মুরাদনগরে গণপিটুনিতে নিহত ৩ জন
দেশকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন স্থানে ঘটানো হচ্ছে নানা ঘটনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন এসব ঘটনার পিছনে পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রভু ভারতের হাত রয়েছে। তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদে দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরীর ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এবং কোথাও বা পুলিশের সহায়তায় ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাচ্ছে। যা দেশের ভবিষতের জন্য অশনিসঙ্কেত। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে পতিত আওয়ামী লীগ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ভারত এ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য নানান ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ভারতের সহায়তায় একেক সময় এককটা এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নামছে। বর্তমানে হত্যা-ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত করে দেশের পরিস্থিতি অস্থির করার চক্রান্ত চলছে। এটা শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সময় মতো আগামী নির্বাচন আয়োজন অনিশ্চিত হতে পারে। পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সারা দেশে ঘাপটি মেরে থেকে নানা ইস্যু নিয়ে কাজ করছে।
গত ৫ আগস্ট হাসিনার দেশ ছাড়ার পর, আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী রাতারাতি তাদের ভোল পাল্টে সাধু সেজে মাঠে নেমেছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা নেতা বা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থির করার চেষ্টা করছে। শুরুতে সংখ্যা লঘু নির্যাতন ইস্যু নিয়ে ভারতের সহায়তায় দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর আনসার বিদ্রোহ, সচিবালয়ে অস্থিরতা, পুলিশ বিদ্রোহ, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার দাবি নিয়ে রাজপথ অবরোধসহ আরো নানা ইস্যু নিয়ে এ সরকারকে ব্যর্থ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ভারতের সহায়তায় সবচেয়ে বেশি চলছে এ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ভারতীয় মিডিয়ায় এ সরকারের বিরুদ্ধে চলছে ব্যাপক অপপ্রচার। সেই সাথে সোশ্যাল মিডিয়াতেও চলছে অপতথ্যের প্রচার। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার ভিডিও বার্তাও সুকৌশলে ছড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুঃখ করে বলেছেন, ভারতীয় মিডিয়ার পাশাপাশি দেশের মূল ধারার কিছু পত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই অপপ্রচার মোকাবেলা করার জন্য সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন বিভিন্ন দলের সাথে মিশে দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চক্রান্ত করছে। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় ধর্ষণ ও হত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনায় পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। স্থানীয়দের অনেকের বক্তব্য এখানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া নিজের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। আর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরাও তার ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সেই সাথে পুলিশ প্রশাসনও উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে খুশি করতে তাদের সহায়তা করছে। যে কারণে এখানে একের পর এক নানান ঘটনা ঘটছে।
গত ২৬ জুন রাতে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পাঁচকিত্তা গ্রামে প্রবাসীর স্ত্রীকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও মারধরের ঘটনা ঘটে। এই ভয়ঙ্কর ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতে দেশের আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হয়েছে এমন সমালোচনাও শুরু হয়। এই ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যখন সারাদেশে চলছে সমালোচনার ঝড় ঠিক তখনই গতকাল কুমিল্লার মুরাদনগরের বাঙ্গুরা বাজার এলাকায় মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এক মা ও তার ছেলে-মেয়েকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন ওই নারীর আরেক মেয়ে।
আমাদের কুমিল্লা জেলা সংবাদদাতা সাদিক মামুন জানান, বর্তমান সময়ে কুমিল্লার আলোচিত উপজেলা মুরাদনগরে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যা স্থানীয় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করেছে। এর মধ্যে পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যু, ধর্ষণ, আইন হাতে তুলে নিয়ে একটি পরিবারের মা ও তার দুই সন্তানকে পিটিয়ে-কুপিয়ে মেরে ফেলা, পাড়ায় পাড়ায় মারামারি এবং কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব উল্লেখযোগ্য। আইন শৃঙ্খলার অবনতির সুযোগে মুরাদনগরের সাধারণ মানুষের কাছে কিশোর গ্যাংয়ের উপদ্রব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এই সমস্যা এখনো বিদ্যমান। এই গ্যাংগুলোর কার্যকলাপের কারণে এলাকার সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মুরাদনগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে পারেনি প্রশাসন।
