দখল, দূষণ, দীর্ঘদিন খনন না করা, অপরিকল্পিত নদী শাসনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রাচীন জেলা কুমিল্লার নদ-নদী। কোনটি দখলে ক্ষীণকায়, কচুরিপানা আর বর্জ্যরে দূষণে প্রবাহহীন মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদীর পানি ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। আবার কোনটি সীমানা হারিয়ে ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। আর কোনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর।
সময়ের পরিক্রমায় অবৈধ দখল ও প্রশাসনিক তদারকির অভাবে পরিচিত অনেক নদীই হারিয়ে গেছে কুমিল্লার বুক থেকে। সবমিলে গত ৪০ বছরে বিভিন্নভাবে কুমিল্লা জেলায় নদ-নদী দখল, দূষণে অস্তিত্ব বিলীনের কারণে হুমকির মুখে পরিবেশ-প্রকৃতি। অথচ নদী মাতৃক বাংলাদেশে নদীকে রক্ষার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই।
কুমিল্লা জেলার উল্লেখযোগ্য নদী বলতে গোমতী, মেঘনা, তিতাস আর ডাকাতিয়াকেই বুঝায়। তবে বড় আকারের এসব নদী ছাড়াও আরও বেশ কিছু ছোট নদ-নদী রয়েছে যা একসময় এখানকার গ্রামীণ জনপদ সমৃদ্ধ করেছিল।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লার বিবির বাজার সীমান্তে কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করে গোমতী নদী। এটি কুমিল্লা সদরের বিবিরবাজার থেকে বুড়িচং, বরকামতা, চান্দিনা, জাফরগঞ্জ, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ, মুরাদনগর ও দাউদকান্দি হয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়।
নদীটির বুড়িচং, দেবিদ্বার, কোম্পানীগঞ্জ ও মুরাদনগরে নদীর বাঁধের উপর বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। কয়েক হাজার ট্রাক্টর যোগে নদীর পাড়ের মাটি প্রতিনিয়ত কেটে নেয়ায় নদীর বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কোন কোন জায়গায় গোমতী নদীর জায়গা দখল হয়ে বাড়িঘর, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যায় অবৈধ এসব স্থাপনার বেশিরভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পানি সরে যাওয়ার পর ফের দখল শুরু হয়।
অপরদিকে কুমিল্লা শহরের উত্তর প্রান্তের কাপ্তানবাজার থেকে শুভপুর পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৫কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি পুরানো গোমতী নদী নামে ঐতিহ্য বহন করে আসছে। কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন দখল দূষণে ঢাকা পড়েছে। জেলা প্রশাসন নদীটি মাছ চাষের জন্য লীজ দিয়েই দায়িত্ব সেরেছেন, কিন্তু নদীর দুইপাড় দখলচিত্রে ঘর-বাড়ি নির্মাণ ছাড়াও দোকান-পাট করে ভাড়া দেয়ার বিষয়টিও চোখে পড়বে।
তিনযুগ ধরে দখলদারদের তালিকা করেও জেলা প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। একসময় নদীটির প্রস্থ প্রায় চারশ’ ফুট থাকলেও বর্তমানে নদীর দুই পাড়ের অধিকাংশ বাসিন্দা নিজেদের জায়গার বাইরে মাটি ভরাট করে নদী দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে ঐতিহ্যবাহী পুরানো গোমতীকে খালে পরিণত করেছে। নদীর পাড়ে ফেলা হচ্ছে ময়লা আবর্জনা, বিস্তীর্ণ নদীজুড়ে কচুরিপানা ভর্তি।
জেলার অন্যান্য নদীর মধ্যে দাউদকান্দির গৌরিপুর বাজার সংলগ্ন কালা ডুমুর নদীতে একসময় সারি সারি নৌকা দেখা যেতো। দখলদারদের কর্মকা-ে কালা ডুমুরে কলাগাছের ভেলা ভাসানোও কষ্টকর। কেননা, কালা ডুমুরের কোন কোন অংশে ভরাট হয়ে দোকানপাট, মার্কেট আবার কোথাও দুই পাড় ভরাটে ড্রেনে পরিণত হয়েছে।
কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলকে কৃষি সমৃদ্ধ এলাকায় পরিণত করার পেছনে বড় অবদান ডাকাতিয়া নদীর। লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ডাকাতিয়া নদীর লাকসাম উপজেলার দৌলতগঞ্জ বাজার এবং মনোহরগঞ্জ উপজেলার মনোহরগঞ্জ বাজার এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে বছরজুড়েই চলে ডাকাতিয়া নদী দখলের প্রতিযোগিতা। লাকসামে ডাকাতিয়ার দুইপাড় দখল হয়ে বসতি গড়ে উঠেছে। আবার পুরাতন ডাকাতিয়া নদীতে পলি জমে চর জেগেছে। অন্যদিকে মনোহরগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ঘাগুরিয়া নদীও দখল হয়ে যাচ্ছে।
