সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দাখিল করা একাধিক আপিলের আরো শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আজ বুধবার। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল এদিন নির্ধারণ করেন।
গতকাল মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ দিন ঠিক করে দেয়। এদিন বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। এর আগে গত ২৭ আগস্ট রিভিউ আবেদনগুলোর প্রাথমিক শুনানি শেষে আপিলের অনুমতি দিয়ে আজকের তারিখ নির্ধারণ করেছিল আপিল বিভাগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৭ অগাস্ট আপিলের অনুমতি দিয়ে শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর দিন ঠিক করেছিল পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ।
পটভূমি : তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার উত্থান ও বিলুপ্তি
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই ব্যবস্থায় ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের তিনটি জাতীয় নির্বাচন তুলনামূলকভাবে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে ২০০৬ সালের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সেনাসমর্থিত জরুরি সরকারের দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর এই ব্যবস্থার অপব্যবহার ও প্রশাসনিক জটিলতা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে শুনানি শুরু করে। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষসহ বেশির ভাগ অ্যামিকাস কিউরি এমনকি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তবুও ২০১১ সালের ১০ মে প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ত্রয়োদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এরপর সরকার দ্রুত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে।
রিভিউ আবেদন ও নতুন আইনি মোড় : তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলুপ্তির পর এক দশক ধরে এ নিয়ে জনমত ও রাজনৈতিক বিতর্ক অব্যাহত ছিল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ২০২৪ সালে এ বিষয়ে একাধিক রিভিউ আবেদন দাখিল হয়। সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজউদ্দিন খান, জোবাইরুল হক ভূঁইয়া ও জাহরা রহমানের আবেদন ছাড়াও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন করেন।
এই চারটি আবেদন একসাথে শুনানি শেষে আপিল বিভাগ নতুন করে পূর্ণাঙ্গ আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত দেয়।
সাম্প্রতিক রায় ও রাজনৈতিক প্রভাব : গত ১৭ ডিসেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ ধারা বাতিল করে ঘোষণা দেয়। আদালতের এই রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সাংবিধানিক ভিত্তি পুনরুদ্ধারে পথ খুলে দেয় বলে মনে করা হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গতকালকের শুনানি কেবল একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়- এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ নির্বাচনকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার সঙ্কটই গত তিন দশকে বারবার রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ : গণতান্ত্রিক আস্থার পুনর্গঠনের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক ধরনের সাংবিধানিক সুরক্ষা বলয়। একে বাতিল করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যকার আস্থার ভিত্তিটাই ভেঙে দেয়া হয়েছিল। আদালত যদি এখন সেই প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ দেন, তা গণতান্ত্রিক আস্থার পুনর্গঠনের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ হবে।”
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমাদের দাবি হলো- নির্বাচন যেন দলীয় সরকারের অধীনে নয় বরং নিরপেক্ষ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে হয়। জনগণের ভোটাধিকার সুরক্ষার জন্য এটি অপরিহার্য।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, “আদালতের এই শুনানি শুধু আইনি নয় বরং একটি রাজনৈতিক পর্যালোচনার সুযোগও সৃষ্টি করছে। যদি আদালত তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বৈধতা স্বীকার করে, তবে ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন নতুন আকারে পরিকল্পিত হতে পারে।”
অন্য দিকে কিছু সাংবিধানিক বিশ্লেষক মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা বর্তমান সংবিধানিক কাঠামোতে নতুন বিতর্কও তৈরি করতে পারে। কারণ, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, সংসদের মেয়াদ ও প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস ছাড়া এ ব্যবস্থা কার্যকর করা কঠিন হবে। তবে নাগরিক সমাজের অনেকেই মনে করছেন- “তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন শুধু একটি সাংবিধানিক বিতর্ক নয়, বরং জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রতীক।”
গতকালের শুনানির ফলাফল তাই শুধু আদালতের রায় নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনী সংস্কৃতির দিকনির্দেশনাও নির্ধারণ করবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
আপনার মতামত লিখুন :