এদিকে গত ১৫দিনের ব্যবধানে মুরাদনগরে পুলিশের হেফাজতে থানা হাজতে বিএনপি কর্মীর মৃত্যু, এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ ও বিবস্ত্র করে নিপীড়নের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া এবং আলোচিত এই ঘটনার রেশ না কাটতেই মাত্র সাতদিনের মাথায় মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে একটি পরিবারে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। মাসহ তিন সন্তানকে কুপিয়ে-পিটিয়ে রক্তাক্ত করে তাদের প্রাণ কেড়ে নিল স্থানীয়রা। আরেক সন্তান মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। গতকাল সকালে মুরাদনগরের বাঙ্গরা বাজার থানাধীন করইবাড়ী গ্রামে জনৈক খলিলুর রহমানের বাড়ি ঘেরাও করে ভাংচুর ও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে তার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৩), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তারকে (২৫) পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে সংঘবদ্ধ স্থানীয় লোকজন।
এ ছাড়া গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছেন রোকসানার আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (৩০)। সে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। এলাকায় মাদক বেচাকেনার অভিযোগে স্থানীয় লোকজন ওই পরিবারের ওপর হামলা চালায়। এঘটনার বিষয়ে বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেছেন, ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, এভাবে পিটিয়ে-কুপিয়ে মেরে ফেলার পেছনে অন্য কোন কারণ রয়েছে কিনা। অপরদিকে কুমিল্লার পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খাঁন ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানান, কেউ অপরাধ করলে তাকে ধরে পুলিশকে খবর দিতে হয়, না হয় থানায় সোপর্দ করতে হয়। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। গণপিটুনির নামে যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এটি অপরাধ, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
মুরাদনগর এলাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ইনকিলাবকে বলেন, মুরাদনগর এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন এ জন্য কে বা কারা দায়ী। এলাকার মানুষ অভিযোগে বলছেন, বর্তমান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া তার নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছেন। এ ছাড়া জেলার পুলিশ সুপার, থানার ওসিসহ সবাই তাকে খুশি করার জন্য কাজ করছে। তারা এ এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে উপদেষ্টার মন খুশি করায় ব্যস্ত।
এ দিকে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় গত ৩০ জুন ঘরে স্বামীকে রাতভর নির্যাতনের পর তাঁর স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় শ্রমিক দল ও যুব দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্ররা চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় ভাংচুরের পর সে থানার ওসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি মেনে চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু জায়েদ মো. নাজমুন নুরকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। বুধবার রাতে চট্টগ্রামের ডিআইজি আহসান হাবীব পলাশ এ আদেশ দিয়েছেন।
এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের নেতারা। নগরীর ষোলশহরে তিন সংগঠনের আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক জুবাইর হাসান এ ঘোষণা দেন। এই দাবিতে সন্ধ্যায় ষোলশহর থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। পটিয়ার ওসির অপসারণের দাবিসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, পুলিশের মধ্যে চলমান অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও জনভোগান্তি দূর করতে দ্রæত সংস্কার প্রয়োজন। ওসি জায়েদ নূরকে অপসারণ না করে রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। এটি তো আমাদের দাবি ছিল না। আমাদের দাবি ছিল তাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনা। এর আগে গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় পটিয়ার শহীদ মিনারের সামনে থেকে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা। থানায় নিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে মামলা না থাকায় পুলিশ গ্রেফতার করেনি। এ নিয়ে পুলিশ ও নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাগ্বিতন্ডা হয়। পরে রাতেই দুই পক্ষের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের ১৯ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করে উভয় পক্ষ।
আপনার মতামত লিখুন :