জুবায়ের হাসান।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নকে ভারতের বিজেপি সরকার কিছুতেই মানতে পারছে না। এ কারণে বিজেপি হয়ে উঠেছে বিশেষভাবে বাংলাদেশবিরোধী। বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যম ক্রমাগতভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু তথা হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে। তারা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধানের নাম বিকৃত করে লিখছে ‘মোল্লা মুহাম্মদ ইউনুস’। আফগান তালেবান নেতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের নামের সঙ্গে মিল রেখেই এমন নামকরণ করা হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং গত ৫ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের লক্ষ্মৌয়ে তিন বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডারদের যৌথ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি ভারতের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডারদেরকে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার নির্দেশ দেন। ওই বক্তব্যে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি উদাহরণ হিসাবে টানেন রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধের কথা। রাজনাথ সিংয়ের এসব কথা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বিরাট হুমকি তৈরি করেছে। গণঅভুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে বলতে গিয়ে ইসরায়েল-হামাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহরণের মাধ্যমে তিনি মূলত বাংলাদেশের জনগণ ও বর্তমান সরকারকে চরম হুমকি দিয়েছেন।
ইসরাইল যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিন দখল করেছে তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্তু রাশিয়া কোন্ অজুহাতে ক্রিমিয়া দখল করল এবং পরে সমগ্র ইউক্রেন দখলের জন্য হামলা করল, সে সম্পর্কে অনেকেই বিশেষ অবগত নয়। ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। পাল্টাপাল্টি বিপ্লবে রুশপন্থী ও পাশ্চাত্য ইউরোপীয়-মার্কিনপন্থী প্রেসিডেন্টদের মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল ঘটছিল।
২০০৪ সালের নভেম্বরে ‘অরেঞ্জ রেভলিউশন’ বা কমলা বিপ্লবের মাধ্যমে ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর ১০ বছর পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাশ্চাত্যপন্থীদের সমর্থনে ইউক্রেনে সংঘটিত হয় ‘ময়দান বিপ্লব’। ক্ষমতাসীন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে যান রাশিয়ায়। এতে ভবিষ্যতে ইউক্রেনে রুশপন্থী কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নিভে যায়; ক্ষিপ্ত হয় রাশিয়া। ফলশ্রুতিতে প্রথমে রাশিয়ার মদদে রুশ সীমান্তবর্তী ইউক্রেনের দোনবাস (লুহানস্ক-দোনেস্ক) অঞ্চলে শুরু হয় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদিতার বা স্বাধীনতার যুদ্ধ। অতঃপর ২০১৪ সালে রাশিয়া দখল করে ক্রিমিয়া। এর কয়েক বছর পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মূল ইউক্রেন দখলের অভিযানে নামে রাশিয়া। কিন্তু সহজে সেটা করতে পারে না।
তবে সেই থেকে এখনো চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এতে ইউক্রেন হারিয়েছে তার ভুমি, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা। রাজনীতিবিদদের মসনদের লোভ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ভোট চুরি, দুর্নীতি, ব্লকপন্থী রাজনীতি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে বিপ্লব আর পাল্টা বিপ্লবে ইউক্রেনের হয়েছে এ পরিণতি। রুশ-ইউক্রেন সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাস করেন রুশভাষী বহু নাগরিক। রাশিয়া একে পুঁজি করেই ইউক্রেনের অভ্যন্তরে গোলযোগ তৈরি করতে পেরেছে এবং অবশেষে ইউক্রেনের কাছ থেকে বিরাট আয়তনের ভূমি দখল করেছে।
যাহোক, বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কথা বলছিলাম। তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন। বরং সুচতুর ও ঝানু রাজনীতিবিদ। শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভোটের রাজনীতির জন্যই বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি সেসব কথা বলেননি। অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠা নিয়ে তিনি যথেষ্ট স্বপ্ন দেখেন। এদিকে বিজেপির শীর্ষ নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বাংলাদেশকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর (২০২৪) ঝাড়খণ্ড রাজ্যের নির্বাচনী জনসভায় তিনি ওই রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে উল্টো ঝুলিয়ে রাখার হুমকি দেন।
এর আগে ২০১৮ সালে তিনি কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ‘উইপোকা’ বলেছিলেন, আরেকবার তাদেরকে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপের হুমকি দেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি বাংলাদেশিদের সম্পর্কে ক্ষোভপ্রকাশের মিছিলে যোগ দেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি গত ২ অক্টোবর ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী ভাষণের সময় কথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পর গত ২৯ অক্টোবর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ঝাড়খণ্ডে নির্বাচনী সফরে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তিনি ভারতীয় গণমাধ্যমকে এএনআইকে বলেন, ঝাড়খণ্ড শিগগিরই মিনি বাংলাদেশ হয়ে উঠবে।
কেননা সেখানে কথিত বাংলাদেশি মুসলমানদের অনুপ্রবেশ ঘটায় তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাতে আদিবাসী সাঁওতাল উপজাতিদের আনুপাতিক সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এর আগে ২০২২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে অখণ্ড ভারত গঠনের জন্য বিরোধী দল কংগ্রেসকে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার ওই বক্তব্য প্রদানের সময় বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতেই রাষ্ট্রীয় সফরে ছিলেন। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হয় না হিমন্ত শর্মার বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ; আর আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও হয় না তেমন সমালোচনা।
এদেশের মিডিয়া হিমন্ত শর্মার উক্তিকে চিত্রায়িত করে ভোটের রাজনীতির কৌশল হিসাবে। এভাবে বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো আড়াল করে ফেলে বিজেপি কিংবা হিমন্ত শর্মার অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার অভিলাষকে। আগামী ১৩ ও ২০ নভেম্বর দুই দফায় ঝাড়খণ্ডের ৮১টি বিধানসভা আসনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আসামের মুখ্যমন্ত্রীসহ বহু বিজেপি নেতা সেখানে নির্বাচনী ময়দান চষে বেড়াচ্ছেন। তারা বলছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কারণে ঝাড়খণ্ডের জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। এ যুক্তিতে তাঁরা প্রকারান্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে দিচ্ছেন নানা রকম উসকানি।
২০০০ সালের ১৫ নভেম্বর ভারতের বিহার রাজ্যের ছোট নাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা নিয়ে গঠিত হয় ঝাড়খণ্ড রাজ্য। বাংলাদেশে সংখ্যায় সর্ববৃহৎ উপজাতি হলো সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। এদেশের সাঁওতালদের আদি নিবাস হলো ঝাড়খণ্ড। সোয়া শত বছর আগে (১৯০০ সালের গোড়াতে) ইংরেজ নীলকরদের সূত্রে অনেক সাঁওতাল তাদের আদি নিবাস ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এসে বসতি গড়তে থাকেন।
এদেশে বহুদিন হল (বিশেষ করে আওয়ামী লীগ আমলে) সাঁওতালদের নিয়ে চলেছে বিশেষ রাজনীতি। তাই ঝাড়খণ্ডে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব কথিত বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের অজুহাত তুলে যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন, তা বাংলাদেশের সাঁওতালদের মাঝেও তৈরি করতে পারে বিদ্বেষ। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারেন এদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর।
বিজেপির রাজনীতিবিদদের বাংলাদেশ সম্পর্কিত এসব বক্তব্যকে আমরা হালকাভাবে দেখতে পারি না। কেননা অতীতে তাদের বক্তব্য বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী ঢাকার একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে আর কখনো দিল্লির রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। এরপর গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) ভারত শেখ হাসিনার সহায়তায় বাংলাদেশকে কীভাবে তার ঔপনিবেশে পরিণত করেছিল, সে ইতিহাস সবারই জানা।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসানের পর বাংলাদেশে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য চলছে নানা ধরনের অপতৎপরতা। জুলাই গণবিপ্লবের পরাজিত শক্তি ও বিজেপি এসব অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের ইন্ধনদাতা। কথিত আনসার বিদ্রোহ, গার্মেন্টস শ্রমিক বিক্ষোভ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মবিরতি ইত্যাদি নানাবিধ দাবি-দাওয়া সম্বলিত আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বিজেপি ও আওয়ামী মহলের উসকানিমূলক তৎপরতা। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আট দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই জাগো জাগো, হিন্দু জাগো স্লোগান দিয়ে সারাদেশে হয়েছে কথিত হিন্দু সমাবেশ। ঐ জাগো হিন্দু সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন বিপুলসংখ্যক আওয়ামী নেতাকর্মী। এভাবে হিন্দু ব্যানারে আওয়ামী লীগ আন্দোলনের নামে ঘটাতে চাচ্ছে বিশৃঙ্খলা, খেলতে চাচ্ছে হিন্দু কার্ড। এদেশের সাধারণ হিন্দুদের বুঝতে হবে এই কুটিল সর্বনাশা আওয়ামী রাজনীতি।
বস্তুত শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ ও বিজেপির দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে এদেশের হিন্দুদের কোনো লাভ নেই। বরং স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠলে তাতে এ দেশের হিন্দুরাও হতে পারেন যথেষ্ট উপকৃত। সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর ভাই-বোনদের বুঝতে হবে বাংলাদেশই তাদের জন্মভূমি। এখানকার মুসলমানদের মতোই বাংলাদেশ তাদের ঠিকানা। এদেশের হিন্দু-মুসলিমসহ কারোরই ঠিকানা আওয়ামী লীগ হতে পারে না। আর আওয়ামী লীগ ও হিন্দু কিছুতেই হতে পারে না সমার্থক। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এদেশে কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদ পুনঃপ্রবর্তনের জন্যই হিন্দুদের ব্যবহার করছে। ফ্যাসিবাদের কোনো ধর্ম নাই। ফ্যাসিবাদী হিটলার প্রথমে নির্মূল করেছিলেন বামপন্থী কমিউনিস্টদের, তারপর খতম করেছিলেন ডানপন্থী প্রতিপক্ষদের। বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি প্রথম ১০ বছর মুসলমানদের কোপালেন, অতঃপর খ্রিস্টান ও শিখদের, এরপর লক্ষ্য হবে দলিত হিন্দুরা, সবশেষে হবে প্রতিপক্ষ উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। এভাবেই ফ্যাসিবাদের কোনো ধর্ম থাকে না। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদীরা শুধু নিজেকেই ভালোবাসে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাত্র কিছুকাল আগেও চীনবিরোধী অনেক বুলি আওড়াতেন। কিন্তু এবারের রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত (২২-২৪ অক্টোবর ২০২৪) ব্রিকস সম্মেলনে দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র। নরেন্দ্র মোদি একেবারে চীনের কোলে উঠে পড়লেন। এর আগে (১৫ অক্টোবর ২০২৪) ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়সংকর ১৬ সদস্যের সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিতে সফর করেছিলেন পাকিস্তান। এভাবে ভারত তার কল্পিত শত্রুদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেছে। কেননা শুধু হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ভারতের বিজেপি সরকার জনগণকে চিরসুখী রাখতে পারবে না।
ভারতের সকল মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির নির্মাণ করলেও তা সম্ভব নয়। এ কারণেই বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির এমন রঙ বদল। বর্তমানে ভারত নিজেই তার সমস্যার ভারে জর্জরিত। যেকোনো দিন, যেকোনো সময় বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হতে পারে গণঅভ্যুত্থান। এমতাবস্থায় ভারতের বিজেপি সরকারের পক্ষে অন্য দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ভাববার প্রশ্নই ওঠে না। ভারতের বিজেপি সরকার দেশে-বিদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী সম্পর্কে উচ্চাভিলাসী চটকদার যেসব কথাবার্তা বলে তা শুধু নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মতলব।
অতএব বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য উচিত কাজ হবে— এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করা ও গণতন্ত্রের মাধ্যমে এ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। জুলাই গণআন্দোলনে বেশ কিছু সংখ্যক হিন্দু শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে এ ধারার আন্দোলনে আরো অনেককে করতে হবে সংযুক্ত। তাদেরকেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে করতে হবে ভারতীয় চক্রান্তের প্রতিবাদ। সেই সাথে ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধেও তাদেরকে হতে হবে সোচ্চার।
অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে নির্ঝঞ্ঝাটভাবে শেষ হতে পেরেছে হিন্দুদের শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব। নির্বিঘ্নে পূজা সম্পন্ন করতে ডক্টর ইউনুস সরকার নিয়েছিল কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা; বাংলাদেশ সেনাবাহিনী করেছে নিরলস পরিশ্রম। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসন ছিল বিশেষ সক্রিয়। বিএনপি ও কয়েকটি ইসলামী দলসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে দিয়েছিলেন বিশেষ সাহস ও নিরাপত্তা। তাই বিজেপি ও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ও উসকানি ব্যর্থ করে দিয়ে এদেশে সফল হতে পারল শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব। এটা ডক্টর ইউনুস সরকারের বিরাট কৃতিত্ব। কিন্তু তারপরও থেমে নেই বিজেপি ও আওয়ামী লীগের চক্রান্ত।
গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামে হিন্দুদের নিয়ে আয়োজন করা হয় বিরাট মহাসমাবেশ। হিন্দু পুরোহিতদের নেতৃত্বে চলে বিশেষ আয়োজন। বুঝতে অসুবিধা নেই যে আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিতেই এ আয়োজন। ওই হিন্দু সমাবেশে একদল দিকভ্রান্তরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ওপরে উড়িয়েছেন হিন্দুত্ববাদের গেরুয়া পতাকা। সনাতন জাগরণ মঞ্চ থেকে ডাক দেয়া হয় ঢাকা লংমার্চ কর্মসূচির। ওই সমাবেশে তারা চেয়েছেন সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন। কিন্তু তাদের চাওয়া উচিত ছিল বাংলাদেশ সুরক্ষা আইন। আসলে এদেশের সাধারণ হিন্দুরা বিজেপির পরিকল্পিত ফাঁদে পা দিচ্ছেন।
মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের উৎসব বা পার্বণ সংখ্যা অনেক বেশি। বলা হয়ে থাকে, হিন্দুদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। সুতরাং এসব পার্বণকে ঘিরে চলমান থাকতে পারে শান্তি-স্থিতিশীলতা বিনষ্টের অপতৎপরতা; ঘটতে পারে অনেক কিছু। হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে উসকে দিতে ইসলাম অবমাননার কৌশল নেয়া হতে পারে। কোথাও পবিত্র কোরআনের মর্যাদাহানি করা হতে পারে, আর কোথাওবা নবীজির (সা:) অবমাননা করা হতে পারে। এসব করে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ করে তোলা হতে পারে। তাই সাধারণ মুসলমানদেরকে ও তাদের ধর্মীয় ইমামদেরকে এমন ফাঁদ সম্পর্কে হতে হবে বিশেষ সচেতন ও ধৈর্যশীল।
চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে এমন কিছু করা একেবারেই উচিত হবে না যাতে তাদেরই হিন্দু প্রতিবেশী ভাই-বোনদের জীবন ও জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এদেশের মুসলমানদের উজ্জল ভাবমূর্তি নষ্ট করাই হল বিজেপি ও আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এজন্যই বিজেপি ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছড়ানো হচ্ছে অনেক গুজব। কিন্তু গুজব সমুদ্রের মাঝেই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে প্রকৃত ঘটনা; সত্য দিয়ে পরাজিত করতে হবে মিথ্যাকে। আর মিথ্যা তো পরাজিতই হয়।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক