৈঠকে।

ড. ইউনূস-তারেক আলোচনা ফলপ্রসূ হবে অভিমত ব্যক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নুরুল আমিন বেপারি বলেন, ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা পাকিস্তান ভেঙেছিল। তবে নেতাদের জেদাজেদির কারণে উন্নয়নশীল বহু দেশে এমনকি আফ্রিকাতেও এমন দেশ ভাঙার ও শাসন ব্যবস্থা ভঙ্গুর হওয়ার বহু দৃষ্টান্ত আছে। তাই দেশের স্বার্থে সরকার ও বিএনপি উভয়পক্ষকেই আলোচনায় ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ধারণ করা উচিত। তারেক রহমানও শুভ চিন্তা করে আলোচনায় বসছেন। অ্যাডামেন্ট না হয়ে দুই পক্ষ নমনীয় হলে দেশ উপকৃত হবে।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৭ জুন থেকে শেষ ধাপের আলোচনায় আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। সেই বৈঠকে বিএনপিকেও নমনীয় দেখতে চায় সরকার। এছাড়া নির্বাচনের পর ড. ইউনূস যেমন সেফ এক্সিট নিশ্চিত করতে চাইতে পারেন; তেমিন তারেক রহমানের পক্ষ থেকে তার দেশে ফেরার বিষয়টিও তুলে ধরা হতে পারে। তারেক রহমান দেশে ফিরলে তার নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে দেখা হবে এমন নিশ্চয়তাও চাওয়া হতে পারে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে তারেক রহমান যে কোনো সময় বাংলাদেশে ফিরতে পারেন। যদিও গতকাল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিরাপত্তা দেয়ার ইংগিত দিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমান দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। আবার নির্বাচনের পর ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টাদের নিরাপদে চলে যাওয়ার নিশ্চয়তার বিষয় রয়েছে। নির্বাচনে টাইমফ্রেম সর্বাধিক গুরুত্ব পেলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রে বিএনপির নমনীয় দেখতে চাওয়ার ইস্যু থাকতে পারে।

এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনিস আলমগীর বলেন, লন্ডন বৈঠকে লেনদেন নিয়ে আলোচনা হবে। ড. ইউনূস সেফ এক্সিট নিশ্চয়তা নেবেন। কারণ ১০ মাসের মধ্যে ১১ বার বিদেশ গেছেন। নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যবসায়িক ও সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়েছেন। তার সঙ্গে যারা রয়েছেন অনেকেই হাসিনার অলিগার্কদের চেয়ে জঘন্য। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে।