“বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে আমাদের শার্শা’’


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪, ৯:২৬ পূর্বাহ্ণ /
“বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে আমাদের শার্শা’’

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে আমাদের শার্শা’’

ম,আ,সালাম গফফার ছন্দ

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে আমি এস এস সি পরীক্ষার্থী! সারসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের আমি প্রথম এস এস সি ব্যাচের পরীক্ষার্থী! এপ্রিলের ৩ তারিখে পরীক্ষা! এ কারণে প্রস্তুতিটা অনেক বেশি! পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা! পাকিস্তানের সামরিক শাসক মানবরূপী দানব ইয়াহিয়া খান ও তাঁর দোসর’রা জন নির্বাচিত ৯৯% ভাগ ভোটপ্রাপ্ত, সংখ্যা গরিষ্ঠ দল আওয়ামীলীগের জন নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের টাল বাহানা শুরু করে! ফলে শুরু হয় আন্দোলন মিছিল মিটিং নানা কর্মসূচী!দেখতে দেখতে এমনি অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে এলো মার্চের ২৫ তারিখ! দীর্ঘ আলোচনা চলে আসছে পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর সাথে! পশ্চিম পাকিস্তানের ২য় বিজয়ী দল ও দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো!মাসের পর মাস কনফারেন্স চলে আসছে! আজো চলবে বিরতিহীন ভাবে! সংঘ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান! কিন্তু বাধ সেধেছেন পাকিস্তান পিপুলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো! তাঁকে গোপনে গোপনে ইন্ধন দিতে থাকেন ইয়াহিয়া খান!ফলে আলোচনায় সুফল এলোনা! অমিমাংশিত অবস্থায় আলোচনা রাত ১১ টার পর ভেঙ্গে গেল! বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীরাও! ভুট্টোর গোঁয়ার্তুমির কারণে এত দিনের আলোচনা সব ভন্ডুল হয়ে গেল! শেষ অবদি কুচক্রি ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর চক্রান্তে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান টিক্কা খান গভির রাতে পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়! এর পর পরই ঘুমন্ত মানুষের উপর চালালো নির্বিচারে গুলি! ২৫মার্চ রাতে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে সামরিক জান্তারা করল হত্যা!নর ঘাতকদের নারকীয় কর্ম কান্ডের মধ্য দিয়ে এক সময় রাত শেষে এলো ২৬ মার্চ! রাজধানী ঢাকা ছেড়ে নারী পুরুষ পালাতে লাগল নির্বিশেষে! বাংলার আকাশ বাতাস বেদনায় মুহ্যমান! রাজধানী মিলিটারীর পদ ভারে প্রকম্পিত! পরিবেশ রীতিমত নৈরাজ্য বিভীশিখা! আমাদের একটি সিটিজেন  ট্রান্সজিস্টার ছিল। তা জুড়তেই সহসা সাধারণ চট্টগ্রাম(কালুর ঘাট)বেতার কেন্দ্র থেকে শুনতে পেলাম স্বাধীনতার ডাক! বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ডাক দিলেন মেজর জিয়া! শুরু হল মুক্তি যুদ্ধ,স্বাধীনতা যুদ্ধ! ৩রা এপ্রিল এস এস সি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন না করে ঝাঁপিয়ে পড়ি মুক্তি যুদ্ধে! চলল নয় মাস! লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত আর মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর শত্রু মুক্ত হলো আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ!

২৬ মার্চ ১৯৭১

২৫ মার্চ কালো রাত্রি অতিক্রান্ত হবার পর এলো ২৬ মার্চ ১৯৭১! দেশব্যাপী চলছে অরাজক কাণ্ড! জাতি দিগ্বিদিকদিশেহারা! ঢাকা শহর থেকে নির্বিশেষে নারী পুরুষ ছুটে পালাচ্ছে গ্রামের দিকে জীবন বাঁচাতে! পূর্ব পাকিস্তানে জারি করেছে সামরিক আইন মার্শাল’ল! সমগ্রদেশে ছড়িয়ে পড়েছে পাকিস্থানী সেনারা! ট্যাঙ্ক,কামান মর্টার ইত্যাদি মারনাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের উপর! সহসা চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এলো‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’! মেজর জিয়ার সেই স্বাধীনতার ঘোষণাটি চট্টগ্রাম বেতার থেকে মুহুর্মুহু প্রচারিত হচ্ছিল! ঘোষনার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের ছাত্র, শিক্ষক, কামার, কুমোর, জেলে, তাতি, কৃষক শ্রমিক-সহ দলমত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে! পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একের পর এক ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের সকল জেলা ও থানায়! সকল ক্যান্টনমেন্ট সেনা ব্যারাক ছেড়ে পাকিস্তানী হানাদাররা আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যশোর ক্যান্ট্রনমেন্ট থেকে সেল, মর্টার, কামান, হেভি ম্যাসিনগান প্রভৃতি ফায়ার করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে ঝিকরগাছা এবং সারসার দিকে! দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্বর্ণপ্রভা জেলা আমাদের এই যশোর! পাক হানাদার বাহিনি খুব দ্রুত গতিতে ঝিকরগাছা হয়ে সারসা’র নাভারণে এসেঘাঁটি গাড়ে! পাক হানাদার বাহিনির সেল, মর্টার নিক্ষেপ এবং শক্তিশালী কামান দাগার ভয়াবহ শব্দে যশোর বাসি ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায়! চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গ বন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনাটি পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর প্রচারিত হতে থাকে! তখনো আমরা বুঝতে পারিনি দেশে কি হচ্ছে! ঢাকা বেতার শুনে আমরা যশোরবাসি তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না দেশের চিত্র! তবে ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনার বাক্যটি যারা শুনছেন তারা বুঝতে পারছেন যে,পাকিস্তান সেনা বাহিনির বিরুদ্ধে লড়াই বা সংগ্রা্ম, মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! আর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ শুনে!

!! ২৭ মার্চ ১৯৭১ !!

২৭ মার্চ সকাল হতে না হতেই পাক হানাদার বাহিনি সারসার নাভারণ ঘাঁটি থেকে মর্টার শেল কামান দাগতে দাগতে সারসা থানা সদরে; সেখান থেকে বেনাপোল মুখী অ্যাডভ্যান্স করে! যাত্রা পথে তারা সামনে যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করে নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে! উল্লেখ্য, যশোর ক্যান্ট্রন্মেন্ট ছেড়ে যাওয়ার সময় যশোর শহরে প্রতিরোধ মুক্তি বাহিনির সঙ্গে তুমুল লড়ায় হয়! লড়ায়ে শহীদ হন যশোরের কৃতি সন্তান ফটো সাংবাদিক শফি ভাই! যার ক্যামেরায় ধরা পড়ে আছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যার দৃশ্য! শফি ভাই যশোর শহরে নিহত শহীদদের লাশের ছবি জীবন-বাজি রেখে তোলেন নির্ভীকচিত্তে! পরবর্তীতে পাক-হানাদার শকুনেরা হত্যা যজ্ঞ চালাতে চালাতে ঝিকরগাছা অতিক্রম করে সারসা’য় ঢুকে পড়ে! সারসায় এসেই অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে! কিন্তু সেই মুহূর্তে সে সকল দৃশ্যের ছবি তোলার কোন সাংবাদিক ছিলেন না সারসায়! পাক হানাদার বাহিনি ঝিকরগাছা’র চৌগাছা, ছুটিপুর, বেনেয়ালি, দেউলিগোডাউন অপরদিকে সারসার নাভারণ, সারসা, বেনাপোল এবং বাগআঁচড়া’তে স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে  সারসার দোসরদের নিয়ে বৈঠক করে! তারপর পাক সেনা ও তাদের দোসররা শুরু  করে ধরপাকড়! সারসার সুবর্ণ খালি গ্রামের তবিবর রহমান ওরফে তবি খা, সারসার নিরীহ মানুষ যাকে ‘ছোটখোদা’ বলে আখ্যায়িত করেছিল, সেই ‘দুর্ধর্ষ তবি খা’ ছিল পাক সেনাদের রাজাকারদের প্রধান! পাক হানাদার বাহিনির নাভারণ পিস কমিটির  প্রধান! এক কথায় পা’ চাটা কুকুর! তবি খার ডানহাত ছিল সারসা’র কেরালখালি গ্রামের আরেক দুর্ধর্ষ হবিবুর রহমান অরফে হবি! মুক্তি যুদ্ধের অনুসারিদের ধরে এনে পিস কমিটির নেতা তবি খার কাছে দিলে সে নিজে কবি-খেচুড়গেয়ে নির্যাতন  চালাত কিংবা হবিকে হুকুম করত! তখন হবি, চালাত শারিরীক নির্যাতন! এ ভাবেই চলতো তবি খার কর্মকান্ড! পাকবাহিনি তবি খা’র নির্দেশ ও পরামর্শে সারসা’র মুক্ত এলাকার গ্রাম গুলোতে রাজাকার ও পাকসেনা পাঠাতে লাগল! তারা চিহ্নিত গ্রাম গুলিতে হানাদার পাঠাতে থাকে! রাজাকার,পাকসেনারা ৪০/৪৫ কখনো কখনো ১১০/১১৫ জনের দলনিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারি পরিবারের বাড়িতে যেয়ে কেরোসিন ঢেলে চালে আগুন ধরিয়ে দিতে লাগল! এর জ্বলন্ত স্বাক্ষী আমি নিজে! আমাদের গ্রামেও সেদিন হানাদেয় পাক হানাদার বাহিনি! পাঠিয়েছিল সেই হবি!  ১১৪ জনের একটি বাহিনি আমাদের গ্রাম কেরালখালি’তে হানা দিয়েছিল, যাদের মধ্যে ১৪ জন ছিল খানসেনা! এ দলের কমান্ডার ছিল সুবর্ণখালি’র কুখ্যাত রাজাকার ইন্তাজ আলি! সে ছিল এই বাহিনির কমান্ডার! কেরালখালি গ্রামে ঢুকেই ওরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়! এক ভাগ দক্ষিণ পাড়ার জামে মসজিদে যাবার সড়ক দিয়ে অন্য ভাগ আমাদের পুকুরপাড়ের উত্তর সড়ক দিয়ে! আমি খালিগায়ে পুকুরের রাস্তা দিয়ে আমিনুদ্দিনের বাড়ির সামনে উঠতেই রাজাকার ইন্তাজ ধরে ফেলে হাতের বেত দিয়ে শপাং শপাং শব্দে সজোরে পিঠের উপর মারে! মার্চের ২/৩ তারিখের দিকে নাভারণ থেকে হানাদার বাহিনি ও তাদের দোসররা সুবর্ণখালি গ্রামে এসে আস্তানা গাড়ে! এপ্রিলের ৭ তারিখে আমরা জন পঞ্চাশেক মুক্তিযোদ্ধা ঝিকরগাছা’র শিমুলিয়ায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিরোধ সৃষ্টি করি, আমি জলিল মামার সাথে মিলেছি; এ দলে আমার প্রতিবেশি বড় ভাই সিরাজুলও আছেন! কিন্তু আমরা নিরস্ত্র থাকায় হানাদার বাহিনির সামনে টিকতে না পেরে পিছু হটে আসতে বাধ্য হই! এরপরে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভারতে চাপাবাড়িয়া যাই। ট্রেনিং শেষে ফিরে আসি নিজ এলাকায় এবং সারসা থানা’র নিজামপুর, লক্ষ্মণপুর ও ডিহি ইউনিয়নের মুক্ত এলাকায় দৃঢ় অবস্থান নেই! আমাদের নেতৃত্তে ছিলেন মুক্তি যোদ্ধা শাহজাহান কবির, ঝিকরগাছা থানার ‘পাল্লা’ গ্রামের বীর মুক্তি যোদ্ধা আব্দুল জলিল! কেরালখালি গ্রামের শেখ ফজলুর রহমান ও লটাদিঘি’র বিহারীলাল ওরফে গোসাই! এছাড়াও আমাদের গ্রামের উত্তরপাড়া’র মকসেদ আলি ভায়ের বৈঠক খানায় মুক্তি যোদ্ধা ক্যাম্পে থাকতেন মোজাফফর হোসেন, আবু জাফর, ফুলশর গ্রামের নাসির ভাই, শিববাস’র আব্দুর রশিদ, ডিহি’র নূর মোহাম্মদ, কেরালখালি’র আঃ রহমান, রামচন্দ্রপুর গ্রামের আব্দুল মান্নান, আনসার আলী ও আমি! আমাদের ক্যাম্পে ১৭/১৮ জন মুক্তি যোদ্ধা সব সময় অবস্থান করতাম! আগেই বলেছি ক্যাম্পটা কেরালখালি গ্রামের মকছেদ আলি ভায়ের বাড়ি! অপর দিকে মুক্তি যোদ্ধা ক্যাম্প ছিল নিশ্চিন্তপুর গ্রামের মোঃ ওমর আলি চাচা’র বাড়িতে! তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন! এ ছাড়া গোড়পাড়া গ্রামের কলোনি পাড়া, সাড়াতলা বাজার, পাকশিয়া, ট্যাংরালি, শালকোনা, শিকারপুর প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প ছিল! আমাদের দলের সাথে অস্ত্র ছিল মাত্র একটি ‘থ্রি নট থ্রি’রাইফেল আর গোটা কতক গ্রেনেড!ঝিকরগাছা’র পাল্লা গ্রামের আঃ জলিল(মামা)’র কাছে এল এম জি(শর্ট মেশিন গান)!শেখ ফজলুর রহমান (মামা)’র কাছে থাকত একটি এস এ লার! শ্রদ্ধেয় শাহজাহান কবির, ঝিকরগাছা’র বায়সা নিবাসি শ্রদ্ধাভাজন মোঃ দাউদ হোসেন, যিনি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ফিল্ডমার্শাল মোঃ আইয়ূব খানের সময়ে ১৯৬২/৬৩’র দিকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছেন; তিনি জেলও খেটেছিলেন আইয়ুব খানের আমলে! শিমুলিয়ার গোপিনাথপুর গ্রামের মোঃ ইসমাইল হোসেন, চাঁপাতলা গ্রামের অলিয়ার রহমান, বামনহাটী গ্রামের আব্দার হোসেন ভাই এবং ঝিকরগাছা’র বারাকপুর গ্রামের আমজাদ হোসেন (যিনি দেশ স্বাধীনের পর আমার ভাইজী জামাই হয়েছেন)! আমাদের সেক্টর ছিল ০৮নং সেক্টর কিন্তু আমি ট্রেনিং করেছি ৯ নং খুলনা সেক্টরের অধীনে টাকী ট্রেনিং সেন্টারে! ফিরে এসে আমি আমার এলাকা ৮ নং সেক্টরে অংশ নিয়েছি। আর এ সেক্টরের দায়িত্তে ছিলেন মেজর এন হুদা! সেক্টর হেড কোয়ার্টার বয়রা। আর শাখা অফিস ছিল সারসা’র কানাইনগর গ্রামে! এটা তখন অত্যন্ত নিরাপদ ছিল। যার অবস্থান সারসা-ঝিকরগাছা থানার বৃহৎ বিল বন-মাদার’র মধ্যবর্তী এবং পুটিমারী বিলের উত্তরে! এখান থেকে ভারতের কুড়ুলিয়া বয়রা’র  সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা হতো নৌকা যোগে! আমি বেশির ভাগ সময়ে পাল্লার রকেট জলিল ও গোঁসাই’র সাথে থাকতাম! আঃ জলিল (মামা) ই পি আর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)এ ছিলেন! তার সঙ্গি গোঁসাই’র পুরো নামটা বিহারীলাল! তবে আমাদের দলে গোসাই নামেই বেশি পরিচিত ছিল! সে ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং একগুয়ে! রকেট জলিলের এল এম জি মাঝে মধ্যে সেই কাঁধে করে বহন করত! যার ওজন ছিল ২০ কে জি’র মত! ওর কাধে আর থাকত এক ব্যাগ গুলি! অধিকাংশ সময়ে আমি আঃ জলিল মামা ও গোসাই’র সাথেই থাকতাম! আমার কাছে গোটা চারেক গ্রেনেড কোমরে আর হাতে থাকত একটা! দিন ভ’র এম্বুসেই কাটত! নিশ্চিন্তপুর গ্রামের উত্তর দিকে বেতনা নদী! মাঝ দিয়ে ফাঁকা! এর মাঝ দিয়ে শিয়ালঘোনা, ধানপোতা রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে চলে গেছে! এই ফাঁকা অংশ দিয়ে খান সেনাদের সাজোয়া গাড়ি চলাচলও দেখা যায়! নিশ্চিন্তপুরের উত্তর দিকে বেতনার তীরে বিশ্বাসদের একটা বড় আমবাগান! এরই পাশে আরও উত্তর পশ্চিম দিকে বেতনার বাঁকা ঢালে অবস্থান নিয়ে এম্বুস করা হ’ত  শত্রু’র পানে! সেদিনের এক ঘটনা, এম্বুস নিয়েছি! সামনে জলিল মামা, তার পিছনে গোঁসাই এবং সবার পিছনে আমি! পঞ্চাশ হাত দূরে! হানাদার বাহিনি পাক-সেনাদের গাড়ি চলাচল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! মামা রেডি! তারপর উনি যেই ফায়ার করেছেন! অমনি পাকিস্তানি সেনারা সাজোয়া গাড়ি থেকে হেভি মেশিনগানের ফায়ার করতে লাগল বৃষ্টির ন্যায়! আর সে সব গুলি এসে পাশের আমবাগানের অপজিটে বাঁশবাগানের উপর এসে পড়তে লাগল! ততক্ষণে আমরা ছুটে বড় বসন্তপুর গ্রামে এসে পড়েছি! ‘রকেট জলিল’ খুব দ্রুত ছুটতে পারতেন এবং অত্যন্ত সাহসী। তিনি এখনো জীবিত আছেন! আমদের সারসা’র সকল মুক্তি যোদ্ধাদের মধ্যে সেই দ্রুত মানব,সকলেই স্বীকার করে থাকেন একবাক্যে! মুক্তি যোদ্ধা নজরুল ইসলাম,বাড়ি সারসা’র বুঝতলা গ্রামে তিনি থাকতেন একঝালায় মোজাম্মেল স্যারদের বৈঠক  খানায়! লক্ষ্মণপুরের বড়ভাই মহিউদ্দিন ও ছোটভাই মহিউদ্দিন(দুই জন) তাদের দল বল সঙ্গিদের নিয়ে লক্ষ্মণপুর ক্যাম্পে থাকতেন! পূর্বেই বলেছি, পাক-সেনারা ঝিকরগাছা’র ছুটিপুর, ঝিকরগাছা সদর, শিমুলিয়া, বেনেয়ালি, দোসতিনা, দেউলি গোডাওন, সারসা’র নাভারণ, সুবর্ণখালী, সোনানদীয়া গাতীপাড়ার আমবাগান, বাগ-আঁচড়া, সারসা সদর, কাগজপুকুর ও বেনাপোলে শক্তঘাঁটি গেড়েছে! মুক্তি ফৌজদের গেরিলা আক্রমনের চোটে পাকসেনারা রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছে! আমাদের গেরিলা হামলায় বলতে গেলে শত্রু সেনারা নাজেহাল! উত্তর সারসা’য় এক রকেট জলিল মামা’র ঠেলায় বাদর নাচ নাচতে লাগল! জলিল মামার আক্রমন চোখে না দেখলে তা বোঝানো মুশকিল! পাক-হানাদার বাহিনি ও তাদের দোসরদের উপর আচমকা গেরিলা আক্রমন করে চোখের পলকে স্থান ত্যাগ করতেন! তার যোগ্যতা-সক্ষমতায় আমরা হিমসিম খেয়ে যেতাম! আর এ কারণে এলাকা বাসি ‘রকেট জলিল’ নামে অভিহিত করে! রকেট গতিতে তিনি ছুটে পালাতেন সে জন্যে ওই নাম দিয়ে ছিল! তার ছুটে পালান ঠিক ‘কাঁচকে’ মাছের মত! তার সাথে আমাদেরও প্রাণান্ত হতে হ’ত!

 ‘যশোর ক্যান্ট্রনমেন্ট’

বঙ্গবন্ধু’র ৭ ই মার্চের ভাষণের পর যশোর ক্যান্ট্রনমেন্টে বাঙালি রেজিমেন্ট’র অগোচরে পাকসেনারা একটি গোপন বৈঠক করে! এ বৈঠকের সংবাদ আমাদের বাঙ্গালী সৈনিকরা মোটেই জানতেন না! সেদিন বিকাল ৪টা! আনোয়ার সাহেব (অস্ত্রাগারের কোত কমান্ডার)এর নিকট ব্রিগেডিয়ার (পাকসেনা) অস্ত্রাগারের চাবি চান! তারিখটা  সম্ভবত ২৭ মার্চ বৈকাল ৪টা ৩০মিনিট হবে! আনোয়ার সাহেব চাবি দিতে অস্বীকার করায় ব্রিগেডিয়ার তাকে গরম দিয়ে ফিরে যান যশোর ক্যান্ট্রনমেন্টে! এ ঘটনার আধাঘন্টা পরে পাকিস্তানি ফ্লাগধারি একটি গাড়ি এসে হাজির হয় এবং আনোয়ার সাহেবকে বলে, কোতের চাবি দাও! আনোয়ার সাহেব আগের মতই চাবি দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে অ্যাটেনশন করান হয় এবং জিজ্ঞাসা করা হয়, ’সরকারের আইন মান? তখন তিনি (ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেব) উত্তর দেন, ‘অবশ্যই মানি’! এ সময় গাড়ির ভেতর থেকে হাত লম্বা করে জনৈক অফিসার বলে, তাহলে চাবি জমা দাও’! আগের মত এবারও তিনি চাবি দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, ‘আমার জান থাকতে আমি চাবি দেবনা’! এরপর পরই গাড়ির ভিতর থেকে একটা ব্রাশ ফায়ার হয়! ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেব মাটিতে গড়িয়ে পড়েন! তারপর গাড়ি থেকে মেজর সাহেব নেমে চাবি নিয়ে চলে যান! এর মিনিট ৪/৫ পরে যশোর ক্যান্ট্রন্মেন্টের নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের ওপর হামলা শুরু হয়! হামলা থেকে বাঙালি রেজিমেন্টের সৈনিকরা খালি হাতেই অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ফেলে এবং অস্ত্র, গোলা বারুদ এবং ওয়্যারলেস সেট নিয়ে পালটা আক্রমন শুরু করে! তুমুল লড়াই হয় এখানে! অনেক বাঙালি সেনা শহীদ হন! নিহত লাশের উপর দাঁড়িয়ে খান সেনাদের মোকাবেলার সময় আমাদের ওয়্যারলেস সেটের সাথে শানতলা বেলুচি রেজিমেন্টের ১৭ বেলুচ রেজিমেন্ট’র ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার মিঃ রশিদ খান বাঙালি সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাদের জেনারেল সাহেব বলেছেন, বাঙ্গালিদের মেরে ফেলতে’! ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার বেলুচ বলেন, তোমাদের বাঁচতে হলে আমরা তোমাদের মাথার উপর দিয়ে ফায়ার করব, তোমরা তল দিয়ে আমাদের ব্যাটেলিয়নে চলে এসো’! পাকসেনাদের বিশ্বাস করে যশোর ক্যান্ট্রনমেন্টের বেঙ্গলি সৈনিকরা ওই গুলির ভেতর দিয়ে চলে যায় এবং সেই ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সহযোগিতায় নদী পার হয়ে সকলেই মুক্ত এলাকায় চলে আসে! বেঙ্গলি রেজিমেন্টের সংখ্যা ছিল ২২ জন! এর পরে ওই ২২ জনের কোম্পানির দায়িত্ব পান রকেট জলিল! জলিল তার দল নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার  এ্যাটাক করে! কেন্দ্রীয় জেল খানায় যে সকল বেলুচ ছিল তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়! আনসার, মুজাহিদরাও মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে যোগ দেয়! সংখ্যায় ছিল ৩/৪ শ’র  মত! এরপর যশোর শহরের ভোলা পুকুর ই,পি,আর হেড-কোয়ার্টারে বাঙালি ই, পি, আর’-দের বন্দির সংবাদ পেয়ে রকেত জলিলের তাৎক্ষনিক আক্রমন হলে তা মুক্তি ফৌজদের দখলে আসে! বন্দি বাঙালি ই, পি আর’রা মুক্ত হয়! দলে সংখ্যা বাড়ে ৬/৭শ’! ই, পি, আর হেড কোয়ার্টার থেকে ৬ পাউন্ডার গান মুক্তি বাহিনির দখলে আসে! সে সকল অস্ত্র দিয়ে যশোর ক্যান্ট্রনমেন্ট অ্যাটাক করা হয়! চলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া! সেই মুহূর্তে পাক সেনারা বিমান হামলা শুরু করে! আঃ জলিল (রকেট জলিল)’র বাহিনি তখন ডিফেন্স ছেড়ে যশোর চাচড়া’য় চলে আসে! ৩রা এপ্রিল পাক-সেনারা জলিলের কোম্পানিকে অ্যাটাক করে! ডিফেন্স ছেড়ে দিয়ে ঝিকরগাছা’য় চলে আসে! ৬ই এপ্রিল পাক সেনারা পুনরায় ঝিকর গাছা অ্যাটাক করে! এর ডিফেন্স ছেড়ে পিছু হটে নাভারণ’এ পৌঁছায়! এ সময়ে মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব তবিবর রহমান সরদার-এর পরামর্শে রকেট জলিলের বাহিনির সাথে অন্যান্যদের যোগাযোগ হয়! সাংসদ তবিবর রহমান সরদার আমাদের কাছে যুদ্ধের খোঁজ খবর নেন! অস্ত্র গোলা বারুদ স্বল্পতার কথা তাঁকে জানান আমাদের কমান্ডার সাহেব! তখন তিনি (এম,পি) জলিলকে সঙ্গে নিয়ে যান বেনাপোলে এবং ই,পি,আর সুবেদার আলাউদ্দীন সাহেবের সাথে আলাপ আলোচনা করেন! এরপর সুবেদার আলাউদ্দিন এবং জলিলকে ভারতে নিয়ে যান সাথে করে! সেখানে ভারতীয় বি, এস,এফ কমান্ডারের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে ভারতের মন্ত্রী, সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হয়! পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা সাহায্য নিতে এসেছে এ কথাও জানানো হয়! ৭ এপ্রিল রাত ১০ টায় ভারত সরকার ২ ব্যাটেলিয়ন বি এস এফ সেনা পাঠায় আমাদের সঙ্গে! ভারতীয় সৈন্য সহ আমাদের মুক্তি যোদ্ধারা যশোর ক্যান্ট্রনমেন্ট-এর উদ্দেশ্যে মার্চ করে! পরদিন পথে পাক সেনাদের সাথে ভীষণ লড়াই হয়! উভয় পক্ষের ক্ষয় ক্ষতি হয় ব্যাপক! এর পরে পাক সেনাদের কাম্নের গোলায় টিকতে না পেরে ডিফেন্স ছেড়ে বেনাপোলে চলে আসি!

