দ্রব্যমূল্য সহনীয়, স্থিতিশীল, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই বাজারদর


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মার্চ ৮, ২০২৫, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ /
দ্রব্যমূল্য সহনীয়, স্থিতিশীল, ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই বাজারদর
  • না-গরম না-ঠাণ্ডা সহনীয় আবহাওয়ায় রোজাদারদের প্রশান্তি ‘রমজানে দ্রব্যমূল্য কমেছে এটা সুখবর’ :অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সিকান্দার খান :: ‘মূল্যস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্য আরো কমবে’ :অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম

পঞ্জিকার পাতায় ফাল্গুন চলছে। এরপর চৈত্র মাস। এখন বসন্তকাল। মার্চ মাসজুড়ে এবার মাহে রমজান। আবহাওয়ায় বৈরিতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা কিংবা চরম-ভাবাপন্ন অবস্থা নেই। বরং না-গরম না-ঠাণ্ডা সহনীয় আবহাওয়ায় রোজাদারদের মাঝে প্রশান্তি বিরাজ করছে। দিনের বেলায় গরম থাকলেও তা দেশের কোথাও এখন পর্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠেনি।

ইফতারের আগেই সূর্যাস্তকাল থেকে শুরু করে তারাবীহ নামাজ, শেষরাতে সাহরী ও ইবাদত-বান্দেগীতে রাতের পুরো সময়জুড়ে ঝিরিঝিরি সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনা ও ইবাদত পালনের উপযোগী স্বাভাবিক ও অনুকূল আবহাওয়া বজায় রয়েছে। রমজানের প্রথম সাত দিনে রোজা পালনে অভ্যস্থ হয়ে গেলেই পুরো মাসে যে কোন ধরনের আবহাওয়ায় মানুষের শারীরিক সহ্যক্ষমতা গড়ে ওঠে। মাসব্যাপী রোজা পালন হয় আরো সহজতর। আজ শনিবার রমজানের প্রথম সপ্তাহ অতিবাহিত হচ্ছে।

আবহাওয়া বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে প্রায় সারা দেশে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে থাকছে এবং রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্থানভেদে ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অবস্থান করছে। যা সহনীয় আবহাওয়ার পরিচায়ক। আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাসে জানা গেছে, আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত রাত ও দিনের তাপমাত্রার সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া ব্যাপক কোন হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এ মাসের শেষের দিকে দেশের পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। এমাসের শেষ দিকে মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্ত বৃষ্টিপাত, কোথাও কোথাও বজ্রবৃষ্টি কিংবা কালবৈশাখীর সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির ধারায় স্নাত আবহাওয়া হয়ে উঠতে পারে শীতলতর, রোজাদারদের জন্য প্রশান্তিদায়ক।

এদিকে অতীতের তুলনায় এবার রমজানের শুরু থেকে এ যাবত দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা সন্তোষজনক। এ ক্ষেত্রে মানুষের তেমন ভোগান্তি আপাতত নেই।

দ্রব্যমূল্যও সহনীয়, স্থিতিশীল : এবারের পবিত্র রমজান মাসে শুধুই ভোজ্যতেল ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সবধরনের খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় এবং স্থিতিশীল রয়েছে। কাঁচা মরিচ, বেগুন, পেঁয়াজ থেকে শুরু করে ছোলা, চিনিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি ও খাদ্যপণ্যের মূল্য ফ্যাসিস্ট হাসিনা আমলের বিশেষ করে গত দুই বছরের রমজান মাসের তুলনায় যথেষ্ট কমেছে। যদিও গত ৬ মাসে মূল্যস্ফীতি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে কিছু কিছু নিত্যপণ্যের আমদানি-মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব তেমন পড়েনি।

বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাহরী ও ইফতারের জন্য প্রয়োজনীয় এমন সবধরনের নিত্যপণ্যে ঠাসা রয়েছে বাজার। রোজার আগে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে চিনি, ছোলা, ডাল, ভোজ্যতেল, খেজুরসহ রমজানে সর্বাধিক চাহিদার নিত্য ও ভোগ্যপণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি এবং খালাস হয়। রোজায় চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত আমদানি হয় কোন কোন পণ্য। এই সুবাদে পাইকারি ও খুচরা বাজারে এসব নিত্যপণ্যের সরবরাহ রয়েছে প্রচুর। কোথাও কোন পণ্যের ঘাটতি বা কমতি নেই। নেই মজুতদারির দাপট। সেই সাথে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ফলে রমজানে ক্রেতা সাধারণের সাধ্যের মধ্যে অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রয়েছে বাজারদর। সারা দেশেই বাজার পরিস্থিতি সন্তোষজনক।

রমজানের আগে থেকেই ভোজ্যতেল তথা সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায়ে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়। তবে সরকারি প্রশাসনের বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি নিয়ন্ত্রণের ফলে গত কয়েকদিন যাবত খোলা সয়াবিন তেল ছাড়াও সীমিতভাবে হলেও বোতলজাত তেল মিলছে প্রায় সর্বত্র। দেশের প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে খোলা সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য লিটার ১৬০ টাকায় বেঁধে দিয়েছে প্রশাসন। বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়।

অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ বিশেষ করে বাজারে সিন্ডিকেটের উত্থানরোধ, মজুতদারি রোধ, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত বাজার মনিটরিং, জনস্বার্থে রমজানে অধিক চাহিদার খাদ্যপণ্য ও ভোগ্যপণ্যের ওপর শুল্ক-কর প্রত্যাহার কিংবা হ্রাস, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ঘন ঘন অভিযান পরিচালনার ফলে এবং অনুকূল আবহাওয়ায় আলুসহ সবরকম শাক-সবজির বাম্পার ফলনের সুবাদে বাজারদর স্থিতিশীল, সহনীয় রয়েছে। এখন সাধারণ ক্রেতারা বাজারে গিয়ে স্বস্তিবোধ করছেন।

এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্য প্রসঙ্গে প্রবীণ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইস্ট-ডেল্টা ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণ মানুষের কথা মনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের মূল্য জনসাধারণের নাগালের মধ্যে থাকাটা অপরিহার্য। এটা সরকারের করণীয় এবং দায়িত্ব। এবার রমজানে দ্রব্যমূল্য অনেকক্ষেত্রে কমেছে এটা অবশ্যই সুখবর। বাজারে ভোজ্যতেলসহ সবধরনের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার সফলকাম হবে এটাই আশা করি।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এবার রমজানে দ্রব্যমূল্য তেমন বৃদ্ধি পায়নি। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট চেষ্টা করছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অবস্থা, গতি-প্রকৃতি তেমন খারাপ নয়। সরকার মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আগামী মাস দুয়েকের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে আশা করি। তখন দ্রব্যমূল্য আরও কমবে। প্রসঙ্গত গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নেমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দেওয়া হালনাগাদ হিসাব অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।

ফ্যাসিস্ট আমলের তুলনায় বাজারে সুবাতাস : ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বিশেষত ২০২৩ ও ২০২৪ সালের রমজান মাসে ছিল দ্রব্যমূল্যে আগুন। প্রতিটি খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে চলে। তখন লাগামহীন বাজারে কাঁচা মরিচের দাম শুধুই সেঞ্চুরিতে শেষ হয়নি; এমনকি কেজি ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল। ছোলার কেজি ছিল ১৭৫ থেকে ২১০ টাকা, চিনি ১৭৫ টাকা, বেগুন বিক্রি হয় কেজি একশ’ থেকে ১২০ টাকায়, শসার কেজি ছিল একশ’ থেকে ১২০ টাকায়, লেবু প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ টাকা, পেঁয়াজের কেজি দেড়শ’ থেকে দু’শ টাকা! তাছাড়া আকাশছোঁয়া মূল্য ছিল চাল, ডাল, খেজুর, ডিম, দুধ, মাছ, গোশত, মুরগি, শাক-সবজিসহ প্রতিটি খাদ্যপণ্যের।

চলতি বাজারদর পরিস্থিতির খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, এবার রোজার আগে ও শুরু থেকে সেই কাঁচা মরিচের কেজি স্থানভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, বেগুন কেজি ৪০ থেকে ৭০ টাকা, শসা কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, লেবু প্রতিটি ৮ থেকে ১৫ টাকা, পেঁয়াজের কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ছোলার কেজি ১০৫ থেকে ১১০ টাকা, চিনি ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখনও হরেক রকম শীতকালীন শাক-সবজিতে বাজার ভরপুর। সবজির মূল্য সীমিত রয়েছে কেজি ২০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। হাসিনার আমলে শাক-সবজিও ছিল সাধারণ নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।

হাসিনার শাসনকালে অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের বেপরোয়া সিন্ডিকেটবাজি, আওয়ামী ক্যাডারদের সর্বত্র লাগামহীন চাঁদাবাজির কারণে প্রত্যেকটি রমজান মাসেই দ্রব্যমূল্যে ছিল অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি। এ অবস্থায় অসহায় সাধারণ ক্রেতাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ আর হা-পিত্যেশ করা ছাড়া আর কোন উপায়ই ছিলনা। তবে মাহে রমজানে বাজারের সুবাতাসে এবার ভিন্ন চিত্র।

রোজার বাজারে আমদানি খেজুরের সরবরাহ প্রচুর। বিকিকনি হচ্ছে মান ও স্থানভেদে প্রতিকেজি ২শ’ থেকে ৮শ’ টাকায়। চিড়া কেজি ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, মসুর ডাল (মোটা) কেজি ১১০ টাকা ও সরু ১৩০ টাকা, ছোলার ডাল কেজি ১১০ থেকে ১২০ টাকা, খেসারি ডাল কেজি ১১০ টাকা, ডিমের হালি ৪০ থেকে ৪৪ টাকা, লেবু প্রতি হালি ৩২ থেকে ৬০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, দেশী মুরগি কেজি ৪৫০ থেকে ৫শ’ টাকা, গরুর গোশত স্থানভেদে কেজি ৮শ’ থেকে ৯শ’ টাকা, খাসি ৯৫০ থেকে ১১শ’ টাকা, রুই-কাতলা মাছ কেজি ৩৬০ থেকে ৪শ’ টাকা, তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস কেজি ২শ’ থেকে ২৩০ টাকা, চিংড়ি মাঝারি কেজি ৬শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। আলু স্থানভেদে কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা, টমেটোর কেজি ১৫ থেকে ২৫ টাকা। শাকের আঁটি ১৫ থেকে ২৫ টাকা। বাজারে বিভিন্ন ধরনের তরতাজা সবজি কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যেই মিলছে।