নজরুলের কবিতা নিপীড়িত মানুষের শাশ্বত কণ্ঠস্বর!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ২, ২০২৫, ৭:২৩ পূর্বাহ্ণ /
নজরুলের কবিতা নিপীড়িত মানুষের শাশ্বত কণ্ঠস্বর!

নজরুলের কবিতার বিষয়বস্তু কি? এর জবাব হয়তো এককথায় দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কেউ যদি উত্তরটি এককথায় পেতে দাবি করেন, তবে কি হবে সেই উত্তর? ছোট করে উত্তরটি হবে- নজরুল কবিতার বিষয়বস্তু মানুষ! হ্যা, মানুষ।

নজরুলের কবিতার বিষয়বস্তু কি? এর জবাব হয়তো এককথায় দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কেউ যদি উত্তরটি এককথায় পেতে দাবি করেন, তবে কি হবে সেই উত্তর? ছোট করে উত্তরটি হবে- নজরুল কবিতার বিষয়বস্তু মানুষ! হ্যা, মানুষ। নজরুল কবিতার মৌলিক বিষয়- মানুষ। মানুষ নিয়েই নজরুলের যত মহত্তম উচ্চারণ। যত উচ্চতর বর্ণনা। যত গৌরবান্বিত বয়ান। যত সম্মানিত উপমা।

এর অর্থ মানুষ ছাড়া আর কোনো বিষয়ে লেখেননি নজরুল, এমনটি মোটেও নয়। এর অর্থ হলো- নজরুলের অধিকাংশ কবিতারই কেন্দ্রীয় বিষয় মানুষ। মানুষ নিয়েই নজরুলের পৃথিবী। মানুষ নিয়েই নজরুল-কবিতার বিস্তার।

এখন প্রশ্ন হলো- নজরুল কবিতার সেই মানুষ কারা? তারা কি জগতের সকল মানুষ! অথবা সুশীল সমাজের মানুষ! কিংবা ক্ষমতাবান ধনাঢ্য মানুষ! না, মোটেই তেমনটি নয়। তবে

কাদের নিয়ে লিখেছেন তিনি? কাদের ঠাঁই দিয়েছেন তাঁর কবিতায়? কাদের কথা বলেছেন তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষায়! কাদের স্বপ্ন সাধ নিয়ে রচেছেন কবিতার শরীর! এখানেও এককথায় জবাব দিলে বলতে হয়- অধিকার বঞ্চিত মানুষেরাই নজরুল কবিতার বিষয়বস্তু।

প্রথমত নজরুল মানুষের সম্মান মর্যাদা এবং গৌরবের কথা বলেছেন। এসব বিষয়ের মধ্যে বড় করে তুলেছেন স্বাধীনতার প্রসঙ্গ। এই স্বাধীনতা ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক। জাতির এবং রাষ্ট্রের। জাতির স্বাধীনতা নজরুলের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। জাতির স্বাধীনতার সাথে জড়িত ব্যক্তির স্বাধীনতা। সমাজের স্বাধীনতা। একইসাথে অধিকারের স্বাধীনতা। অধিকারের মধ্যেও রয়েছে ব্যক্তিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, ন্যায় বিচার ও ইনসাফের অধিকার। এবং মানুষ হিসেবে সমাজে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার।

তবে মোটা দাগে যদি বলতে হয়- নজরুল কবিতায় ছড়িয়ে আছে নিপীড়িত মানুষের আত্মস্বর। দুঃখী মানুষের কান্না। ব্যথিত মানুষের হাহাকার। অসহায় মজলুম মানুষের আহাজারি। অনাহারী মানুষের কাতরতা।

সমাজে অবহেলিত জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খা ও স্বপ্নের রঙ ছিটানো নজরুল কবিতায়। নজরুলের কবিতায় মিশে আছে বঞ্চিত জীবনের গন্ধ। এমন জীবন, যে জীবন দুঃখ কষ্টের, বেদনার। যে জীবন অবহেলিত, শোষিতের।

