তিস্তা বাঁচানোর দাবিতে জেগে উঠলো সংহতির তরঙ্গ – ছবি সংগৃহীত
‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ লাখো মানুষের এমন স্লোগানে তিস্তার বুকে জেগে উঠেছে সংহতির তরঙ্গ ও আশার আলো। শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমিতে পরিণত হয় তিস্তা, আবার বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানির কারণে হয় বন্যা, শুরু হয় নদীভাঙ্গন। ফলে কৃষিকাজসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যহত হচ্ছে তিস্তা পাড়ের মানুষের। তাই তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পেতে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।
সোমবার রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার তিস্তা রেলওয়ে সেতু সংলগ্ন চর পয়েন্টে তিস্তা রক্ষা ও মহাপরিকল্পনা বাস্তাবায়নের দাবিতে সমাবেশ হয়। সমাবেশে যোগ দেয় এ অঞ্চলের সর্বস্তরের লাখো মানুষ। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে এদিন একই সাথে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ১১টি পয়েন্টে সমাবেশ, পদযাত্রা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করছে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি।’
টানা ৪৮ ঘণ্টার এ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সভাপতিত্ব করেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল হাবিব দুলু।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আজ সকাল থেকেই তিস্তা নদীর তীরে জমে উঠেছে মানুষের ঢল। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই!’- এই স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে রংপুরের তিস্তা ঘাট এলাকা। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দিতে হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছেন লালমনিরহাটের তিস্তা রেলসেতুর নিচে। এছাড়া আরো ১০টি আলাদা পয়েন্টে এ কর্মসূচি চলছে। তিস্তা চুক্তি ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলাজুড়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে।
অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের চোখে-মুখে ফুঁটে উঠেছে ক্ষোভ আর আশার এক অদ্ভুত মিশেল। একদিকে নদী মৃত্যুর প্রহর গুনছে, অন্যদিকে এরই মধ্যে জেগে উঠেছে জনতার অদম্য সংহতি।
তিস্তার চরে সমাবেশে আসা কুলাঘাট ইউনিয়নের বাসিন্দা কৃষক মো: আফসার আলী (৬০) বলেন, ‘নদী না থাকলে আমাদের জীবন নেই। একসময় এই নদীই ছিল আমাদের অন্নদাতা। দেখুন, এখন শুধু বালু আর পাথর। দুই ফসলি জমি এখন মরুভূমি। আবার যখন পানি আসে, বাড়ি-ঘর ছাড়তে হয়।’
তিস্তার তীর ঘেঁষে চলা সড়ক দিয়ে সামনে গেলেই চোখে পড়ে ভূতুড়ে দৃশ্য। পানিশূন্য খাল, ফাটল ধরা কৃষি জমি, নদীর বুকে জমে থাকা শেওলা। যেখানে নদীর পানি বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে পানির অভাবে নদীর মাঝেই হচ্ছে কৃষিকাজ। ধান, আলু, বাদামসহ কয়েক পদের সবজি চাষ হচ্ছে।
লালমনিরহাটের স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক মো: মজনু মিয়া বলেন, ‘নদীর সেই পূর্বের প্রবাহিকা ফিরে পেলে আমরা আবারো স্বপ্ন দেখব। আজকের এই জমায়েতই প্রমাণ করে- তিস্তা মরেনি, মরতে দেব না।’ তার কথায় যেন প্রতিধ্বনিত হয় হাজারো মানুষের আকুতি।
সোমবার বেলা ৩টার দিকে রংপুর জেলার তিস্তা রেলওয়ে সেতু সংলগ্ন চরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে এই কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘এখন বাঁচা-মরার নতুন লড়াই শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে বাংলাদেশকে বেঁচে দিয়েছে, কিন্তু তিস্তার এক ফোঁটা পানি আনতে পারেনি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের ৫৪টি নদী আছে, প্রত্যেকটিতেই তারা বাঁধ দিয়ে রেখেছে।’ উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, লড়াই না করে কিছু পাওয়া যায় না, লড়াই করে আমাদের অধিকার আদায় করবো, ন্যায্য পাওনা বুঝে নেবো।
তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির ব্যানারে লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার ১১টি পয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচি, সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হয়েছে। টানা ৪৮ ঘণ্টার এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন বিএনপি ও তার মিত্ররা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ৫ জেলার ১১টি পয়েন্টে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন বলে জানা গেছে।
অবস্থান কর্মসূচিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আজকের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে আমরা শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাব। মাওলানা ভাসানী যেমন তিস্তা রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন, বহুদিন পর আজ আমরা সেই আন্দোলন আবার শুরু করেছি।’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘ভারতকে আমরা বন্ধু হিসেবে দেখতে চাই, তবে ন্যায্য পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে। সীমান্তে আমাদের নাগরিককে গুলি করে হত্যা বন্ধ করতে হবে।’
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘বাংলায় কথা আছে, ঠেলার নাম বাবাজি। আজকের এই কর্মসূচি যখন ৬০ দিন আগে ঘোষণা করা হয়েছিল, এরপর গত কয়েক দিন আগে ভারত পানি ছাড়া শুরু করেছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে চাই, যদি তিস্তার ন্যায্য হিস্যা না দাও, তাহলে আমরা এককভাবে ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করব।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, শুকনো মৌসুমে ভারত উজানের পানি আটকে রাখে, আর বর্ষার মৌসুমে ছেড়ে দেয়। যার ফলে আমাদের এখানে বন্যায় সব ভেসে যায়। বাড়ি ঘর বিলীন হয়ে যায় নদী গর্ভে। এটা কি কোনো বন্ধুর পরিচয়? কোনোভাবেই না। তাই ভারত আমাদের বন্ধু না।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব, এখন সময় এসেছে ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলার। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের সরকারকে যেতে হবে। মাওলানা ভাষানীর মতো প্রয়োজন হলে আবারো আমরা লং মার্চের আয়োজন করব। এবার তিস্তার লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে, যদি এই জনপদের লোকদের বাঁচাতে চাই।
কর্মসূচি বাস্তবায়নে তিস্তার বুকে মঞ্চ তৈরি, খাবারের ব্যবস্থা ও তাবু টানিয়ে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থী, কৃষক, মৎস্যজীবী, পরিবেশকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যরা এক কাতারে শামিল হয়েছেন শুকিয়ে যাওয়া তিস্তাকে রক্ষার জন্য।
তিস্তা ব্রিজের পাশে তাবু টানানো এলাকায় কথা হয় ধরেশ চন্দ্র ও নরেশ চন্দ্র রায়ের সাথে। তারা দু’জনই বন্ধু এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। আন্দোলনে এসেছেন তিস্তা নদীকে বাঁচানোর দাবি নিয়ে। তারা বলেন, আমরা আমাদের তিস্তায়, আগের মতো ভরা পানি দেখতে চাই। ধুঁ ধুঁ বালুচর দেখতে চাই না। শৈশবের স্মৃতি মনে করে তারা বলেন, এই তিস্তায় কত নৌকা বাইচ খেলা হতো। এখন আর হয় না। পানি পাই না এ নদীতে। শুধু বর্ষাকালে পানির দেখা মেলে। চর পড়ে গেছে নদীতে। ভারত পানি ছাড়লে সেই স্রোতে বাড়ি-ঘর বিলীন হয়ে যায় তিস্তার গর্ভে। সারা বছর পানিহীন হয়ে থাকে এই নদী। তিস্তার এই অবস্থার জন্য ভারতকে দায়ী করেন এই দুই মুক্তিযোদ্ধা।
আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী বলেন, ১৫ বছর আগেই তিস্তার ভরা যৌবন ছিল। এখন মরার মতো অবস্থা। আমরা তিস্তায় পানি চাই। খনন চাই। তিনিও ভারতকে দায়ী করেন তিস্তার এই অবস্থার জন্য।
তিস্তা নদীর বুকে আজ শুধু ক্ষোভই নয়, জেগে উঠেছে আশার আলো। মানুষের চোখে-মুখে লড়াইয়ের দৃঢ়তা। তিস্তা নদী রক্ষার এই আন্দোলন শুধু একটি নদীর জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের প্রকৃতি, কৃষি ও মানুষের জীবিকার লড়াই। ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’- এই স্লোগান আজ হাজারো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে, যেন তিস্তা আবারো প্রাণ ফিরে পাবে এমন প্রত্যাশা তিস্তা পাড়ের মানুষগুলো।
আপনার মতামত লিখুন :