পাহাড়ের অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কঠোরে যাচ্ছে সেনাবাহিনী


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ৯:২১ পূর্বাহ্ণ /
পাহাড়ের অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে কঠোরে যাচ্ছে সেনাবাহিনী

সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে নারী ও শিশুদেরকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তবে এসব অপতৎপরতা রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নীতিগত অস্পষ্টতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে পাহাড়ে নানা অপকর্ম ঘটিয়ে চলেছে আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে নিরাপত্তা বাহিনী। এতে নতুন করে মাথাব্যথা শুরু হয়েছে ইউপিডিএফের। শুরু করেছে তালবাহানা। সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে নারী ও শিশুদেরকে ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। তবে এসব অপতৎপরতা রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে সেনাবাহিনী।

জানা গেছে, ইতোমধ্যে সরকারি খাসজমিতেও অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপনে বাধা দিয়েছে ভারতপন্থী সংগঠনটি। প্রশাসনের হাতে সরকারি গেজেট থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে নেয়া সেনা পদক্ষেপে নীতিনির্ধারকদের নীরবতা নিরাপত্তা মহলে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বার্মাছড়ি ইউনিয়নের আর্য কল্যাণ বনবিহার এলাকায় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু ইউপিডিএফ সমর্থিত একাংশ দাবি করে, জায়গাটি বনবিহারের সম্পত্তি। এই অজুহাতে তারা সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে বাধা দেয় এবং নারী-শিশুকে সামনে রেখে মানবঢাল তৈরি করে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন জানায়, বিতর্কিত জমিটি ১৯৩৪ সালের কলকাতা গেজেট অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় খাসজমি।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ওই জমির মালিকানা বা দখলের অনুমতি পায়নি। সরকারি নথিতে এটি একান্তভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। কিন্তু ইউপিডিএফ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে।

খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বলেন, এটি রাষ্ট্রীয় ইস্যু। সরকারি নথি অনুযায়ী জায়গাটি খাসজমি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। কয়েক দিনের মধ্যেই ফলাফল জানা যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের একজন সিনিয়র সেনাকর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের হাতে অস্ত্র আছে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলো মাঠে আধিপত্য বিস্তার করছে। এটা পাহাড়ে শান্তি বিনষ্ট হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর কুফল ভোগ করতে হতে পারে বাংলাদেশকে।

সেনা সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পার্বত্য এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা নীতিমালা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি। এতে সেনাসদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা তৈরি হচ্ছে।

এ দিকে বর্মাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ-সমর্থিত বৌদ্ধ ভিক্ষু সঙ্ঘের উদ্যোগে আজ ২৯ অক্টোবর ‘মহাসঙ্ঘদান’ নামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। কিন্তু প্রশাসন বলছে, তাদের কাছে কোনো সরকারি সফরসূচি নেই।

উপদেষ্টার একান্ত সচিব ও ব্যক্তিগত সহকারী দু’জনই জানিয়েছেন, এ সফর সম্পর্কে তাদের দফতরে কোনো তথ্য নেই। ফলে এই আয়োজন ইউপিডিএফের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নতুন কৌশল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ইউপিডিএফ নেতা প্রসীত বিকাশ খীসা সেনাবাহিনীর অভিযানকে বিতর্কিত করে তুলতে ২৭ থেকে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আর্যকল্যাণ বিহারে বড় আকারে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করার নির্দেশ দেয়। গোয়েন্দা সূত্রটি আরো জানায়, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের পালি বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার জ্যোতিমারা বুড্ডিস্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের একজন নেতা সেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড বিতর্কিত করতে বক্তব্য রাখতে পারেন।

অন্য দিকে ‘মানবঢাল’ কৌশল জনসমর্থন হারানোর ইঙ্গিত বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সশস্ত্র গোষ্ঠী যখন নারী-শিশুকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীর কাজে বাধা দেয়, সেটি কোনো প্রতিবাদ নয়, বরং রাজনৈতিক দৈন্যদশার নিদর্শন। তবে পাহাড়ের শান্তি ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বড় পরিসরে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বিলম্ব হলে বড় খেসারত দিতে হতে পারে দেশকে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, পাহাড়ে সেনা টহল ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বাড়লেই ইউপিডিএফ ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়ের মুখোশ পরে মাঠে নামে। প্রশাসন ও সেনাকে বিব্রত করে তাদের নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখে। বর্তমানে বার্মাছড়ি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সার্বিক কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে চলেছে সেনাবাহিনী। একের পর এক জনবান্ধব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। গত সোমবার রাঙ্গামাটির কাউখালী উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

পার্বত্য খাগড়াছড়ির গুইমারা রিজিয়নের আওতাধীন লক্ষ্মীছড়ি জোনের কমান্ডার লে. কর্নেল তাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ২৪ অক্টোবর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ইউপিডিএফ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে মানুষ জড়ো করে মিছিল করেছিল। এরপর একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়, যা ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সুবিবেচনায় নিয়ে আমাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

তিনি বলেন, স্থানীয়দের অসুবিধা হয়, এমন কিছু সেনাবাহিনী করবে না। তবে এলাকায় যদি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে তাহলে তা দমন করতে হার্ড লাইনে যাবে সেনাবাহিনী। কোনো অস্ত্রধারী গোষ্ঠী যদি পাহাড়কে অশান্ত করতে চায় তবে তা চরম ভুল হবে।

সভায় হাটহাজারী রেঞ্জের সর্তা বন বিভাগের কর্মকর্তা মো: মাঈনউদ্দিন বলেন, প্রস্তাবিত স্থাপনাস্থলটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) খাদিজা তাহিরা বলেন, এটি বন বিভাগের জায়গা বলে জানা গেছে। তবে কারো আপত্তি থাকলে তারা কাগজপত্রসহ উপজেলা ভূমি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।

এর আগে গত শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) বর্মাছড়ি এলাকায় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নিলে কয়েক শ’ পাহাড়ি বিক্ষোভ করেন। তারা ক্যাম্প নির্মাণ কাজ বন্ধ ও সেখানে অবস্থান নেয়া সেনাসদস্যদের সরিয়ে নেয়ার দাবিতে চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার এবং ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসির বরাবর স্মারকলিপি দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নিয়ে উক্ত মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয় বলে জানা গেছে।

একটি সূত্র বলছে, ইউপিডিএফ একটি নির্দিষ্ট স্থানকে ‘বনবিহার’ বলে দাবি করলেও এর আগে এখানে কোনো বনবিহার ছিল না। মূলত সেনাবাহিনীর অস্থাীয় ক্যাম্প ও তাদের নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করতেই ধর্মীয় ইস্যু তুলে জল ঘোলা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ভারত থেকে সীমান্ত পথে অস্ত্র আমদানি বন্ধ, ভারতীয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর তৎপরতা দমন ইস্যুতে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে অবিলম্বে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও সেনাবাহিনীর জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে পরিস্থিতি সঙ্কটময় হতে পারে।