যে জীবন মানবেতর, এমন মানবেতর জীবনের গভীর অনুভূতির প্রকাশ আছে তাঁর কবিতায়।

তাঁর কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে এমনসব অসহায় মানুষের জীবনযুদ্ধের শ্রম ঘাম এবং নুনের উত্তাপে। সমাজে যাদের মর্যাদা নেই, সম্মান নেই, নেই এতটুকু মূল্যায়ন, তাদের কথা উচ্চকণ্ঠে বলেছেন তিনি।

‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার কটি পঙক্তি পাঠ- করা যাক,

‘ক্ষুধিত শিশু চায় না স্ব-রাজ/ চায় দুটো ভাত একটু নুন/ বেলা বয়ে যায় / খায়নিকো বাছা/ কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।’ ইস! কী বেদনার্ত অনুভূতির স্পষ্ট প্রকাশ। একটি গরীব পরিবারের সদস্যরা যখন ক্ষুধার্ত, তাদের কাছে পৃথিবীর কোনো সুন্দর আয়োজনই খাদ্যের চেয়ে সুন্দর নয়! জগতের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই তাদের আহারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কে রাজা, কে মহারাজা, কে প্রেসিডেন্ট কে প্রধানমন্ত্রী এসব ভাবনা একজন ক্ষুধার্তের কাছে নস্যি।

আমার ‘কৈফিয়ত’ কবিতার শেষাংশ পাঠ করি- ‘বন্ধু গো আর বলিতে পারি না / বড় বিষ জ্বালা এই বুকে / দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি/ তাই যাহা আসে কই মুখে।/ রক্ত ঝরাতে পারি নাকো একা/ তাই লিখে যাই এই রক্ত লেখা। / বড় কথা, বড় ভাব/ আসে নাকো বন্ধু/ বড় দুখে/ অমর কাব্য লিখিও বন্ধু / তোমরা যাহারা আছো সুখে/…প্রার্থনা করো/ যারা কেড়ে খায় / তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেনো লেখা হয়/ আমার রক্তলেখায়/ তাদের সর্বনাশ!/ তাদের সর্বনাশ!’

এখানেও নজরুল অগ্নি উদগীরণ করেছেন বঞ্চিত মানুষের পক্ষে। একইভাবে জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে কামনা করেছেন সর্বনাশ।

পৃথিবীতে মোটা দাগে মানুষ দুই শ্রেণির- শাসক এবং শাসিত। সংখ্যায় শাসক নেহায়েতই কম। কিন্তু শাসিত? অগুনতি, সীমাহীন।

এই সীমাহীন শাসিত মানুষগুলোই নানাভাবে নিষ্পেষিত, অবহেলিত এবং অত্যাচারিত। সমাজে রাষ্ট্রে এ মানুষগুলো নিগ্রহের শিকার। নাগরিক এবং মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। সত্যিকার স্বাধীনতার আনন্দ নেই যাদের জীবনে। যারা কোনোরকম বেঁচে থাকার তাগিদে অমানুষিক পরিশ্রম করে। সামাজিক এবং নাগরিক কোনো মর্যাদা নেই এসকল মানুষের।

খুব সহজেই শাসিত হয় এরা। ক্ষমতাবানেরা শোষণ করে এদের। হয়তো কখনও কখনও এদের একটি অংশ বোঝে এসব বঞ্চনার রূপ। কিন্তু অধিকাংশই বোঝেই না এরা শোষিত কিংবা জুলুমের শিকার! এরা সমাজের গরীব শ্রেণি। শিক্ষাদীক্ষা নেই। সভ্যতা ভব্যতায় পিছিয়ে। অর্থ বিত্তে দুর্বল। কারো কারো দিন এনে দিন খাওয়া।

নজরুল এমন লাঞ্চিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দুর্বিষহ জীবনের চিত্র এঁকেছেন তাঁর কবিতা ও গানে। নজরুলের মতে- সম্পদশালীদের সম্পদে এই গীরব দুখীদের হিস্যা আছে। এইযে হিস্যা আছে, এটিও বোঝে না এই অসহায় মানুষগুলো। অবশ্য বুঝেও লাভ নেই খুব। কে দেবে এদের সেই ন্যায্য অধিকার! সমাজের শক্তিশালীরা তো অধিকার কেড়ে নিতেই ব্যস্ত!

