ফের সীমান্তে বেপরোয়া ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় বাংলাদেশীদের একের পর এক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি বিবৃতি আর প্রতিবাদ লিপিতেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নানা ইস্যুতে যখন উত্তেজনা বিরাজ করছে ঠিক এমন সময়ে গতকাল পঞ্চগড় সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি করে আনোয়ার হোসেন (৪০) নামে বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে।
শুক্রবার ভোরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের মোমিনপাড়া সীমান্তের বিপরীতে ভারতের শিংপাড়া সীমান্তের মেইন পিলার ৭৫১ এর ৮/৯ নম্বর সাব পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আনোয়ার তেতুঁলিয়া উপজেলার দেবনগড় আম জুয়ানি এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। শেখ হাসিনা সরকার একদিকে ভারতকে একতরফাভাবে ট্রানজিট, বন্দর, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যবসাসহ নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে গেছে, অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশকে আন্তসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়নি। সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিলেও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে একের পর এক বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। অথচ সীমান্তে বিএসএফের নিয়মিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কড়া ও স্পষ্ট অবস্থান নেয়া, প্রতিটি ঘটনার বিচার ও তদন্ত দাবি করা, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে জবাবদিহি চাওয়া এবং প্রয়োজনে বারবার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টিকে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করার কোনো চেষ্টাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বতী সরকারের আমল থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা।
সূত্র জানায়, গত ১ সেপ্টেম্বর রোববার রাতে মায়ের সঙ্গে ভারতের ত্রিপুরায় থাকা ভাইকে দেখতে যাওয়ার সময় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফয়ের গুলিতে কিশোরী স্বর্ণা দাস (১৪) নিহত হয়। নিহত স্বর্ণা মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের কালনীগড় গ্রামের বাসিন্দা পরেন্দ্র দাসের মেয়ে। সে স্থানীয় নিরোদ বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। হত্যাকান্ডের ৪৫ ঘণ্টা পর বিএসএফ নিহত স্কুলশিক্ষার্থীর লাশ হস্তান্তর করে। ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুনকে হত্যা করা হয় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরে আর ১৪ বছর বয়সী স্বর্ণা দাসকে হত্যা করা হয় সেই ঘটনার ১৩ বছরের বেশি সময় পর ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাতে।
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে গরু চোরাচালান হয়। চোরাচালানিদের হত্যা করা হয়। মনে হয় যেন সীমান্তে গরু জন্ম নেয় আর তা বাংলাদেশে পাচার করা হয়। বাস্তবে এই সব গরু আনা হয় ভারতের অভ্যন্তরে দুই-আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরের হরিয়ানা, পাঞ্জাব থেকে। গরুগুলো হাঁটিয়ে, ট্রাক-ট্রেনে করে আনা হয়। তখন কেউ দেখে না! তারা আটকায় না। কারণ, তারা ভাগ পায়। এখানে আসল কথা হলো দুর্নীতি, ভাগ-বাঁটোয়ারার মাধ্যমে সব করা হয়। যখন ভাগ-বাঁটোয়ারায় মেলে না, তখন বিএসএফ হত্যা করে। বাংলাদেশকে চাপে রাখতে সীমান্ত হত্যা বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।
সীমান্তের বাসিন্দরা বলছেন, বাংলাদেশ-ভারত প্রতিবছরই সীমান্ত সম্মেলনের আয়োজনের করা হয়, প্রতিবছরই সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু, কাজের কাজ কিছু হয় না। মানুষ মরে, খুন হয়। বলাবাহুল্য যে অধিকাংশই বাংলাদেশের। এরপরও আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নীরব থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র দুটো দেশের সীমানা রয়েছে ভারত ও মিয়ানমার। কিন্তু, ভৌগলিক অবস্থার কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানার প্রকৃতি ভিন্ন। সেই অর্থে একমাত্র ভারতের সঙ্গেই আমাদের কার্যকর সীমানা। এই একমাত্র প্রতিবেশীর সঙ্গে আলোচনায় যদি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীরব থাকা হয়, তাহলে এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে নানাবিধ বিরূপ প্রশ্ন জাগার আশঙ্কা থেকেই যাবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বতী সরকারের আমল থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলে সাধারন মানুষের প্রত্যাশা।
আমাদের পঞ্চগড় জেলা সংবাদদাতা জানান, পঞ্চগড়ে বিএসএফয়ের গুলিতে আনোয়ার হোসেন (৪০) নামে এক বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পর পতাকা বৈঠক শেষে লাশ ফেরত দিয়েছে বিএসএফ। শুক্রবার বিকেলের দিকে সব প্রক্রিয়া শেষে বিএসএফ-বিজিবির কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে। এর পর ময়নাতদন্তের জন্য পঞ্চগড় সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিজিবি। এর আগে ভোরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের মোমিনপাড়া ও ভারতের শিংপাড়া সীমান্তের মেইন পিলার ৭৫১ এর ৮-৯ নম্বর সাব পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বাংলাদেশি আনোয়ারের জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের রফিকুল ইসলামের ছেলে।
নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাতে কয়েকজন বাংলাদেশিসহ ভারতে গরু আনতে যান আনোয়ার হোসেন। পরে ভোরের দিকে গরু নিয়ে ফেরার পথে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’ ৯৩ ব্যাটালিয়নের চানাকিয়া ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। বিএসএফের দাবি ওই বাংলাদেশিরা তাদের ওপর বটি ও বাঁশের লাঠি দিয়ে হামলা করতে গেলে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায় বিএসএফ। এ সময় ঘটনাস্থলে নিহত হন আনোয়ার। পরে তার লাশ নিয়ে যায় বিএসএফ সদস্যরা। সে সঙ্গে চোরাচালানের দুইটি গরুও জব্দ করে বিএসএফ সদস্যরা। এদিকে গুলির শব্দ পেয়ে ৮ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করেন ঘাগড়া বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, লাশ গ্রহণ করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বলেন, পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ ফেরত আনা হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় বলেন তিনি জানান।