নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ! কিন্তু কেন?


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ২০, ২০২৫, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ /
নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ! কিন্তু কেন?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ হু হু করে বেড়ে গেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদেও খেলাপি ঋণ বাড়ত। খেলাপি ঋণ কম দেখাতে তখন নানা কৌশল বেছে নেওয়া হতো। প্রতিটি নির্বাচনের আগে বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দেশীয় বা বৈশ্বিক যেকোনো সংকট হলেই ছিল বিশেষ ব্যবস্থা—নির্দিষ্ট সময়ের ঋণ পরিশোধ করা না হলেও খেলাপি করা হতো না। এরপরও আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে খেলাপি ঋণ বেশ বেড়েছিল।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের আগস্টে সরকার পতনের আগে জুন শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। ফলে নতুন সরকার গঠনের পর ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, আগে খেলাপি ঋণ মন্থর গতিতে বাড়লেও এখন কেন ক্ষিপ্র গতিতে বাড়ছে।

কোনো ঋণ সময়মতো পরিশোধ করা না হলে খেলাপি হয়ে যায়। ব্যাংকগুলো আমানতকারীর অর্থই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে। বিতরণ করা ঋণ সময়মতো ফেরত না পেলে আমানতকারীরা টাকা তুলতে সমস্যায় পড়েন। এখন যে কটি ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে সমস্যায় পড়েছে, সেসব ব্যাংকের ঋণ আদায় হচ্ছে না।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মোটাদাগে কয়েকটি। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণ এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার যেসব খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, অর্থাৎ ঋণ খেলাপি হলেও প্রদর্শন করা হয়নি, তা প্রকাশ্যে আসছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ছে, এতেও বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা অবস্থা চলছে, সে কারণেও অনেকে খেলাপি হয়ে পড়ছেন। সেই সঙ্গে ঋণ শ্রেণীকরণ বা খেলাপি করার নতুন নীতিমালার প্রভাবও পড়েছে।

নতুন নীতিমালার মাধ্যমে ব্যাংক ঋণের মান নির্ধারণে আবারও আন্তর্জাতিক রীতি চালু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করা না হলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে। তবে এই নিয়ম কার্যকর হয়েছে গত এপ্রিল মাস থেকে। এখন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের যে তথ্য বেরিয়েছে, তা মার্চ পর্যন্ত। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়াতে নতুন এই নীতিমালা খুব বেশি প্রভাব ফেলেনি। তবে কিছু ব্যাংক আগেভাগেই এই নীতিমালা মেনে ঋণ শ্রেণীকরণ শুরু করেছে।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে একীভূত হতে যাওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সম্পদের মান নির্ণয় করা হয়েছে। এতেই খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক্সিম ছাড়া বাকি চার ব্যাংক ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা–গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। তারা এসব ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা তুলে নেয়, যা ফেরত দিচ্ছে না। ফলে সেসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে এসব ব্যাংকের আরও ঋণ খেলাপি হয়ে পড়বে। খেলাপি ঋণের শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, আইএফআইসি, ইউনিয়ন ব্যাংক। এসব ব্যাংকের অবস্থা ভালো করার জন্য তদারকিতে রাখা হয়েছে।

গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ–সমর্থিত ব্যবসায়ীদের অনেকের ব্যবসা স্তিমিত হয়ে পড়েছে—এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। আগে যেসব ঋণ বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়মিত করা হয়েছিল, তা শোধ না হয়ে আবার খেলাপি হয়ে পড়ছে। ব্যাংকগুলো এখন সব ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখানো শুরু করছে। কেউ প্রভাব বিস্তার করে ঋণের মান গোপন রাখতে পারছে না—বাংলাদেশ ব্যাংকও প্রকৃত চিত্র দেখাতে চাইছে। এতেই বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

সাবেক ব্যাংকার ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ মনে করেন, যেভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে, তার লাগাম টেনে ধরা জরুরি। সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয়কে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, যেসব ব্যবসায়ী এখনো দেশে আছেন, তাঁরা কর্মসংস্থান সৃষ্ট করছেন ও অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছেন। সে জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের সহায়তা করা দরকার। ব্যবসা চালু রাখতে প্রয়োজনে আরও সহায়তা দিতে হবে এবং ঋণ নিয়মিত করে দিতে হবে। তাঁদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে ব্যবসা চলমান রাখতে হবে; সেটা হলে আখেরে দেশের উপকার হবে। কারও ব্যবসা বন্ধ করে দেশের উপকার হবে না। বিনিয়োগপ্রবাহ সচল রাখা জরুরি।