লাকসামের ক্ষরস্রোতা ক্ষিরাই নদী। একসময় এ নদী পারাপারের জন্য ইঞ্জিন নৌকা ব্যবহার হতো। এখন ইঞ্জিনচালিত নৌবাহন চালানো যায় না। শুষ্ক মৌসুমে অনেকেই নদীতেই চাষাবাদ করে থাকেন। লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজার এবং চান্দিনা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত মৃত প্রায় ক্ষিরাই নদীর বর্তমান অবস্থা অপরিকল্পিত নদী শাসনের কারণেই হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
এছাড়াও নদীর দুইপাড় ও পানির অংশ দখল এবং অপরিকল্পিতভাবে ব্রীজ কালভার্ট নির্মাণ করায় নদীতে পলি জমে চর জেগেছে। তাতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নদীর গতিপথ। এছাড়াও চান্দিনার গোগরা খনন না করায় পলি জমেছে। মুরাদনগর উপজেলার আরচি ও নলিয়া নদীর প্রস্থ ড্রেনের আকার ধারণ করেছে। কোন কোন অংশে ফসলও দেখা যায় পানিবিহীন নদীতে। মধুকুপি ও চিতিগঙ্গা নদী হোমনা উপজেলাবাসীর কাছে পরিচিত নদী হলেও এ দু’টি নদীর অস্তিত্ব বিলীনের পথে। কারণ খনন নেই।
ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং এবং সদর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ৩০কিলোমিটার দীর্ঘ ঘুংঘুর নদীর ২০কিলোমিটারই দখল হয়ে গেছে। বাড়ি-ঘর, দোকানপাট আর আবাদি জমি গ্রাস করেছে এক সময়ের খরস্্েরাতা ঘুংঘুর নদীকে। রেকর্ড বইয়ে, মানচিত্রে ঘুংঘুর আছে কিন্তু বাস্তবে খুঁজে পাওয়াটা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে।
কুমিল্লা সদর ও বুড়িচং উপজেলার চার ইউনিয়ন রক্ষায় ৪২বছর আগে নদীটি খনন হয়েছিল। তারপর থেকে আর কখনো খনন হয়েছে কিনা নদী এলাকার লোকজন বলতে পারে না। এভাবে বছরের পর বছর বালি ও পলিতে নদীর তলদেশ ও দু’পাশ ভরাট হয়েছে। আর তখন থেকেই নদীর জায়গায় ঘর-বাড়ি ও ফসলের মাঠ গজে উঠেছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত কাকড়ী নদী পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। খননের উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আবার কাকড়ীর পাড় দখলের প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান ইনকিলাবকে জানান, ‘কুমিল্লার নদ-নদীগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হয়েছে, এগুলোর খনন, বাঁধ সংস্কার, সেচ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতির পর কুমিল্লা, নোয়াখালি, লক্ষ্মীপুর ও ফেনি জেলার পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বন্যা প্রতিরোধ ও সেচ নিষ্কাশন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আগে পূর্বশর্ত হলো সমীক্ষা। এটি করার জন্য ইতিমধ্যে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি পানি কমিশনে পাস হলে সমীক্ষার সুপারিশ হবে, এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমরা কাজ শুরু করব।
তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ হল নদীর খনন ও প্রবাহ ঠিক রাখা। পাউবোর অধিগ্রহণকৃত জায়গায় অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে আমরা জেলা প্রশাসনে পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পাওয়ার পর উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা যাবে। আমরা নদীর পাড়ের মাটি কাটার বিরুদ্ধে প্রায়ই ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশের সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করছি।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘চোখের সামনেই নদ-নদী দখল-দূষণের ঘটনা ঘটছে। জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা যদি মনোযোগের সাথে এসব নদ-নদী দখলের ঘটনা সরেজমিন দেখতেন তাহলে আরও দুই /তিন যুগ আগেই দখল-দূষণ মুক্ত থাকতো আমাদের এসব নদ-নদী।
একাজটি করা হয়নি বলেই দিন দিন দখলদারদের সংখ্যা বেড়েছে আর কমেছে নদ-নদীর সীমানা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের তো প্রশাসনিক, আইনগত ক্ষমতা নেই। যাদের আছে তাদের তো ভূমিকা রাখতে হবে। ভূমিকা রাখতে পারলেই কুমিল্লার নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব রক্ষা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :