গত বছরের চেয়ে এবার বাড়ছে কোরবানি পশুর সংখ্যা। এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ধরা হয়েছে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার ২৩৫টি (গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া)। চাহিদার বিপরীতে দেশের আট বিভাগে মোট এক কোটি ২১ লাখ ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু মজুদ আছে বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। গত বছর (২০২১) দেশে কোরবানি হয়েছিল ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি।
বিপরীতে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু মজুদ ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। অর্থাৎ প্রায় ২৮ হাজার গবাদিপশু অবিক্রীতই থেকে গিয়েছিল। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কোরবানির চাহিদা ও প্রাপ্যতার হিসাব করলে দেখা যায়, এ বছর প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ গবাদিপশু অবিক্রীতই থেকে যাবে। তবে পশু পরিবহনে চাঁদাবাজি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি হিসাবের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর অভাব না থাকলেও অঞ্চলভেদে চাহিদা এবং প্রাপ্যতা নিয়ে টানাপড়েন রয়েছে। দেশে আটটি বিভাগের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট- এই তিন বিভাগে কোরবানিযোগ্য পশুর ঘাটতি রয়েছে। বাকি পাঁচটি বিভাগে (রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ) চাহিদার চেয়ে বেশি গবাদিপশু মজুদ রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে সবচেয়ে বেশি কোরবানির চাহিদা রয়েছে ঢাকা বিভাগে। এই বিভাগে মোট কোরবানির চাহিদা ২৪ লাখ ৭১ হাজার ১৯৬টি (গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ অন্যান্য)। বিপরীতে প্রাপ্যতা বা মজুদ রয়েছে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫০টি। অর্থাৎ ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৬৪৬টি গবাদিপশু অন্য জায়গা থেকে এনে সংস্থান করতে হবে।
চট্টগ্রাম বিভাগে মোট কোরবানির পশুর চাহিদা ২০ লাখ ৪১ হাজার ৯৮২টি। বিপরীতে এই বিভাগে মজুদ আছে ২০ লাখ ১৯ হাজার ৯০৪টি। অর্থাৎ ২২ হাজার ৭৮টি গবাদিপশুর ঘাটতি রয়েছে। বন্যাকবলিত সিলেট বিভাগে কোরবানির চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে চার লাখ ৩৯ হাজার ৬১২টি। বিপরীতে মজুদ আছে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৮০৩টি। অর্থাৎ এক লাখ ৯৫ হাজার ৮০৯টি গবাদিপশু সঙ্কট রয়েছে; যা আনতে হবে অন্য বিভাগ বা জেলা থেকে।
দেশে সবচেয়ে বেশি গবাদি বা কোরবানিযোগ্য পশু মজুদ রয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এই বিভাগের আট জেলায় ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৪টি গবাদিপশু মজুদ রয়েছে। এবার এই এলাকায় কোরবানির চাহিদা ধরা হয়েছে ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৬৩১টি। অর্থাৎ চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি ( ২৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৩টি) কোরবানিযোগ্য পশু দেশের অন্যত্র বাজারজাত করতে হবে এই এলাকার খামারিদের।
খুলনা বিভাগে গবাদিপশুর প্রাপ্যতা রয়েছে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮২১টি; বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ৯ লাখ ২১ হাজার ৯২১টি অর্থাৎ ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯০০টি গবাদিপশু অন্যত্র বাজারজাত করতে হবে। বরিশাল বিভাগে কোরবানিযোগ্য গবাদিপশু রয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৯টি; বিপরীতে এই বিভাগে চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৭টি, অর্থাৎ এক লাখ ৭৫ হাজার ৮৭২টি গবাদিপশু দেশের অন্য জায়গায় নিয়ে বিক্রি করতে হবে খামারিদের।
একইভাবে রংপুর বিভাগে গবাদিপশুর প্রাপ্যতা রয়েছে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৩২৪টি, কোরবানির চাহিদা রয়েছে ১১ লাখ ২৩ হাজার ২২৩টি; ময়মনসিংহ বিভাগে গবাদিপশুর চাহিদা ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৭১৪টি, বিপরীতে চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৪৩টি। এই দুই বিভাগে গবাদিপশু উদ্বৃত্ত রয়েছে যথাক্রমে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ১০১টি ও এক লাখ ৮৪ হাজার ৬৭১টি।
