দিন-রাত দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকে শত শত যান, হানিফ ফ্লাইওভার এখন যন্ত্রণার নাম


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২১, ২০২৪, ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ /
দিন-রাত দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকে শত শত যান, হানিফ ফ্লাইওভার এখন যন্ত্রণার নাম

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী হানিফ ফ্লাইওভার এখন এক যন্ত্রণার নাম। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ফ্লাইওভারের উপরে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে শত শত যান। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগে তিন ঘণ্টা। সময়ের অপচয় ও সীমাহীন ভোগান্তির সাথে টাকার অপচয় তো আছেই। ভুক্তভোগিদের মতে, ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা চলাচলের উপযোগী হলে অন্তত: টাকাটা সাশ্রয় হতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই অপশনও রাখেনি। বরং ইচ্ছে করে নিচের রাস্তা সংকুচিত করা হয়েছে। এক কথায়, বিভিন্ন যানকে ফ্লাইওভারে উঠতে বাধ্য করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হয়েছে।

রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৩০টি জেলার যাতায়াতব্যবস্থা সহজ করে তোলার জন্য ২০১৩ সালের অক্টোবরে চালু হয় মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। প্রায় সাড়ে ১১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ফ্লাইওভারটি শনিরআখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হয়ে চানখারপুল গিয়ে শেষ হয়েছে। শুরুর দিকে কেবল চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় জেলার মানুষ ফ্লাইওভারটি দিয়ে যাতায়াত করলেও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর খুলনা-বরিশালসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ফ্লাইওভারটি ব্যবহার শুরু করে। এতে করে ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপও বাড়তে শুরু করে।

ফ্লাইওভারের শনিরআখড়া প্রান্তে প্রবেশ মুখে কমপক্ষে তিনটি স্থানে বাস-লেগুনা থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা, টোল প্লাজায় দীর্ঘসময় ব্যয়, যত্রতত্র দোকান বসানো ও যানবাহন পার্কিং, ট্রাফিক আইন না মানা, ট্রাফিক পুলিশের নির্লিপ্ততা ও ফ্লাইওভারের নিচে সংকীর্ণ রাস্তার কারণে অসহনীয় যানজট তৈরি হচ্ছে হানিফ ফ্লাইওভারে। মাত্র ১০ মিনিটে যে পথ পাড়ি দেওয়ার কথা, সেটি পার হতে এখন সময় লাগছে প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এতে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়ছেন মানুষ। বিশেষ করে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ঢাকামুখি গাড়িগুলোতে পড়তে হচ্ছে ভয়াবহ যানজটে। এতে করে যাত্রীদের ভোগান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিন চারটি পয়েন্ট দিয়ে কয়েক হাজার ঢাকামুখী যানবাহন প্রবেশ করে এই ফ্লাইওভারে। এগুলো হলো, শনিরআখড়া, ডেমরা, সায়েদাবাদ ও ধোলাইপাড়। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জেলার পরিবহন, ব্যক্তিগত গাড়ি শনিরআখড়া পয়েন্ট দিয়ে হানিফ ফ্লাইওভারে প্রবেশ করে। সিলেট ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলার পরিবহন ও যাত্রীরা ডেমরা টোল প্লাজা দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। বরিশাল ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ধোলাইপাড় পয়েন্ট দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠে। এছাড়া সায়েদাবাদ থেকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অঞ্চলের গাড়ি এই ফ্লাইওভার ব্যবহার করে ওঠানামা করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, যে পরিমাণে যানবাহন হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠে সেগুলো বের হওয়ার চিত্র ভয়াবহ নাজুক! প্রতি মিনিটে এ ফ্লাইওভারে ১০০টির বেশি যানবাহন প্রবেশ করলেও বের হতে পারে না তার অর্ধেকও। এতে ধীরে ধীরে তৈরি হয় তীব্র যানজট। যেটা একসময় পুরো ফ্লাইওভারে ছড়িয়ে পড়ে। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেঁসে যেতে হয় সাধারণ যাত্রীদের।

হানিফ ফ্লাইওভারে সব সময় ঢাকামুখী অংশে যানজট লেগে থাকে। এর অন্যতম কারণ ফ্লাইওভার থেকে গাড়িগুলো বের হওয়ার প্রধান দুই পয়েন্ট-গুলিস্তান ও চানখারপুলের নাজুক চিত্র! মূলত এই দুটি টোল প্লাজা দিয়ে সাধারণ যাত্রীরা ঢাকায় প্রবেশ করেন। মাত্র দুই লেনের গুলিস্তান ও এক লেনের চানখারপুলের প্রবেশদ্বারে সব সময়ই যানবাহনের ‘জটলা’ লেগে থাকে। যে কারণে টোল প্লাজার সামনে এসে কচ্ছপের গতিতে এগোতে থাকে পরিবহনগুলো। যাত্রী ও বাসচালকরা মনে করছেন, ফ্লাইওভারে যানজটের পেছনে ট্রাফিক পুলিশেরও দায় রয়েছে।

ইতিহাস পরিবহনের এক চালক বলেন, আমরা টাকার বিনিময়ে ফ্লাইওভার ব্যবহার করি সময় বাঁচানোর জন্য। কিন্তু সময় তো বাঁচেই না, বরং যানজটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ যনে টাকা দিয়ে যন্ত্রণা কেনা। বন্ধন পরিবহনের চালক বলেন, ফ্লাইওভারে ওঠার সময় বাসগুলো কাজলা পয়েন্টে এলোপাথারি দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। একইভাবে গুলিস্তানেও ফ্লাইওভারের মুখে বাসগুলো এলাপাথারিভাবে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলে। ট্রাফিক পুলিশ এই সুযোগ না দিলে যানজট এত ভয়াবহ হতো না। ভুক্তভোগি যাত্রীদের অভিযোগ, গুলিস্তান, গোলাপবাগে গাড়িগুলো নামার পর ইচ্ছামতো টার্নিং নেয়। অনেকে ফ্লাইওভারের উপরেও যাত্রী ওঠানামা করায়। পুলিশও কিছু বলে না। তারা যদি ফ্লাইওভার থেকে গাড়ি নামার সঠিক ব্যবস্থা করে দিত, যানজট এক লম্বা হতো না।

ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তার অবস্থা খুবই নাজুক। দীর্ঘদিন রাস্তুাগুলো সংস্কার হয় না। যাত্রাবাড়ী মোড়ের কাছেই রয়েছে (ফ্লাইওভারের নিচে) তিনটি মিডিয়ান। একটি প্রস্থে ১৭ ফুট ও অন্য দুটি প্রায় ৯ ফুট করে। এর মধ্যে দুটি রাস্তা প্রস্থে ৯ থেকে ১০ ফুট। এসব রাস্তায় একটি বাস চললে সেটিকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই।

চালকরা জানান, নিচের রাস্তা দিয়ে চলা খুবই বিপদজনক। কারণ নিচে ট্রাফিক পুলিশ সক্রিয় থাকে না বললেই চলে। একবার সিগন্যালে গাড়ি আটকালে আধা ঘণ্টা ট্রাফিক পুলিশের আর খবর থাকে না। ভাবখানা এমন যেন, নিচের গাড়িগুলোর কোনো দাম নেই। ধূলাবালিতে যাত্রীদের নাকাল অবস্থাও পুলিশের চোখে পড়ে না। যাত্রীদের মতে, ফ্লাইওভারের উপরের যানজট ২/৩ ঘণ্টা পর হলেও নিরসন হয়। কিন্তু নিচের যানজটের কোনো নিশ্চয়তা নাই। সে কারণে নিচ দিয়ে চলাচল করা আরও ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ নিচের রাস্তাগুলো সংস্কার করলে এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সঠিক থাকলে এতটা যানজট হতো না।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে যে পরিমাণে গাড়ি এই ফ্লাইওভারে প্রবেশ করছে, সেগুলো বের হওয়ার সময় মাত্র এক লেন ব্যবহার করতে পারছে। মূলত এখানেই জ্যামটা তৈরি হচ্ছে। যানজট কমাতে চাইলে নিচের সড়কগুলোতে এখন বেশি নজর দিতে হবে। প্রথমেই ফ্লাইওভারের নিচের সড়কগুলো সংস্কার করতে হবে, যেন ফ্লাইওভারে গাড়ির চাপ কমে আসে। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে।