বাংলাদেশের টাকায় বন্দর চালাবে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ৮, ২০২৫, ৯:৪০ অপরাহ্ণ /
বাংলাদেশের টাকায় বন্দর চালাবে দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড

চট্টগ্রাম বন্দর এবং এই বন্দরের ‘হৃদপিন্ড’ খ্যাত নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। এনসিটি’র পরিচালনা দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক বিদেশি কোম্পানিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় প্রস্তুতি-প্রক্রিয়া চলছে। এই পদক্ষেপ কী জরুরি হয়ে পড়েছে? তার আদৌ কী প্রয়োজন আছে? তাতে লাভ কী ক্ষতি কী? এসব বিষয় নিয়ে সচেতন নাগরিক মহলে, পোর্ট-শিপিং সার্কেলে এপিঠ-ওপিঠ আলোচনা-সমালোচনা ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।

খবর পাওয়া গেছে, এরইমধ্যে ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাধিকবার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে যান্ত্রিক বিভাগসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে গেছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন কোম্পানিটির ভারতীয় নাগরিক। যদিও এখন পর্যন্ত তাদের সাথে এনসিটি হস্তান্তরের কোনো চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। এ নিয়ে বন্দর-ডক শ্রমিক কর্মচারীদের মাঝে আছে চাপা ক্ষোভ-অসন্তোষ। তাছাড়া পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে বন্দরের এনসিটি পরিচালনা ছেড়ে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল তা বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের সময়ে কেন বাস্তবায়ন হতে চলেছে, সেই প্রশ্নও উঠেছে রাজনৈতিক মহল, শ্রমিক সংগঠনসমূহ, বন্দর-শিপিং সংশ্লিষ্টদের মাঝে।

পোর্ট-শিপিং সার্কেলে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী কথাবার্তা উঠে আসছে, প্রত্যাশার নিরিখে এনসিটি তথা চট্টগ্রাম বন্দর কী দিয়েছে বা দিতে পারছে দেশ ও জনগণকে? কীভাবে ‘ব্যর্থ’ হলো এনসিটি? অর্থাৎ বন্দরের সার্বিক অবদানের প্রশ্নটিই এসে যায়।

চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয়Ñ দেশের হৃদপিন্ড। অর্থনীতির লাইফ লাইন। দেশের প্রধান এই সমুদ্র বন্দরের থিম বা প্রতিপাদ্য স্লোগান হলোÑ ‘কান্ট্রি মুভস উইথ আস’। ‘সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর।
বঙ্গোপসাগরের কোলে ও কর্ণফুলী নদীর মোহনায় মিলিত চ্যানেলে প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম কালক্রমে গড়ে উঠেছে হাজার বছরের গৌরবময় ও সমৃদ্ধির ইতিহাস ধারণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানির ৯০ শতাংশই সম্পন্ন হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। বিশেষত কন্টেইনার-বাণিজ্যের পুরোটাই সামাল দেয় চট্টগ্রাম বন্দর। প্রধান এই বন্দরকে কেন্দ্র করে শিপিং, কাস্টমস, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, স্টিভিডোরিং, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিসহ চট্টগ্রামে শুধুই নয়; সমগ্র দেশে হাজারো ধরনের খাত, উপখাত, লিংকেজ ব্যবসা-বাণিজ্য, শ্রম-খাত পরিব্যাপ্ত। এরজন্যই বলা হয়ে থাকে ‘বন্দর বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে’।

চট্টগ্রাম বন্দর যদি দেশের অর্থনীতির ‘হৃদপিন্ড’ হয়; সে ক্ষেত্রে বন্দরের হৃদপিন্ড হচ্ছে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। এর সাথে রয়েছে চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), জেনারেল কার্গো বার্থ (জিসিবি), পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ২০০১ সালে নির্মাণ করা হয় নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ২০০৫ থেকে আংশিকভাবে এবং ২০১৫ সালে এনসিটি পুরোদমে অপারেশনে যায়।

নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল এনসিটি’র প্রধান দু’টি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক. এনসিটি নির্মিত হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ২ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে। চবক-এর প্রতিবছর অর্জিত মুনাফা থেকে এই ব্যয় মেটানো হয়েছে। তদুপরি এনসিটি’তে ব্যবহৃত সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিদেশ থেকে ক্রয় বা সংগ্রহ করা হয়েছে তাও চবক-এর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। তাতে এ পর্যন্ত বন্দরের ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে এক কানাকাড়ি সরকারি রাজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হয়নি। সর্বশেষ গত ৫ জুন চীন থেকে ১২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে সংগ্রহ করা আরও ১৫টি আধুনিক প্রযুক্তির স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার বন্দরের সিসিটি-এনসিটি’র যান্ত্রিক সরঞ্জাম বহরে যুক্ত হয়েছে।

দুই. চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ধারাবাহিকভাবেই গত ১৭ বছর ধরে আয় বৃদ্ধির রেকর্ড, কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা বা হার বৃদ্ধি, জাহাজ অপারেশনে দ্রুততা ও জাহাজের গড় অবস্থানকাল মাত্র এক দিনে নামিয়ে আনাসহ দক্ষতা ও সক্ষমতার সবক’টি প্যারামিটার বা সূচকে অগ্রগামী রয়েছে। এর ফলে এনসিটি বন্দরের সবচেয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, লাভজনক ও সক্ষমতাসম্পন্ন স্থাপনা। এমনকি বন্দরের নিজস্ব টাকায় পর্যাপ্ত আধুনিক প্রযুক্তির ভারী যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম (ইকুইপমেনটস) সংগ্রহের ফলে কী গ্যানট্রি ক্রেন, রীচ স্টেকার, স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ারের মতো ইকুইপমেন্টস প্রয়োজন বা চাহিদার তুলনায় বেশিই রয়েছে। এনসিটিতে বর্তমানে যে পরিমান যান্ত্রিক সরঞ্জাম রয়েছে তা দিয়েই আগামী ১৫ বছর অনায়াসেই এনসিটি পরিচালনা করা সম্ভব। এর ফলে এনসিটিতে নতুন কোনো দেশি কিংবা বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনই নেই।

বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি (এনসিটি) সুপার স্ট্রাকচার সমৃদ্ধ একটি আন্তর্জাতিকমানের টার্মিনাল। এটি প্রকৃত সক্ষমতার চেয়ে বেশি সেবা দিতে সক্ষম হয়েছে গেল বছরেও। আবার এনসিটি সম্প্রসারণেরও কোনো সুযোগ নেই, যেহেতু এনসিটি’র লাগোয়াই রয়েছে নেভির গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ফলে এনসিটিতে আর নতুন করে বিনিয়োগের কোনো সুযোগই নেই।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারিত প্রকল্প বে-টার্মিনাল, লালদিয়ার চর টার্মিনালের কাজ বিদেশি অপারেটরের হাতে দেয়া নিয়ে কোনো আপত্তি কেউ করছে না। কেননা সেখানে জেটি-বার্থ নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ এবং সুপার স্ট্রাকচার আনার অনেক সুযোগ রয়েছে। যার কোনকিছুই এনসিটিতে আর অবশিষ্ট নেই।
আরো বড় আরো বেশি জাহাজ?

বন্দরের এনসিটির জেটি-বার্থে কন্টেইনার জাহাজ ভিড়ার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য ড্রাফট (জাহাজের নিচে পানির অংশ) সাড়ে ৯ মিটার এবং দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১৭০ থেকে ১৯০ মিটারে সীমিত। সে ক্ষেত্রে যথেচ্ছ আরও অধিক ড্রাফটের বা বৃহাদাকার জাহাজ ভিড়ার মতো কোনো গভীরতা নেই। তাও আবার জোয়ার-ভাটার নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণ করেই এবং দক্ষ পাইলটিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই জাহাজ আসা-যাওয়া করতে হয়। উল্লেখিত দু’টি প্রাকৃতিক কারণ বা নিয়মের সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে এনসিটি-সিসিটি-জিসিবি’তে আরও বেশিহারে এবং বৃহাদাকার জাহাজ অপারেশনের সুযোগ নেই। আবার নির্দিষ্ট আকারের জাহাজ ও নির্দিষ্ট সময়ে আসা-যাওয়ার সংখ্যা (শ্লট) বাড়াতে গেলে বন্দরে জাহাজের জট ও কার্গোজট সৃষ্টি হবে অনিবার্য সমস্যা হিসেবে।

যুক্ত হলো আরো ১৫টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন আরও ১৫টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার (কন্টেইনার হ্যান্ডলিং-এর ভারী ইকুইপমেন্টস) এসে পৌঁছালো গত ৫ জুন। চীন থেকে সংগৃহীত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এসব যান্ত্রিক সরঞ্জাম ‘চে ইয়াং’ নামে হংকংয়ের একটি জাহাজযোগে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে। সিসিটি-এনসিটি বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে হস্তান্তর করে পরিচালনার যে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া চলছে, সেই টার্মিনালের ইয়ার্ডেই এসব স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার সংযোজন হবে। এতে টার্মিনালের সক্ষমতা ও গতি আরো বাড়বে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বছর বছর সঞ্চিত মুনাফা বাবদ নিজস্ব অর্থায়নে ১৫টি স্ট্রাডেল ক্যারিয়ার চীন থেকে ক্রয় করা হয়েছে; যার মূল্য ১২৬ কোটি ১০ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। বন্দরে আগে ৪৫টি স্ট্যাডেল ক্যারিয়ার ছিল। নতুন ১৫টি যুক্ত হওয়ায় এ সংখ্যা বেড়ে হলো এখন ৬০। এই ৬০টি স্ট্যাডেল ক্যারিয়ার বন্দরের নিজস্ব টাকায় কেনা। প্রসঙ্গত ২০২৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি কয়েক কিস্তিতে উক্ত ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করে।

অর্থাৎ বিদেশি অপারেটর যারাই আসবে বন্দরের টাকায় কেনা এসব ভারী ও দামি সরঞ্জাম ব্যবহার করার মহাসুযোগটি রেডিমেইড পেয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো বিনিয়োগ করতে হচ্ছে না। তার মানে দাঁড়ায় বন্দরের টাকায় তৈরি সুপরিসর কন্টেইনার স্থাপনা (এনসিটি ও এর সাথে ইয়ার্ড) এবং বন্দরের টাকায় ক্রয় করা যান্ত্রিক সরঞ্জামসমূহ (ইকুইপমেন্টস) দিয়েই ডিপি ওয়ার্ল্ড চালাবে বন্দর।

এনসিটি বিদেশি কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার এবং চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের (সাবেক সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবির দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক, স্বয়ংসম্পূর্ণ আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ স্থাপনা হচ্ছে এনসিটি। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এনসিটি ও তার ইয়ার্ড এবং বন্দরের টাকায় কেনা যন্ত্রপাতি দিয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটি পরিচালনায় ছেড়ে দেয়া অযৌক্তিক। এটা বন্দর তথা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। যা কোনোমতেই হতে দেয়া যায়না।