প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব সুপারিশ কমিশনের


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ২৫, ২০২৫, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ /
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব সুপারিশ কমিশনের

প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন সুপারিশ দিয়েছে। ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রশ্নে বিএনপিসহ সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো এবং অংশীজনদের কোনো দ্বিমত নেই। তবে কীভাবে সেই ক্ষমতার ভারসাম্য আনা যাবে, সে ব্যাপারে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করতে চাইছে, সেখানে আলোচনা করে উপায় বের করার চেষ্টা থাকবে।

বিএনপি যে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে সেই ভারসাম্য আনা যাবে, সে ব্যাপারে বিএনপি ও অন্য দলগুলো এখনো বিস্তারিত কিছু বলেনি। অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদনে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের কাজ চলছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে। কমবে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা যাতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকে, সে ব্যবস্থা করা উচিত। এ ধরনের প্রস্তাব ইতিবাচক।

এম এ মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
এখন প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়। সংবিধানের এই জায়গায় পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। কিছু সাংবিধানিক পদে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার কথা বলেছে তারা। এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না।

১৫ জানুয়ারি নিজেদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে সংবিধান সংস্কার কমিশন। সেখানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করছে। এই বিশেষ কার্যাবলি বা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ নিয়ে ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংলাপ করতে চাইছে, সেখানে আলোচনা করে উপায় বের করার চেষ্টা থাকবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়বে কোথায়
সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি, উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) পদের মতো কিছু সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে এসব পদে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না। এতে বিচার বিভাগের নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ মুক্ত হওয়ার সুযোগ বাড়বে। এর বাইরে আইন দিয়ে নির্ধারণ করা অন্য কোনো পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব থাকতে পারে। সেসব ক্ষেত্রেও নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের প্রয়োজন হবে না।

এ ছাড়া ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে নিজেদের সুপারিশের সারসংক্ষেপে নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ—রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ গঠনের প্রস্তাব করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও অন্যান্য সদস্য, দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য কমিশনার, মানবাধিকার কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য কমিশনার, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের পদে নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, বিচার বিভাগে নিয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনগুলোরও কিছু প্রস্তাব আছে।

জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু এই ঘোষণার বৈধতার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর নিতে হয়। সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবে বলেছে, কেবল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা থাকবে না।

বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়ায় কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় দলগুলোও সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়নি বা তাদের মতামত প্রকাশ করেনি।

দেশে সংসদীয় ব্যবস্থায় এত দিন একই ব্যক্তি ছিলেন একাধারে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই দলের শাসনের ক্ষেত্রেই এমনটি ছিল। এতে সরকার, সংসদ ও দলে একজনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হতে পারবেন না।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সংস্কার প্রস্তাবের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সংবিধানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা। রাষ্ট্রপতির কী কী দায়িত্ব থাকবে, তা তাঁদের বিস্তারিত প্রতিবেদনে আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেভাবে সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে আপাতদৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কমবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কিছুটা বাড়বে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে কতটা কাজ করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় থাকে। কারণ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে। তবে সংবিধান সংস্কার কমিশন যেভাবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলেছে, সেটা বাস্তবায়িত হলে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মনোনীত প্রার্থীই যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন, তার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।

সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবে বলেছে, কেবল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা থাকবে না।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব হলো, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন নির্বাচকমণ্ডলীর (ইলেকটোরাল কলেজ) সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে। আইন সভার উভয় কক্ষের সদস্যদের প্রত্যেকের একটি করে ভোট, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট (৬৪টি জেলা সমন্বয় কাউন্সিল থাকলে ৬৪টি ভোট), সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিল সামষ্টিকভাবে একটি করে ভোট দেবে। অর্থাৎ সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই কোনো দলের প্রার্থী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে যাবেন, তা নয়। জেলা ও সিটি করপোরেশন সমন্বয় কাউন্সিলের ভোটও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

অন্যদিকে বিদ্যমান ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে। সেটি কার্যকর হলে অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। ফলে সরকার গঠনকারী দলের বাইরে অন্য কোনো প্রার্থীর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ থাকবে। বিদ্যমান সংবিধানে এই সুযোগ নেই।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে সবকিছুই করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। তার মানে সব ক্ষমতা আসলে প্রধানমন্ত্রীর। এ রকম নিরঙ্কুশ ক্ষমতা যাতে প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকে এবং ক্ষমতার একটি ভারসাম্য থাকে, সে ব্যবস্থা করা উচিত। এ ধরনের প্রস্তাব ইতিবাচক।

সংলাপের অপেক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দফায় যে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে, সেগুলোর মধ্যে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশে সংস্কারের চারটি কমিশন ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এই কমিশনগুলো এখন অভিন্ন সুপারিশ তৈরির কাজ করছে। আর জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, জামায়াতে ইসলামী, কমিউনিস্ট পার্টিসহ (সিপিবি) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের প্রতিক্রিয়ায় কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে কমিশনগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় দলগুলোও সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেয়নি বা তাদের মতামত প্রকাশ করেনি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও অন্য দলগুলোর নেতারা বলে আসছেন, কমিশনগুলো যে সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে, সেগুলো নিয়েই তাঁরা নিজ নিজ দলে পর্যালোচনা করছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং কমিশনগুলোর প্রধানেরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য আনাসহ সব সুপারিশ নিয়ে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। বিএনপিসহ দলগুলোও এখন সেই সংলাপের অপেক্ষার কথা বলছে।