পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে তিনবার


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৮, ২০২৫, ৮:৫৫ পূর্বাহ্ণ /
পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে তিনবার

বিতাড়িত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের অপশাসন, কুশাসন এবং ভারতের পদলেহী ভূমিকার অবসান ঘটার পর বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে। এ ব্যাপারে অতীতের মতো এবারেও উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তান। চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল বুধবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমানা বেলুচ বাংলাদেশে আসেন। আমানা বেলুচের সফরকালে বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন তার প্রতিপক্ষকে বলেন, তিনটি ইস্যুর নিষ্পত্তি হলে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারে।

এই তিনটি ইস্যু হলো- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে অফিশিয়ালি ক্ষমা চাইতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বসবাসরত বিহারিদের পাকিস্তানে ফেরত নিতে হবে। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের অংশ থাকাকালে পশ্চিম পাকিস্তানের নিকট বাংলাদেশের যে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার পাওনা আছে সেটি শোধ করতে হবে। আমানা বেলুচ পাকিস্তান ফিরে যান। এরপর দুই দেশের সম্পর্কে আর কোনো উন্নতি ঘটেনি।

দ্বিতীয় পর্যায়ে গত ২৩ আগস্ট শনিবার পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির বিপুল আশা নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। তার সফরের ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিপুল আশাবাদ প্রকাশ করা হয়। ওয়েবসাইটে বলা হয়, Prime Minister and Foreign Minister, Senator Mohammad Ishaq Dar (50), embarks upon a historic visit to Bangladesh. In Dhaka, he will hold important meetings with Bangladeshi leaders. The visit is a significant milestone in Pakistan-Bangladesh relations as a Pakistani Foreign Minister is visiting Bangladesh after a gap of around 13 years. অনুবাদ : পাকিস্তানের ৫০ বছর বয়স্ক ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বাংলাদেশে এক ঐতিহাসিক সফরে যাচ্ছেন। ঢাকাতে তিনি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। পাক বাংলার ইতিহাসে এই সফর একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কারণ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৩ বছর পর বাংলাদেশে যাচ্ছেন।

ইসহাক দার বাংলাদেশ সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সাথে অফিশিয়াল বৈঠক ছাড়াও তিনি বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমানের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। এসব সাক্ষাৎকালে পাক উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রাচীন ইংরেজি দৈনিক ‘ডনের’ সম্পাদকীয় মোতাবেক বাংলাদেশের তরফ থেকে বলা হয়, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত করার জন্য ১৯৭১ এর ঘটনাবলির জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশ আরো বলে, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা টাকা-পয়সা ফেরত দিতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদেরও ফেরত নিতে হবে। পাকিস্তানের তরফ থেকে বলা হয়, এসব ইস্যুর নিষ্পত্তি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রভুত উন্নতি ঘটে। এই সম্পর্ক আরো গভীর হয় বেগম খালেদা জিয়ার আমলে। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতের স্বার্থে পাকিস্তানের সাথে শুধু সম্পর্কের ক্রমবর্ধমান উন্নতির গতিই থামিয়ে দেননি, সেই সম্পর্ক তিক্ত করার জন্য যত রকম পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সেগুলো নেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৯ সাল থেকেই প্রধানত কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। ১৯৪৯ সালে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়। ১৯৬৫ সালে দুই দেশের মধ্যে আবার কাশ্মীর ইস্যুতে সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ইস্যুতে পাক ভারত বাংলাদেশ যুদ্ধ হয়। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে অবনতি ছাড়া কোনো উন্নতি হয় নাই।

শেখ হাসিনার সময় ভারতীয় বয়ান মোতাবেক সম্পর্কের উন্নয়ন তো দূরের কথা, পাকিস্তানের সাথে রীতিমতো বৈরী আচরণ করা হয়।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় পাকিস্তান কর্তৃক ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া। গত ২৬ আগস্ট মঙ্গলবার ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারের’ প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত,‘News Analysis’ (সংবাদ বিশ্লেষণ) এ বলা হয়, Bangladesh wants a formal apology from Pakistan for the 1971 atrocities committed by its military against Bengalis, settlement of financial accounts and repatriation of stranded Pakistanis. The financial claims include $4.52 billion covering Bangladesh’s share of undivided Pakistan’s pre-1971 assets. অনুবাদ : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নির্যাতনের জন্য বাংলাদেশের নিকট আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাইতে হবে। এ ছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়া এবং অবিভক্ত পাকিস্তানের বাংলাদেশের পাওনা ৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা। তবে এগুলোর মধ্যে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি ওই মহলের প্রধান দাবি।

এ ব্যাপারে একুশে টেলিভিশনের সংবাদ পর্যালোচনায় বলা হয়, পাকিস্তান তাদের অপকর্মের জন্য এখন পর্যন্ত নানাভাবে মোট তিনবার ক্ষমা চেয়েছে। এর মাঝে পাকিস্তানের দুজন রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশে এসে ক্ষমা চেয়েছেন। আরেকবার লিখিত চুক্তিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ক্ষমা/অনুশোচনা প্রকাশ করেছিল পাকিস্তান। অথচ অ্যান্টি পাকিস্তান ন্যারেটিভকে শক্তিশালী করার জন্য শহীদ জিয়া এবং বেগম জিয়ার আমল ছাড়া অবশিষ্ট ৪০ বছর একটানা প্রচার করা হচ্ছে যে পাকিস্তান বাংলাদেশে কৃত ঘটনাবলির জন্য দুঃখিত নয়। শেখ হাসিনার আমলে এই ন্যারেটিভের বিপরীতে সত্য ঘটনা বলতে কেউ সাহস পাননি। কিন্তু শেখ হাসিনার পলায়নের পর প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসছে।

বিগত ৫৪ বছরের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল, ২৯ জুন ও ২০০২ সালে পাকিস্তান তিন দফা ক্ষমা চেয়েছিল। প্রথমে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলের এক চুক্তির অংশ হিসেবে যেখানে ইসলামাবাদ জানায়, বাংলাদেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে পাকিস্তান তার নিন্দা করছে এবং গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছে। ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিলের চুক্তিতে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানান, অতীতের ভুলগুলোকে ভুলে গিয়ে ক্ষমা করার।

১১ এপ্রিল ১৯৭৪ দ্য নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমাপ্রার্থনা। ১৯৭৪ সালের ওই চুক্তিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জেড এ ভুট্টো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশে একবার সফর করবেন এবং দেশটির জনগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন। একই বছর জুনে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে আসেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ওপর চালানো নির্যাতন ও গণহত্যার ঘটনায় তওবা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেন মিস্টার ভুট্টো।

মিস্টার ভুট্টো আরো বলেন, আমরা অন্তরের অন্তস্থল থেকে তওবা (অনুশোচনা) করছি। আমি আগেই বলেছি, পাকিস্তানের জনগণ তোমাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানায়।

নিউইয়র্ক টাইমস ২৯ জুন ১৯৭৪ তারিখের খবরে লিখেছিল, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো আজ প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে যে লজ্জাজনক দমননীতি ও অকথ্য অপরাধ চালিয়েছিল তার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন।

সর্বশেষ পাকিস্তান সরকার আরেক দফা ক্ষমা চেয়েছিল ২০০২ সালে। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ বাংলাদেশ সফরে এসে ক্ষমা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের কোনো সেনাশাসকের পক্ষ থেকে এটাই প্রথম অনুশোচনা প্রকাশ, যা তিনি বাংলাদেশে এক সরকারি সফরের সময় ব্যক্ত করেন। সেটাকে দ্য টেলিগ্রাফ উল্লেখ করেছিল পরোক্ষাভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা হিসেবে। সেবার জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শনের সময় দর্শনার্থী বইতে তিনি লিখে যান, ১৯৭১ সালের ঘটনার কষ্ট পাকিস্তানের ভাই-বোনেরাও অনুভব করে। সেই দুর্ভাগ্যজনক সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির জন্য আমরা দুঃক্ষিত। দ্য টেলিগ্রাফ ৩১ জুলাই ২০০২ তারিখে লিখেছিল, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশারফ একটি সাহসী পদক্ষেপ নেন যখন তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত নৃশংসতার জন্য পরোক্ষভাবে পাকিস্তান দুঃখ প্রকাশ করে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে, ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে আমেরিকা যুদ্ধ করেছে ২০ বছর (১৯৫৫-৭৫)। ২০ বছরব্যাপী এই যুদ্ধে আমেরিকা তার জায়ান্ট বোমারু বিমান বি-৫২ থেকে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ পাউন্ড বোমাবর্ষণ করেছে ভিয়েতনামে। কিন্তু তার পরেও আমেরিকার সাথে ভিয়েতনামের সম্পর্ক বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো বছরের পর বছর বিচ্ছিন্ন থাকেনি। আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে ২টি পারমাণবিক বোমা হামলা করেছিল। যার ফলে ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ মারা যায়, লাখ লাখ মানুষ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয় এবং কোটি কোটি টাকার ধনসম্পদ ভস্মীভূত হয়। কিন্তু সেই আমেরিকাই জাপানকে আজ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ায় প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করেছে।

ব্রিটেন ২০০ বছর ভারতকে কলোনি বানিয়ে রেখেছিল। অথচ, ব্রিটেনের সেই ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে ভারত তাদের প্রথম প্রেসিডেন্ট বানায়। অথচ ওপরে উল্লিখিত ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় পাকিস্তানের অপরাধ অনেক কম। এ কারণে বিগত ৫৪ বছর ধরে দেশটিকে শত্রু জ্ঞান করার কোনো কারণ নাই। ১৯৭১ এর যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধের পর ভারত বাংলাদেশ থেকে যে সম্পদ লণ্ঠন করেছে এবং শেখ হাসিনার ১৫ বছরে যেভাবে বাংলাদেশকে করদ রাজ্যে পরিণত করেছে সে কারণে ভারতের সাথেও সম্পর্ক রাখা উচিত ছিল না।

জনগণ মনে করেন, জাতীয় স্বার্থেই একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করা হয়। তাই বাংলাদেশের স্বার্থে অবিলম্বে চীন, পাকিস্তান ও মুসলিম জাহানের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।