মাঝে কয়েকমাস বন্ধ থকালেও যশোর শহরের বকচর এলাকায় চোরাই গাড়ি বিকিকিনি, যন্ত্রাংশ খুলে ও কেটে বিক্রি করা সিন্ডিকেট ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো চক্রের অনেকে ঘাপটি মারলেও যুক্ত হয়েছে নতুন মুখ। অভিযোগ উঠেছে চলমান সিন্ডিকেট নেপথ্যে থেকে পরিচালনা করছেন রনি নামে এক দোকানি।
১০/১২ জনের একটি চক্র যোগসাজস করে কয়েকজন গ্যারেজ মালিক এবং চোরাই গাড়ি বেচাকেনা করা লোকজনকে সাথে নিয়ে অবাধে এ কারবার করছে। তারা স্থানীয় একটি মহলকে ম্যানেজ করছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি। অর্থলগ্নি করাসহ নেপথ্যে থেকে সিন্ডিকেট পরিচালনাকারী রনি এখন কোটিপতি বনে গেছেন বলেও অভিযোগে প্রকাশ।
আর ওই রনি সিন্ডিকেটে মাসুদ, নাহিদ, এহসান, মহসিনসহ কয়েকজন প্রকাশ্যেই এই কারবারে যুক্ত। চক্রটি অন্য জেলা থেকে চুরি করে আনা বাস ট্রাক যশোরে, আর যশোর থেকে চুরি করা বাস ট্রাক অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করছে একই প্রক্রিয়ায়। আবার বিআরটিএকে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বকেয়া পরিশোধ না করেই কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে ওই গাড়ি কেটে বিক্রি করা চক্রের কাছে। সম্প্রতি পাবনা ডিবি পুলিশ এই চক্রের ডেরা থেকে চোরাই ও কাটা গাড়ির যন্ত্রাংশ উদ্ধার করার ঘটনায় তুমুল হৈচৈ শুরু হয়েছে সিন্ডিকেট ঘিরে।
গোয়েন্দা শাখা ও স্থানীয় একাধিক সূত্র থেকে তথ্য মিলেছে, বছর কয়েক আগে বকচর হুঁশতলা এলাকার ফারুক, ইঞ্জিন মিস্ত্রী ফারুক, জমিলার ছেলে মাসুদ, মুড়লি এলাকার কালু ড্রাইভার, চৌধুরী পাড়া এলাকার কানা ইজাজ, গোপালগঞ্জ জেলার কাঠির বাজার এলাকার মাহফুজ শেখ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, ট্রাক, পিকআপ, প্রাইভেট কার ও কাভার্ড ভ্যান চুরি করে যশোরে আনতেন। আর এগুলো দেয়া হত শহরের বকচর এলাকার কয়েকটি চিহ্নিত গ্যারেজে। এ চক্রের ওই সদস্যরা প্রত্যেকেই গাড়ি চালানোই পারদর্শী ছিলেন।
যশোর ছাড়াও বিভিন্ন শহরে গ্যারেজ মালিকের সাথে ছিল এদের সুসম্পর্ক। অন্য জেলা থেকে চুরি করে আনা ট্রাক যশোরে এনে গ্যারেজে ফেলে খন্ডখন্ড করে বিক্রি করত ওই চক্রটি। চোরাই ট্রাক সিন্ডিকেটে বকচর আবু বক্কর সিদ্দিকীর ছেলে গ্যারেজ কাঠু ওরফে আশরাফুল আলম কাঠু, গ্যারেজ কামরুলসহ অনেকের নাম জোরেসরে উচ্চারিত হত। এখন আর ওই চক্রটির বেশিভাগই মাঠে নেই। এখন এই সিন্ডিকেটে যুক্ত হয়েছে নতুন মুখ। এই নতুন সিন্ডিকেট চিহ্নিত কয়েকটি গ্যারেজে ফেলে চোরাই গাড়ি কেটে অথবা যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করছে। আবার রাতারাতি একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ অবৈধভাবে অন্য গাড়িতে সংযোজন এবং রঙ পরিবর্তন করার কাজটিও করছে চক্রটি।
সূত্র থেকে তথ্য মিলেছে, চোরাই ও পুরোনো গাড়ি বিকিকিনি ও কাটা নয়া সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে অনৈতিক ব্যবসা করছেন মাসুদ, নাহিদ, এহসান, মহসিনসহ আরো কয়েকজন। নেপথ্যে থেকে অর্থলগ্নি করে চোরাই ও পুরোনো গাড়ি বিকিকিনি কর্মকান্ড পরিচালনায় রনি বিভিন্ন লোকের নামে বিভিন্ন মাধ্যমে গাড়ি কিনে যশোরে আনেন। এক সময় ছোট পরিসরে ব্যবসা করলেও এখন বনে গেছেন কোটিপতি। মাসুদকে সামনে রেখে রনি পরিচালনা করেন সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, চোরাই কোনো গাড়ি ধরা খেলে এই রনি গাড়ির মালিককে ম্যানেজ করে চোরদের সরিয়ে দেন। গাড়ি কিংবা যন্ত্রাংশ সব উদ্ধার করার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেও আশ্বাস দেন। চোরাই ও পুরোনো একটি গাড়ি দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকায় কিনে নেয়া হয়। গাড়িগুলো বেশিরভাগ কাটা হয় ভোরের দিকে। অনেক গাড়ির মাঝখানে রাখা হয়, যাতে ওই চোরাই গাড়িটি বাইরের লোক চিনতে না পারে। গাড়ি কাটার পর যন্ত্রাংশ সব বিক্রি করা হয়। চলমান সিন্ডিকেটের নেপথ্যের নায়ক রনি অল্প সময়ে কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
বিভিন্ন লোক মাধ্যমে চোরাই গাড়িগুলো কেনেন আর ধরা পড়লে সেই গাড়িগুলো সামনে এসে নিজে ভদ্রলোক সেজে মিমাংশা করেন। সম্প্রতি রনি চক্রের সদস্য দেলো ও মহসিন দুটি চোরাই ট্রাক সংক্রান্ত মামলায় জড়িয়ে পড়েন। পাবনা ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা। এসময় রনি মধ্যস্থতা করেন। আর চোরাই গাড়ি কাটা হলেও যন্ত্রাংশ সব মাল বুঝিয়ে দেন ওই রনি। আর তার দোকান থেকেই অধিকাংশ যন্ত্রাংশের খোঁজ মেলে বলেও তথ্য এসেছে।
বকচরের ভিকু চৌধুরীর বাড়ির পাশে মহিলা মাদ্রাসার পেছনে চোরাই গাড়িগুলো কাটা হয়। এছাড়া মাসুদ, এহসান, নাহিদ পুলিশ ও সাংবাদিকদের নাম ভাঙ্গিয়ে গাড়িপ্রতি ৫ হাজার টাকা আদায় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অন্য একটি সূত্রের দাবি, যশোরের বাইরে থেকে চোরাই গাড়ি আনেন বকচর মাঠপাড়ার ফারুক। প্রশাসন ও গাড়ির প্রকৃত মালিক চ্যালেঞ্জ করলে আগের পুরোনো কোনো কাটা গাড়ির কাগজপত্র জমা রেখে তা প্রদর্শন করে বাঁচার চেষ্টা করেন। অধিকাংশ গাড়ি চোরাই হওয়ায় বৈধ কোন কাগজপত্র থাকে না। এক্ষেত্রে গাড়িতে জাল কাগজপত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিআরটিএকেও ঠকানো হয়। ফিটনেসবিহীন গাড়ির অনেক বকেয়া না দিয়েই কেটে ফেলা হয়। আর ওই তথ্য বিআরটিএকে না দিয়ে চোরাই কোনো গাড়িতে কাটা গাড়ির কাগজপত্র দিয়ে বিক্রি করা হয়।
এ ব্যাপারে যশোর কেতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক ও ইন্সপেক্টর তদন্ত কাজী বাবুল জানিয়েছেন, বকচর এলাকায় এ ধরনের কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে, যার তথ্য তাদের কাছেও এসেছে। এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিগত সময়ে বেশ কয়েকটি চোরাই গাড়ি উদ্ধারও করেছে। চোরাই গাড়ি বিকিকিনি ও কেটে আমুল পরিবর্তন করে দেয়া গ্যারেজগুলো ও অভিযুক্তদের ব্যাপারেও খোঁজখবর নেয়া হবে। আর যারা ভোল পাল্টে চোরাই গাড়ি বিকিকিনি করে চলেছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ব্যাপারে তারা তথ্যগত সহায়তা কামনা করেছেন।