বাংলাদেশের জনগণের বিজয় ও ভারতের প্রতিহিংসা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৩, ২০২৪, ১০:১৬ অপরাহ্ণ /
বাংলাদেশের জনগণের বিজয় ও ভারতের প্রতিহিংসা

ভারত, তার বিস্তৃত গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলিতে তার নিয়োগকৃত ক্রিড়ানকদের প্রভুর ভূমিকা পালন করছে। এবং বাংলাদেশ আবারও নিজেকে প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে আবিষ্কার করছে। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক কল্পনা নয়, এটি একটি বাস্তব দাবার ছক, যেখানে নয়া দিল্লি সম্পূর্ণভাবে তার বিশাল উচ্চাকাক্সক্ষা সফল করার লক্ষ্যে একটি পাকা গ্র্যান্ডমাস্টারের মতো নির্ভুলতার সাথে তার গুটিগুলিকে খেলাচ্ছে ভারতীয় কৌশলগত সংস্কৃতিতে গভীরভাবে গ্রোথিত ক্ষমতার অসীম ক্ষুধা নিয়ে, যা ‘অখন্ড ভারত’-এর লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

মোদির গোপন সাম্রাজ্যঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে দেশটির গোপন তৎপরতা অভ‚তপ‚র্ব মাত্রায় বেড়েছে। সংবাদ শিরোনামগুলি সীমানা বহির্ভ‚ত হত্যাকাÐ এবং অতি নির্ভুলতার সাথে কার্যকর করা পুতুল শাসকদের ক্ষমতায় বসানোর ঘটনাতে ভরা।
ভারতের জন্য বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি প্রতিবেশী নয়, এটি ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির তথা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন স্তরে বিশাল অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের বৃহত্তর ক‚টনৈতিক লক্ষ্য অভিষ্ট করার কৌশলগত একটি ক্ষেত্র। ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত করার এই কাজটি প্রাক্তন ‘গণতন্ত্রের কান্ডারী’ থেকে স্বৈরাচারে পরিণত হওয়া শেখ হাসিনা ওয়াজেদের চেয়ে ভাল আর কে করতে পারেন!

ভারতের নিয়ন্ত্রিত পুতুল হাসিনাঃ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মজীবন ১৯৮১ সালে গণতন্ত্রের একজন প্রবক্তা হিসাবে শুরু হয়েছিল। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ১৯৯৬-এর জুন থেকে ২০০১-এর জুলাই এবং ২০০৯-এর জানুয়ারি থেকে ২০২৪-এর ৫ আগস্ট পর্যন্ত সর্বমোট বিশ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

হাসিনার দীর্ঘ মেয়াদ দিল্লি দ্বারা সমর্থিত ছিল, যা একজন ভারতীয় কর্মকর্তার বিবৃতি থেকে স্পষ্ট, ‘অশোভনভাবে বলতে গেলে, তিনি একজন স্বৈরশাসক হতে পারেন, তবে তিনি অন্তত আমাদের।’

ভারতের সাথে হাসিনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে চলে চান, এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর নির্বাহী অজিত দোভাল এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান। হাসিনার নীতি এবং কর্ম ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি নয়, বরং নয়াদিল্লিতে তার পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি অঙ্গীকারগুলোকে প্রতিফলিত করেছে। এই প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন হাসিনা ওয়াজেদ ২০২৩ সালে তার ভারতীয় সমকক্ষদের সাথে দশটি বৈঠক করেন। চীনকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় নেতাদের সাথে ঘন ঘন বৈঠক থেকে শুরু করে তিস্তার পানি সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপ‚র্ণ প্রকল্প ভারতের কাছে হস্তান্তর করার মতো প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে হাসিনার সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে ভারতের আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে।

ভারতের গোপন হাত ও ২০২৪ সালের নির্বাচনী লুটতরাজঃ ২০২৪ সালের নির্বাচন ভারতের হস্তক্ষেপের একটি কলঙ্কজনক প্রদর্শনীর চেয়ে কম ছিল না, যেখানে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা র হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য মারাত্মকভাবে কলকাঠি নেড়েছিল। তবে এটি শুধু একটি কারচুপিপূর্ণ নির্বাচনই ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বুকে ছুরি সেঁধিয়ে দেয়া।

পশ্চিমারা এটি দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ফলে, ভারত এগিয়ে চলেছে এবং হাসিনার শাসনামল ভারতের রাষ্ট্রধর্ম বিস্তারের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে জেঁকে বসেছে। ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ৪হাজার ৪শ’ ৯০টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার ফলে ১হাজার ২শ’ ৫৩ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দ্বারা অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘন সত্তে¡ও, হাসিনা ভারতের পুতুল হিসাবে তার নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য ভারতীয় নেতাদের সাথে এই সমস্যাটির সমাধান করতে ব্যর্থ হন।

নাগরিক প্রতিরোধ ও একটি জাতির পুনরুত্থানঃ প্রতিটি পুতুলের কলকাঠি আছে যা অবশেষে একসময় বিনষ্ট হয়ে যায়। হাসিনার অনুগত ও ভারতীয় দোসরদের সুবিধার জন্য পরিকল্পিত বেসরকারী খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সরকারি খাতের কর্মসংস্থান, তাদের নিয়মিত মজুরি বৃদ্ধি এবং বিশেষাধিকারে পক্ষে জুলাইয়ের ৪ তারিখে হাইকোর্টের কোটা পদ্ধতি পুন:স্থাপনের রায়ের পর বাংলাদেশে অসন্তোষ দানা বাঁধে।

বাংলাদেশের সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সকলের জন্য উন্মুক্ত সরকারি কর্মসংস্থানের সংখ্যা কমিয়েছে, মেধার ভিত্তিতে পদপ্রার্থীদের ক্ষতি করেছে। এটি উচ্চহারের বেকারত্বে নিমজ্জিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, কারণ দেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৩কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান বঞ্চিত।

একসময় বিশ্বের সবচেয়ে দ্রæত বর্ধনশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি ১০শতাংশ এর কাছাকাছি পৌঁছেছে, এবং ডলারের স্থিতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। শান্তিপ‚র্ণ ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে গণঅভ্যুত্থাণে রূপ নিয়েছে, যখন ১৫ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ১শ’ ৮৭ জন নিহত এবং ১হাজরেরও বেশি গ্রেপ্তার হয়েছে। হাসিনা বিক্ষোভকারীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটা প্রত্যাহার করলেও হাসিনার শাসনের প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা দ্বারা উদ্দীপিত আন্দোলন অব্যাহত থাকে, যা এখন ভারত বিরোধী মনোভাবে পরিণত হয়েছে। ‘ইন্ডিয়া আউট অ্যান্ড গো হাসিনা’ আন্দোলন দিল্লির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের একটি শক্তিশালী ঢেউ বাংলাদেশকে একাকার করে দিয়েছে।

জনসাধারণ এবং ছাত্রদের উপর প্রতিটি নৃশংস দমন-পীড়নের মাধ্যমে হাসিনা মোদি ও তার নীতি নির্ধারকদের প্রতি আনুগত্যের যত বেশি প্রকাশ ঘটিয়েছেন, জনগণ তাকে এবং তার বিদেশী প্রভুদের ততবেশি প্রত্যাখ্যান করে অখন্ড ভারতের ধারণা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি এর প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

ভারতের খেলাটি ভুল পদক্ষেপ উন্মোচন করেছেঃ বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশের চেতনাকে অবম‚ল্যায়নকারী ভারতের হস্তক্ষেপ আওয়ামী লীগের কারসাজিতে স্পষ্টভাবে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে, যা ব্যাপক বিক্ষোভের দিকে পরিচালিত করেছে, স্থানীয়রা প্রকাশ্যে ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে।

ভারদের গোয়েন্দা সংস্থা র যত বেশি শেখ হাসিনাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ততই এর হাত থেকে পিছলে গেছে। ‘ইন্ডিয়া আউট অ্যান্ড হাসিনা গো’ আন্দোলন শুধুমাত্র একটি শাসনকে উৎখাত করার জন্য নয়; এটি ছিল বাক স্বাধীনতা, ন্যায়ের জন্য প্রতিবাদ, প্রকৃত স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য।

দিল্লী তার অগ্রাসী ভূ-রাজনৈতিক দাবা খেলায় এতোটাই মগ্ন যে, এর দিকে যে ঝড় ধেয়ে আসছে, তা দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং তার পলায়নের মধ্য দিয়ে এর বহি:প্রকাশ ঘটে।

একটি ব্যর্থ কৌশলের পতন ও প্রতিফলনঃ বাংলাদেশে আন্দোলনের ধুলো থিতু হওয়ার সাথে সাথে ভারত নিজেকে একটি কঠিন মোড়ে আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশে ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক উদ্বেগ নয়; এটি একটি সতর্ক বার্তা; এর সাম্রাজ্যবাদী খেলার পরিণতি। এখন, প্রশ্ন উঠছে, ভারত কি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে, নাকি এটি এমন একটি পথে চলবে, যা তাকে প্রতিবেশী এবং বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁকি রাখে?

‘অখন্ড ভারত’-এর লক্ষ্য ভারতকে আরও মরিয়া করে তুলতে পারে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশটিকে সম্প্রীতি বা আরও বিভাজনের দিকে নিয়ে যাবে কিনা, তা সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন তার নেতাদের উপর নির্ভর করে। কারণ এখন তাদেরকে দ্রæত পরিবর্তনশীল বিশ্বে ভারতীয় ‘রাষ্ট্রধর্ম’-এর প্রকৃত অর্থ পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

বাংলাদেশীদের, বিশেষ করে ছাত্র নেতাদের অবশ্যই ভারতীয়দের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে যে, ভারতের নেতারা এবং দেশটির ম‚লধারার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে এবং সম্ভাব্যভাবে ভেড়া সেজে নেকড়ে হিসেবে কাজ করছে না তো?