ইনসাফহীন সমাজে শক্তির জয়জয়কার। ক্ষমতাই এখানে সকল বিচারের বড় পতি। এমন অবহেলিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন নজরুল। না, তাঁর সব কবিতার কথা বলছি না। সব কবিতাই দুঃখী মানুষের জীবন নিয়ে রচিত নয়। সব কবিতা নয় অসহায় মানুষের জীবন-ঘানির রঙ।

কিন্তু সত্যি তো এটিই – নজরুলের কবিতা রূপায়িত হয়েছে মানুষের জীবন নিয়ে। মানব জীবনই নজরুলের কবিতার মুখ্য কেন্দ্র।

‘বিদ্রোহী’ নজরুলের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা। বিদ্রোহীর কবিতার গোটা অঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন। বীরত্বের জীবন। কিন্তু সেই বীরত্ব মানুষের- এতে কোনো ভুল নেই। আকাশ থেকে পাতাল অব্দি উত্থান পতনের যত উপমা উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্প সবই মানব জীবন ঘিরে।

কিন্তু বিদ্রোহী নামের এ বিখ্যাত দীর্ঘ কবিতার সারাংশ কি? এ প্রশ্নের জবাব মাথায় রেখে যদি আমরা পাঠ করি কবিতাটি, এ জিজ্ঞাসার জবাবটি পেয়ে যাবো কবিতার একেবারে শেষাংশে। যখন শেষ অংশটি পাঠ করবেন, নিশ্চিত বুঝবেন, এটিই কবিতার সারাংশ। এটিই কবিতাটির মূলকথা। তাহলে পাঠ করা যাক কবিতার শেষ অংশটি- ‘বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত / আমি সেই দিন হবো শান্ত / যবে উৎপিড়ীতের ক্রন্দন রোল/ আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না / অত্যাচারির খড়গ কৃপাণ /ভীম রণভূমে রণিবে না /… আমি বিদ্রোহী বীর/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা / চির উন্নত শির।’

কবিতার এ অংশে নজরুলের বিপ্লবী কণ্ঠ উচ্চকিত হয়েছে কেবলমাত্র নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। ধ্বনিত হয়েছে বঞ্চিত অত্যাচারিত এবং শোষিত মানুষের পক্ষে। এ বক্তব্যটি বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এখানে কোনো ঘোরপেঁচ নেই। কোনো লুকানো চুবানো নেই। কোনো সুযোগ বা সুবিধার আড়াল নেই। নেই কোনো রহস্যময় উচ্চারণ। বরং খুল্লাম খোলা দৃঢতা। সোজাসাপ্টা বক্তব্য। যা বিশ্ব মানবতার নিপীড়িত জনগণের মনের উচ্চারণ।

বিদ্রোহী কবিতাটি যতবার পাঠ করি, ততবারই মনে হয়- মানবজীবনের পক্ষে এত শক্তিশালী উচ্চারণ খুব কমই আছে। দীর্ঘ এ কবিতায় মানব জীবনের অতি উঁচু মর্যাদার দৃশ্যপট চিত্রিত হয়েছে।

মানুষ, বিশ্ব সৃষ্টির বিস্ময়! সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের তকমা কেবলই মানুষের। কিন্তু সব মানুষের? না, সব মানুষের নয়। তবে কারা সেই মানুষ! তার আগে প্রশ্ন করতে হয়- মানুষরূপী সবাই কি মানুষ! এর জবাব নিশ্চয়-না। অর্থাৎ সব মানুষ মানুষ নয়! কারণ? মানুষকে মানুষ হতে হয়। মানুষ মানুষ না হলে সে পশুর চেয়েও অধম! চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। সুতরাং মানুষরূপী সব মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব নয়। বরং তারাই কেবল শ্রেষ্ঠ, যারা মানুষ হিসেবে সত্যিকার মানুষ।

যারা মানুষরূপী, কিন্তু মানুষ নয়, তাদের লক্ষ্য করে নজরুল কি লিখেছেন? তিনি লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা বা কোনো কোনো কবিতার অংশ বিশেষ। তাঁর একটি কবিতার নাম-

‘বিশ্বাস ও আশা’, এ কবিতার দুটি পঙক্তি পাঠ করি তবে- ‘ এরা জড়, এরা ব্যাধিগ্রস্ত,/মিশো না এদের সাথে,/ মৃত্যুর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এরা দুনিয়াত।/ এদের ভিতরে ব্যাধি, ইহাদের দশদিক তমোময়/ চোখ বুঁজে থাকে, আলো দেখিয়াও বলে,/ ইহা আলো নয়।’ অর্থাৎ যারা আলো দেখেও আলোকে অস্বীকার করে, তারা আর যা-ই হোক মানুষ হতে পারে না। আলো অর্থ কি? আলো অর্থ শুধু আলো নয়। আলো অর্থ সত্য। যারা জেনেশুনে সত্যকে দেখেও অস্বীকার করে তারা আর যা-ই হোক মানুষ হতে পারে না।

হয়তো প্রশ্ন হতে পারে- কেনো? জবাবটিও কঠিন নয়! কারণ, এ মানুষটি বিবেকহীন, এ মানুষটি মিথ্যার ধ্বজাধারী। এরা সত্যের আলো ছেড়ে মিথ্যার অন্ধকারে ডুবে থাকে। সুতরাং মানুষরূপী এমনদের সত্যি কি মানুষ বলা যায়! না যায় না।

দুঃখের বিষয়- এমন মানুষেই ঠাসা আমাদের সমাজ। সমাজের চতুর্দিকে এমন লোকেরাই ছড়ানো। এদের ভারে নত সমাজ। ন্যুজ হয়ে আছে সমাজের পিঠ।

পাঠ করা যাক নজরুলের ‘আজাদ’ কবিতাংশ- যে দিকে তাকাই দেখি যে কেবল অন্ধ বদ্ধ জীব/ ভোগোন্মক্ত পঙ্গু খঞ্জ আতুর বদ নসিব। / দোজখের পথে ধ্বংসের পথে চলিয়াছে সারা জাতি/ শূন্য দুহাত পাইয়াছি বলে তবু করে মাতামাতি।’ এইতো আমাদের সমাজের সমকালীন চেহারা।

নজরুল তাঁর কবিতায় প্রকৃত মানুষের সন্ধান করেছেন। অসহায় মজলুমের মনের তীব্র বেদনা হাহাকারে ভাষা দিয়েছেন। গরীব দুখীর জীবনের নিদারুণ চিত্র এঁকেছেন। লিখেছেন ‘এই দরিদ্র ভিখারীরা আজ অসহায় গৃহহারা / আলো দাও বলে কাঁদিছে দুয়ারে – ভিক্ষা পাবে না তারা?/… আমার পিছনে পীড়িত আত্মা অগণন জনগণ/ অসহ জুলুম যন্ত্রণা পেয়ে করিতেছে ক্রন্দন! /

এইযে অসহায় মানুষের ক্রন্দন ধ্বনি এটি নজরুলের কবিতায় জড়িয়ে মুড়িয়ে আছে। নজরুলের বিদ্রোহ এসব মজলুম মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। সুতরাং নজরুলের কবিতা নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর এটিই জাজ্বল্যমান সত্য।