পিলখানা হত্যাকান্ডে নেপথ্যে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের রক্ষায় মরিয়া প্রভাবশালী চক্র। ওই চক্রের ইশরাতেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনে কৌশলে নানা কথা বলছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। পিলখানায় বিডিআরে কর্মরত চৌকশ দেশপ্রেমিক ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সাথে পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনীতিবিদরা জড়িত থাকার পাশাপাশি ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার তথ্য ওপেন সিক্রেট।
একই সাথে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ও উচ্চ বিলাশী তৎকালিন সেনা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার তথ্যও নানা মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতীয় এজেন্ট এবং কতিপয় তৎকালিন সেনা কর্মকর্তাদের রক্ষায় বর্তমান আন্তবর্তীকালিন সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন যেন না হয় সে জন্য নেপথ্যে থেকে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিলখানা হত্যাকান্ডের সেই বীভৎস দৃশ্যাবলি এদেশের মানুষের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। কতিপয় বিডিআর সদস্য যে এ হত্যাকান্ডের পরিকল্পনা করতে পারে, সে কথাও মানুষ বিশ্বাস করে না। তাদের অনেকেই মনে করেন, পর্দার আড়াল থেকে কেউ না কেউ এ ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই ইন্ধনদাতা কারা? তারা কি এদেশেরই লোক, নাকি ভারথীয় এজেন্ট? পিলখানা হত্যাকান্ডের অনেক আগে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কেবল কিছুসংখ্যক মধ্যম ও নিম্ন সারির বিডিআর সদস্য দ্বারা এতবড় ঘটনার পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়।
এ ঘটনায় স্বার্থান্বেষী মহলের কোনো না কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে। আদালতও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে ছিল স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই পিলখানা হত্যাকান্ডের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেছেন, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘœ সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা। বিডিআর জওয়ানরা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, সেই কলঙ্কের চিহ্ন তাদের বহুকাল বহন করতে হবে। তাই দ্রুত পিলখানা হত্যাকান্ডে নেপথ্যে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন জরুরী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পিলখানা হত্যাকা- শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা। এ পৃথিবীতে সর্বাধিক সামরিক কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়ায়। ১৯৬৭ সালে চীনপন্থি কমিউনিস্টদের সমর্থনে একটি বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিল। সাত দিনব্যাপী চলমান সেই ঘটনায় ১০০ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু পিলখানা হত্যকা- সে ঘটনাকেও হার মানিয়েছে। মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। উচ্চ আদালতে পিলখানা হত্যাকা- মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
বর্তমান আন্তবর্তীকালিন সরকার পিলখানা হত্যাযজ্ঞের নেপথ্যচারীদের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য কোনো তদন্ত কমিশন গঠন করেনি। কেন গঠন করেনি, তা আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে সরকারও নির্বিকার। তদন্ত কমিশন গঠন না করার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কিছুই জানানো হয়নি। স্বাভাবিক কারণেই এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকা-ের পেছনে যেসব কুশীলব কাজ করেছে, তাদের আসল পরিচয় বেরিয়ে আসুক, এ ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নয়, তাহলে কি খুব বেশি দোষ দেওয়া যাবে?
পিলখানায় শহীদ পরিবারের স্বজনরা বলছেন, যারা এখন বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন, তারা আসলে নেপথ্যের কারিগর নয়। যারা এ ঘটনার আসল কারিগর তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত শহীদ পরিবারের সদস্যদের মনে শান্তি আসবে না। তাই অল্প সময়ের মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
পিলখানা হত্যাকা-ে শহীদ কর্নেল কুদরত-ই-এলাহীর ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান ইনকিলাবকে বলেছিলেন, পিলখানা হত্যাকান্ডের নেপথ্যে যারা ছিল তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না। তবে এ রহস্য উদঘাটনের জন্য আমরা মনে করছি একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা দরকার। এই কমিটির নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে ঘটনার প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করবে। এ ঘটনার পর আর্মি ও বেসামরিক প্রশাসন আলাদা আলাদা দুইটি তদন্ত করেছে। সেই তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ করতে হবে।
নেপথ্যের কারিগররা অনেক শক্তিশালী উল্লেখ করে তিনি বলেন, নেপথ্যে যারা ছিল তারা অনেক শক্তিশালী এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাইকোর্টের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ঘটনার পেছনে আরও লোক আছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, কিন্তু নেপথ্যের কারিগরদের সমাপ্ত করার জন্য কোনো উদ্যোগ নেই।
বিডিআর হত্যাকা-ের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল কয়েক দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। তদন্ত কমিশন গঠনে অন্তর্বতীকালীন সরকার গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ করে আসছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। মঙ্গলবার পিলখানায় বিডিআর হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচনে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
আ’লীগ সরকারের সময় বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলো। ওই তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল মতিন। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিডিআর হত্যাকা- নিয়ে যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, সেখানে গভীরভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
তদন্ত কমিটি আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে সাহায্য পায়নি। ফলে বিডিআর হত্যাকা- নিয়ে অধিকতর তদন্ত করা সম্ভব হয়নি। তাই এখন তদন্ত কমিটি না করে তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। তদন্ত কমিশন হলে বিডিআর হত্যাকা-ের গভীরে যাওয়া সম্ভব। এতে করে নেপথ্যে জড়িতদের শনাক্ত করাসহ এ হত্যাকা-ের সাথে জড়িত মুলহোতাদের বের করা সম্ভব হবে।
এদিকে শাহাদত বরণকারী তৎকালীন বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের পুত্র রাকিন আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার সাথে জড়িতদের শনাক্ত করবে হতে। স্বাধীন তদন্ত কমিটি করা হলে অনেকের নাম আসবে। আমরা বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি। এদেশের সাধারণ মানুষ বিডিআর হত্যাকা-ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে ও নেপথ্যে জড়িতদের বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দেখছে চায়।
বিচার চাইতে গিয়ে অনেক দেশপ্রেমিক, সাহসী সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক কর্মকর্তার জেল হয়েছে, জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন এই হত্যাকা-ের তদন্তে একটি কমিশন করা হোক। যেসব নির্দোষ সৈনিক জেলে আছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তাদের মুক্তি দেয়া হোক। রাকিন আহমেদ আরো বলেন, আমরা সব সময় একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে বিডিআর হত্যাকা-ের বিচার চেয়েছি। তদন্ত কমিটি গঠন করে বিডিআর হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে কি?
পিলখানা হত্যাকান্ড শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা। দীর্ঘ ১৬ বছরেও পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকান্ডের পেছনে কারা কলকাটি নেড়েছে তা জানা সম্ভব হয়নি। যাদের বিচারের মুখোমুখি হয়েছে, তারা আসলে নেপথ্যের কারিগর নয়। যারা এ ঘটনার আসল কারিগর তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের শনাক্ত করে বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বের করা সম্ভব হবে না। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। পিলখানা হত্যাকান্ডে প্রাণ হারান ৫৭ জন সেনা সদস্যসহ ৭৪ জন। আহত হন কয়েক শত। এখনই সময় পিলখানা হত্যাকান্ডের মতো বিশ্ব ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে নেপথ্যে জড়িতদের বের করা।
আপনার মতামত লিখুন :