সরকার এবং খামারিরাসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই যে, অঞ্চলভেদে কোরবানির পশুর প্রাপ্যতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক তা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় নিয়ে পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত মজুদ থাকা গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে নিয়ে বিক্রি করতে হবে খামারিদের।
পশুবাহী পরিবহন বাধাহীন চলাচল ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি : ঈদুল আজহার সময় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পশুবাহী পরিবহন (ট্রাক, লঞ্চসহ বিভিন্ন) চলাচল করে। প্রতি বছরই একই অভিযোগ সড়ক বা নৌপথে গরু বা অন্যান্য পশু নেয়ার সময় নানাভাবে হয়রানির শিকার হন খামারি, গরু ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় তাদের।
আসন্ন ঈদুল আজহার হাটে আসার সময় যাতে চাঁদাবাজির শিকার হতে না হয় এবং স্মুথলি পশুবাহী ট্রাক বা অন্যান্য পরিবহন চলাচল করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ আসে ডেইরি খামারিদের পক্ষ থেকে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফার্মগেটে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও অবাধ পরিবহন নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শাহ মো: ইমরান দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পশু আনার পরিবহন স্মুথলি করার পাশাপাশি চাঁদাবাজির বিষয়টিও তোলেন।
তার সাথে আরো কয়েকজন একই অভিযোগের কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান। সভায় অনেকে জানান, সড়ক-মহাসড়কে হাট বসানোর ফলে যানজটের সৃষ্টি হয়। পশুবাহী ট্রাক হাটে সঠিক সময়ে পৌঁছতে না পেরে ব্যবসায়ী এবং খামারিরা যেমন ভোগান্তির শিকার হন তেমনি ক্রেতারার বেশি দামে কিনতে বাধ্য হন। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব ড. মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী বিভাগীয় কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, দেশে গবাদিপশুর অভাব নেই। এখন দরকার এক এলাকার পশু অন্য এলাকায় অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করা। পশুপরিবহনে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সে বিষয়টিই এখন আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এবারো কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে।
কোরবানির চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত পশু প্রস্তুত আছে। ফলে কোরবানির জন্য কোনো রকম সংশয়, সঙ্কট বা আশঙ্কার কারণ নেই। কোরবানির হাটে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা হবে। রোগগ্রস্ত পশু হাটে বিক্রি করতে দেয়া হবে না। আমরা সুন্দরভাবে আসন্ন ঈদুল আজহা উদযাপন করতে চাই।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারো কোনো খামারি নিজ বাড়ি বা খামার থেকে পশু বিক্রি করলে তাকে হাসিল দিতে হবে না। কোনো খামারি তার পশু দূরবর্তী হাটে নিতে চাইলে, রাস্তাঘাটে জোর করে নামাতে বাধ্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকারের ইউনিট তথা পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এ বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
হাটে আনার পথে কেউ প্রাণী বিক্রি করলে তার কাছ থেকে ইজারাগ্রাহক জোর করে চাঁদা বা হাসিল গ্রহণ করতে পারবে না। এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। নগদ টাকা বহন না করে বিকল্প উপায়ে স্মার্ট পদ্ধতিতে খামারিরা যাতে আর্থিক লেনদেন করতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বলেন, সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে গবাদিপশু কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে গবাদিপশুর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার বিষয়টিও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। কোরবানির সময় যাতে ওই অঞ্চলে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে পশু যেতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার, মো: তৌফিকুল আরিফ ও এস এম ফেরদৌস আলম, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন।