ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরের ইতিহাসে ঘটে গেল এক নজিরবিহীন চুরির ঘটনা। মাত্র ১০ মিনিটেরও কম সময়ে চোরেরা জাদুঘরের দ্বিতীয় তলা থেকে অমূল্য রাজকীয় গহনা চুরি করে পালিয়ে যায়। তারা ব্যবহার করে এক অভিনব উপকরণ—একটি ট্রাক-মাউন্ট করা বৈদ্যুতিক মই, যেটি সাধারণত প্যারিসে বড় আসবাবপত্র জানালা দিয়ে উপরে তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সুচিন্তিত পরিকল্পনা, দ্রুততা এবং সাহসিকতা গোটা ইউরোপে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ঘটনাটি ঘটে রবিবার (১৯ অক্টোবর) সকালে, যখন জাদুঘরের নিরাপত্তা কর্মীরা সাধারণ টহল দিচ্ছিলেন। চুরির মূল লক্ষ্য ছিল ল্যুভরের অ্যাপোলো গ্যালারির ভেতরের রাজকীয় গহনার সংগ্রহশালা, যেখানে ১৯শ শতকের ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন তৃতীয়ের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী ইউজেনির গহনা প্রদর্শিত ছিল। চোরেরা পরিকল্পিতভাবে ওই এলাকায় প্রবেশ করে, অমূল্য গহনা হাতিয়ে নেয় এবং ১০ মিনিটেরও কম সময়ে পালিয়ে যায়। ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, এটি ছিল “একটি উচ্চমাত্রার পেশাদার ও লক্ষ্যনির্ভর হামলা।
সংস্কৃতিমন্ত্রী রচিদা দাতি ফরাসি সংবাদমাধ্যম টিএফ১-কে জানান, চুরির সময়কার ভিডিওতে দেখা গেছে মুখোশধারী চোররা একেবারে শান্তভাবে ভেতরে ঢুকে গয়না রাখা প্রদর্শনী বাক্স ভেঙে ফেলে। দুইজন ডাকাত প্রথমে ব্যবহার করে একটি ‘মন্ত-ম্যুবল’ (monte-meubles)—একটি ট্রাক-মাউন্ট করা বৈদ্যুতিক মই, যেটি প্যারিসের রাস্তায় প্রায়ই দেখা যায়। সাধারণত এটি বড় আসবাবপত্র জানালা দিয়ে ওঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। চোরেরা সেই মই বেয়ে জাদুঘরের দ্বিতীয় তলার জানালায় পৌঁছে যায়। জানালা ভেঙেই তারা প্রবেশ করে অ্যাপোলো গ্যালারিতে, যেখানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপত্তা অ্যালার্ম বেজে ওঠে।
যা যা চুরি হলো
কতৃপক্ষের তথ্যমতে, ভেতরে ঢোকার পর, চোরেরা কোনো দেরি না করে দুটি প্রদর্শনী কাচ ভেঙে আটটি মূল্যবান গহনা ও বস্তু চুরি করে। এতে আরও অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে, কিন্তু তারা থামেনি। লক্ষ্য ছিল গ্যালারির মাঝামাঝি অংশে থাকা উচ্চ-নিরাপত্তা যুক্ত প্রদর্শনী কেস, যেখানে রাখা ছিল একটি রাজকীয় নীলা (sapphire) নেকলেস, একটি রাজকীয় পান্না (emerald) নেকলেস এবং সম্রাজ্ঞী ইউজেনির পরা একটি ডায়াডেম (মুকুট)।
তাড়াহুড়োর মধ্যে চোরেরা একটি বস্তু ফেলে যায়, যা পরে পুলিশ উদ্ধার করে। সেটি হলো সম্রাজ্ঞী ইউজেনির রাজমুকুট, যেখানে রয়েছে ১,৩৫৪টি হীরা, ১,১৩৬টি রোজ-কাট হীরা এবং ৫৬টি পান্না। এই রাজমুকুটটি ফরাসি ইতিহাসের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন বলে বিবেচিত।
জাদুঘরের প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ঘটনার সময় ল্যুভর জাদুঘরের পাঁচজন কর্মী অ্যাপোলো গ্যালারির ভেতরে বা আশেপাশে ছিলেন। তারা জাদুঘরের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেন এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেন। ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, “আমরা প্রথমেই মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছি।” এরপর নিরাপত্তারক্ষীরা পুরো জাদুঘর দ্রুত খালি করে দেন এবং জরুরি সাড়া পরিকল্পনা চালু করেন।
গহনা লুট করার পর চোরেরা একই পথে, অর্থাৎ মই বেয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে অপেক্ষা করছিল আরও দুই সহযোগী, যারা মোটর স্কুটারে করে তাদের নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। পুরো প্রক্রিয়াটি ১০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়—যা ফরাসি পুলিশদের হতবাক করে দিয়েছে।
পরদিন সোমবার সকালে, প্যারিস পুলিশ পুরো ঘটনাস্থল ঘিরে তদন্ত শুরু করে। প্যারিসের প্রসিকিউটর লর বেকো (Laure Beccuau) জানান, প্রায় ৬০ জন তদন্তকারী সাক্ষী জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, ফরেনসিক প্রমাণ পরীক্ষা করছেন এবং জাদুঘরের ভিতর-বাইরের নজরদারি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছেন। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, এটি কোনো একক কাজ নয়, বরং একটি উচ্চ প্রশিক্ষিত আন্তর্জাতিক চোরচক্রের পরিকল্পিত অভিযান।
এদিকে, ল্যুভর কর্তৃপক্ষ বলছে, চুরি যাওয়া বস্তুগুলো বিমা-কৃত হলেও তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য অনন্য, যা কোনো অর্থমূল্যে মাপা সম্ভব নয়। অতি সুরক্ষিত ল্যুভরে চুরির ঘটনা এবারই প্রথম নয়। ১৯১১ সালে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্ম জাদুঘর থেকে চুরি হয়। দুই বছর পর শিল্পকর্মটি উদ্ধার হয়
ল্যুভর জাদুঘরের এই চুরির ঘটনা ফ্রান্সসহ পুরো ইউরোপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। মাত্র কয়েক মিনিটের এই চুরিতে ইতিহাসের অমূল্য গহনা হারানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফরাসি কর্তৃপক্ষ বলছে, “আমরা এই অপরাধীদের ধরতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।” কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ জাদুঘরেও যদি এমনভাবে চুরি ঘটে, তবে শিল্প ও ঐতিহ্যের আসল নিরাপত্তা কোথায়? তথ্যসূত্র : দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
আপনার মতামত লিখুন :