!!বেনাপোলের যুদ্ধ!!

বেনাপোল ই পি আর হেড-কোয়ার্টারে স্থায়ি ভাবে ক্যাম্প করা হয়! হঠাত একদিন রাতে পাক সেনারা এ ক্যাম্পের উপর হামলা চালায়! হামলার প্রচন্ড পাল্টা জবাব দেয়া হয়! এ লড়ায়ে কাগজ পুকুরএ প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়! এখানে উভয় পক্ষের অনেক সেনা হতাহত হয়! আমাদের জন মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন! শেষ পর্যন্ত ওই রাতেই মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা ভারতে চলে যায়! এ সময় পাকসেনারা প্রায় ১০০ কামানের গোলা ভারতের উপর নিক্ষেপ করে! কুষ্টিয়া জেলার মেহের পুরের বৈদ্যনাথ তলা (বিশাল আম বাগান,বর্তমানে মেহের পুর জেলা) মুজিব নগরে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শফত গ্রহন করে! বঙ্গ বন্ধুকে করা হয় অস্থায়ী সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি! তাঁর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহম্মদকে প্রধানমন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মুনসুর আলী কে অর্থমন্ত্রী এবং খন্দকার মুসতাক আহম্মদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে! কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান তথা মুক্তি বাহিনী প্রধান করা হয়! এদিকে কমান্ডার রকেট জলিল ও তার সঙ্গীরা ৭ এপ্রিল ভারতে যাবার পর বিহার ও বীরভূমে পাঠান হয়! টাকী ট্রেনিং ক্যাম্পে ১৫ দিনের গেরিলা ট্রেনিং শেষে কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্ত প্রাপ্ত হয়ে সঙ্গীদের সাথে নিয়ে ৮ নং সেক্টর বয়রা’তে যোগদান করে! এ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ত পালন করছিলেন মেজর মঞ্জুর সাহেব! তার কাছেই আমাদেরকে পাঠান হয়! কমান্ডার জলিল ও তার দল বয়রা ক্যাম্প থেকে ভারী অস্ত্র নিয়ে সারসা’র কানাই নগর গ্রামে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প করে! এখান থেকে পার্শ্ববর্তী থানা ঝিকরগাছা’র ছুটিপুর পাক সেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমন চালান হয়! এ আক্রমনে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়! আরও নিহত হয় ঝিকর গাছা থানার এক দারোগা! তাদের কাছ থেকে দুটি হালকা মেশিন গান, দুটি চাইনিস রাইফেল এবং ১ টি স্টেন গান আমাদের হস্তগত হয়! পাকসেনাদের একটি খোলা জীপ আমাদের বাহিনীর হাতে আসে!

!!অপারেশন দোসিতনা !!

ঝিকর গাছা থানার দোসিতনা গ্রামে অপারেশন শুরু করি ছুটিপুর অপারেশনের পরে! দোসিতনা গ্রামের ঘাঁটি পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী হেড কোয়ার্টার! এখানে হামলার পরিকল্পনা করা হয় বিচক্ষণতার সাথে!দিনের বেলা শত্রুসেনাদের অস্থির করে রাখা আর রাতে তাদের উপর পরিকল্পনানুযায়ী হামলা করা ছিল আমাদের বিচক্ষণতা! সন্ধ্যা হয়েছে! আমরাও তৎপর! হামলার প্রস্তুতি চলছে! কানাইনগর অফিসের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হচ্ছে আমাদের! ত্রিমুখী এ্যাটাক সিদ্ধান্ত! আমরা নিজামপুর বেল্ট থেকে, ডিহির পাকশিয়া-কাশীপুর ও কানাইনগর থেকে শাহজাহান কবির সাহেবের পরিচালিত গ্রুপ! আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি!রাতও বাড়ছে!সঙ্গে আমাদের এল এম জি,এস এম জি,গ্রেনেড ও এস এ লার! রাত ১০টা পেরিয়ে গেছে! সিদ্ধান্ত ১১টায় আক্রমন! অপারেশন টাইম ১১টা! আস্তে আস্তে সময় এসে যায়! ১১টা বাজতেই শুরু হয় আমাদের আক্রমন! আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল! এ অপারেশনে ১জন মেজর সহ ৫০জন শত্রুসেনা নিহত হয়! আহত হয় অনেক! দোসিতনা হেডকোয়ার্টার থেকে কয়েকশ’র মত আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমান চাউল, আটা ও ঘি জনসাধারনের সহযোগিতায় আমাদের মুক্তি বাহিনীর দখলে আসে! সে গুলো কানাই নগরে নিয়ে আসা হয়! পরের দিন যশোর ক্যান্ট্রনমেন্ট থেকে আবার কয়েকশ’ পাকসেনা দোসিতনা হেডকোয়ার্টারে পথে মধুখালি মাঠে পৌছলে আমাদের মুক্তি বাহিনী গেরিলারা অতর্কিত আক্রমন করে! এতে বেশ ক’জন পাকসেনা প্রাণ হারায়!৬জন আটক হয়! তাদের বয়রায় পাঠান হয়! খবরটি সাথে সাথে ভারতে ছড়িয়ে পড়ে! তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল অরোরা এবং মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মেজর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী আমাদের কমান্ডার জলিলকে হেলিকপ্টার যোগে বয়রা ক্যাম্পে আসেন!

!! সারসা অপারেশন!!

পাকসেনারা সারসা’র গোড়পাড়া, নিজামপুর-সহ সুবর্ণখালি’তে ইতমধ্যে স্থায়ী ঘাঁটি করেছে! আর এ কারণে এই এলাকার আমরা মুক্তি যোদ্ধারা সুবর্ণখালি’র শত্রু ঘাঁটি উঠানোর জন্যে অনেক ভাবে চেষ্টা করি! কিন্তু ঘাঁটি উঠাতে আমরা ব্যর্থ হলে রিপোর্ট করা হয় বয়রা হেড কোয়ার্টারে! তখন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর এবং টু আই সি মেজর এন হুদা আমাদের বয়রা ক্যাম্পে তলব করেন! উদ্দেশ্য গোড়পাড়া বাজার থেকে (বেতনা নদীর ওপারে) খান সেনাদের হটানোর চেষ্টা! উনারা ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার রকেট জলিল মামা সহ সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, গোড়পাড়া ঘাঁটি থেকে পাকসেনাদের না হটাতে পারলে আমাদের ভীষণ ক্ষতি হবে’! উল্লেখ্য, গোড় পাড়া’র নিকটবর্তী গাতিপাড়া’র সীমান্তে বেতনা নদীর ধারে খান সেনাদের একতি শক্ত ঘাঁটি! সেই ঘাঁটিতে আক্রমনের জোর সিদ্ধান্ত হলো! ঘটনাটা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে হবে! হামলা এ্যাটাকের প্রস্তুতি সেস! এ্যাটাকের পরিকল্পনা এবং হামলা সব সময় রাতেই করা হয়! পরিকল্পনানুযায়ী ভোর ৬টা নাগাদ শুরু হয় আমাদের আক্রমন! যুদ্ধ হয় তুমুল ভাবে! এ লড়ায়ে প্রথম আমরা ব্যাবহার করি ভারী মর্টার কামান! এ কামান বয়রাতে স্থাপন করা হয়েছে! টু আই সি’র দায়িত্ত পালন করছেন মেজর হুদা সাহেব! বয়রা থেকে চলতে থাকে মরটার কামানের ভারী গোলা বর্ষণ! আঘাত চলতে থকে মুহুর্মুহু! মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড মার অন্য দিকে কামানের গোলা, খান সেনারা দিশে হারা না পেয়ে গোড়পাড়া ঘাঁটি থেকে দ্রুত সরে যেতে বাধ্য হয়! হানাদার বাহিনী এত দ্রুত সরে যায় যে, তারা এ ঘাঁটি থেকে যাবার সময় তাদের রসদ পত্র নেবার সময় সুযোগ পর্যন্ত পায়নি! হটতে থাকলে আমরাও তাদের পিছু নেই! গোড়পাড়ার যুদ্ধে ৪জন খান সেনা নিহত ও বেশ ক’জন আহত হয়! নিহতদের লাশ তারা দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যায়! ওই অপারেশনের আরো পরিকল্পনা ছিল গোড়পাড়া বাজারের বান্দালের উপর ব্রিজটি উড়ান! এ ব্রিজের উপর গোঁসাই (হাজারী লাল)-এর নেতৃত্তে আমরা ১২জন এ্যাকশনে প্রস্তুত ছিলাম প্রস্তুতি নিয়ে! পশ্চিম দিকে লক্ষ্মণপুর গ্রামের পার্শ্বে প্রস্তুত নজরুল গ্রুপ ও ফজলু গ্রুপ এবং পুব দিকে কন্দর্পপুর গ্রামের মাঝ খানে প্রস্তুত ছিল আর এফ সেকশন! মহীউদ্দিন গ্রুপ এবং আলমগীর গ্রুপকেও প্রুস্তুত রাখা হয়! একই সাথে তাদেরকে বলা হয় এক প্লাটুন নিয়ে নিজামপুরে যাওয়ার জন্য! জলিল মামা সকলকে উদ্দেশ্য করে বল্লেন, আমি যখন এল, এ, জ, দিয়ে দু’বার ফায়ার করব, তখন তোমরা বুঝবে আমাদের কোম্পানী কমান্ডারের আক্রমনের নির্দেশ! ওই সময় এক যোগে সবাই তোমরা ফায়ারিং শুরু করবে! নিজামপুর বাজারে পৌঁছে জলিল মামা দু’টো ফায়ার সংকেত করলে সেই মুহূর্তে মুক্তি সেনারা এক সাথে সবাই আক্রমন চালাই! সেই আক্রমনে পাকসেনারা অতি দ্রুত এলাকা ছেড়ে নাভারণে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়!

 ‘পরবর্তী অপারেশন’

এক বিশ্বস্ত সূত্রে সংবাদ এলো কাজীরবেড় গ্রামের দাউদ হোসেন (রকেট জলিলের শ্বশুর)-কে পাক সেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা ধরে পিস কমিটির সেক্রেটারি (নাভারণের ছোট ঘোদা, নাউজুবিল্লাহ) তবিবর রহমান খান ওরফে তবি খার গোডাউনের বন্দী শালায় আটকে রেখেছে! ওই খবর পেয়ে কমান্ডার রকেট জলিল মামা ও তার কোম্পানিকে নিয়ে নাভারণ পাকসেনাদের উপর আক্রমন শুরু করে! পাকসেনারা রকেট জলিল ও তার কোম্পানীর নাম শুনার পরে তাদের মধ্যে ভীতির  সঞ্চার হয়! আমাদের সাথে মুখোমুখি প্রচন্ড আক্রমন ও মারের চোটে পাক সেনারা নাভারণের ঘাঁটি ছেড়ে দক্ষিণে বাগ আঁচড়াতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়! সেই জলিল কোম্পানী ও তার কোম্পানির মুক্তি যোদ্ধারা গোলা গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমরা নাভারণ বাজারে পৌঁছই এবং জলিল মামার শ্বশুর দাউদ হোসেন-কে বন্দি শালা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি! এই অপারেশনে ১জন রাজাকার নিহত হয়! নাভারণ থেকে ফেরার পথে শিমুলিয়ার ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে পাকসেনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়!

!!অপারেশন!!

বিশ্বস্ত সূত্রে খবর এলো পাকসেনারা রাত ১টার পরে যশোর থেকে নাভারণ’এ সৈন্য নিয়ে আসছে! এ সংবাদ আমাদের কমান্ডার রকেট জলিল মামা আমাদের হেড-কোয়ার্টারে সেক্টর কমান্ডারকে রিপোর্ট করেন! লেফটেন্যান্ট অলিক গুপ্ত, মেজর এন, হুদা ও সেক্টর কমান্ডর মঞ্জুর আমদের কোম্পানী কমান্ডার জলিল মামার সাথে পরামর্ষ করেন! একত্রে এল এম জি, টুইঞ্চ মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র সহ আরো এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে রাত ৮টার সময় নাভারণ কলাগাছি অভিমুখে রওনা দেন! কলাগাছি এসে দেখা যায় পাক সেনাদের গাড়ী চলাচল করছে! জলিল মামা এবং মেজর এন, হুদা দু’জন মিলে আমাদের মুক্তি যোদ্ধাদের ডিফেন্সকে ভাগ করে দেন! রকেট জলিল ও মেজর এন হুদা,কলাগাছি মেইন রোডের উপর বড় একটা শিশুর কাঠ এখনকার ভাষায় রেন্ট্রি গাছের ডাল এবং ৩টা রেন্ট্রি বা শিশু গাছে ডিনামাইট ফিট করেন! ফিট করতে সময় লাগে মিনিট দশেক! কাজ শেষ করে ফিরে আসেন ডিফেন্সে! এবার অপেক্ষার পালা! কিন্তু না বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলোনা আমাদের! একটু দেখা যায় পাকসেনাদের ৪টা গাড়ী এদিকে এগিয়ে আসছে! প্রমাদ গুনছিলাম আমরা! শত্রু সেনাদের গাড়ী নিকটে আসতেই মেজর হুদা এবং হুদা সাহেব ডিনামাইট কন্ট্রোল সুইচ টিপতেই শিসু গাছ তাদের হুমড়ি খেয়ে পড়ে! ৪টা গাড়ীর মধ্যে ১টা গাড়ী গাছের নীচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়! এতে চালক সহ ৩জন পাকসেনা নিহত হয়! নিহতের সংবাদটি আমরা পাই পরদিন সকালে!

!!অপারেশন গদখালীর বাজার!

পাকসেনাদের আরও একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ঝিকরগাছা’র গদখালি বাজার! এই ঘাঁটি হামলার পরিকল্পনা করা হয়! আগস্টের শেষের দিকে গভীর রাতে এ ঘাঁটিতে হামলা করা হবে! পরিকল্পনানুযায়ী একদিন গভীর রাতে গদখালী ঘাঁটিতে আক্রমন চালানো হয়! হামলায় পাকসেনারা শেষমেশ দিশে না পেয়ে ডিফেন্স ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়! আমাদের মুক্তিবাহিনী এ ঘাঁটির ভিতর ঢুকে ১০টা রাইফেল ও তাদের বেডিং সহ জিনিসপত্তর নিয়ে চলে আসে! আসার পথে বেনেয়ালী রাস্তার দু’পাশে দু’জন ডিউটিরত রাজাকারকে গেরিলা পদ্ধতিতে মামা রকেট জলিল, গোসাই, রাজ্জাক সহ আমরা আটক করে নিয়ে যাই কানাই নগর ক্যাম্পে! এখানে দু’টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল আমাদের হস্তগত হয়!

!! অপারেশন শিমুলিয়া!!

এপ্রিলের শেষের দিকে আমরা জানতে পারি শিমুলিয়া ক্যাথলিক মিশনে পাক সেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় মোরচা খুঁড়ে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে! আর এ ঘাঁটিতে ৪/৫শ’ হানাদার বাহিনীর অবস্থান! রসদপত্রও তেমনি!বেশ ক’টি কামান, যেটাকে বলা হয় হেভি মর্টার এবং মেশিনগান পশ্চিম দিকে ভারতমুখী তাক করে ফিট করে রেখেছে! আমাদের তরফ থেকে পরামর্শ এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হয়শিমুলিয়ার ঘাঁটিতে অপারেশন করার! ঝিকরগাছা থানার শিমুলিয়া, ফতেহপুর, গদখালি, কলাগাছি, নাভারণ ও গোডাউন ঘাঁটি গুলোতে শত্রুবাহিনীরা তাদের সুবিধামত মোরচা তৈরি করেছে! সমগ্র দেশব্যাপী চলছে বিচ্ছিন্ন যুদ্ধ ও আক্রমন! স্ব-স্ব সেক্টর কমান্ডারদের এবং মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় লড়ায় তীব্র হচ্ছে একের পর এক! সারসা ঝিকরগাছা’র সব এলাকা জুড়ে শুরু হয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর গেরিলা আক্রমন! তাই গদখালীর অপারেশনের পর বেশ ক’দিন নীরবতা! এরপর আমদের দুঃসাহসী যোদ্ধা জলিল মামা এবং তার দক্ষিন হস্ত গোঁসাই সহ আমরা শিমুলিয়া মিশনের ঘাঁটির পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসরদের উপর ভোর রাতের দিকে আক্রমন শুরু করি! প্রায় ৪ ঘন্টা যাবত চলে মুষলধারে গোলা বৃষ্টি! গেরিলা কায়দায় আমাদের আচমকা মারের চোটে হানাদার বাহিনি ও তাদের দোসররা শিমুলিয়া ঘাঁটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়! এই অপারেশনে আমাদের বাহিনী দু’টি কামান ও বেশ কিছু অস্ত্র সস্ত্র, বেডিং পত্তর কবজায় আসে! এ অপারেশনের পর থেকে সাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মামা রকেট জলিলের নাম ঘন ঘন প্রচার হতে থাকে!

!! অপারেশন ফতেহপুর হাই স্কুল!!

শিমুলিয়া ঘাঁটি শেষে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ঝিকরগাছা’র বেনেয়ালির নিকটবর্তী ফতেহপুর সংলংগ্ন বেনেয়ালী হাই স্কুলে বাঙ্গকার কেটে বা মোরচা খুঁড়ে ঘাঁটি করে! ঘাঁটি করার সপ্তাহ খানেক পরে আমাদের কমান্ডার রকেট জলিল মামা’র নেতৃত্তে ২০/২৫ জনের সদস্য নিয়ে ভোর রাতের দিকে আমরা সেই বেনেয়ালী’র ঘাঁটিতে শক্তিশালী আক্রমন চালাই! আমি আগেই বলেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা ছিল বিচ্ছিন্ন খন্ডযুদ্ধ! এ আক্রমনে অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে কমান্ডার রকেট জলিল তাঁর এল, এম, জি এবং আমরা এস, এম, জি, এস, এলার ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল অস্ত্র সস্ত্র দ্বারা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে প্রায় দু’ঘন্টা যাবত গুলি বিনিময় চলে! এ অপারেশনে বলতে গেলে পাক হানাদার সেনারা দারুণ ভাবে পর্যুদস্ত হয় এবং ঘাঁটি ছেড়ে পালায়! ফতেহপুর অপারেশনে ৩জন রাজাকার ও ১জন পাক সেনা নিহত হয়! ও একজনের পায়ে গুলি লাগে!এ অপারেশন শেষে কমান্ডার রকেট জলিল, গোঁসাই ওসঙ্গীরা পাল্লা ও রাজা পুর গ্রামের দিকে চলে যায়!আর আমি কানাই নগর অফিসে অবস্থানরত বজলুল হুদা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে ফিরে আসি! তারপর পাকসেনা ও তাদের দোসররা আমাদের উপর অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে!হানাদার বাহিনী পরিকল্পনা করে রকেট জলিল মামার গ্রাম পাল্লায় হানা দেয়ার! এ সংবাদটি বয়রা কযাম্পে পৌঁছালে এর পালটা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেয়া হয়! পাক বাহিনি রাজাকার সহকারে  রকেট জলিলের বাড়ী পাল্লা (মোকামতলা) গ্রামে হামলা করে ঘর বাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়! এ ঘটনার পর মুক্তি যোদ্ধা রকেট জলিলের নেতৃত্তে গোঁসাই সহ কয়েকজন ই পি আর নিয়ে মুক্তি যোদ্ধারা পাল্লা গ্রামের আশে পাশে ডিউটি করতে থাকে! এ ভাবে ৪/৫ দিন ডিউটি করার পর এ সংবাদ পাক হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছলে খান সেনারা তিন দিক দিয়ে আক্রমন করে! কিন্তু আমাদের মুকতি বাহিনীর কাচকা মারের ঠেলায় তারা এলাকায় ঢুকতে পারেনি! ছয় দিনের বেলায় রকেট জলিলের গুলি শেষ হয়ে গেলে গুলি আনতে পাঠানো হয়!খান সেনারা এ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডভান্স করে পাল্লা গ্রামে ঢুকে পড়ে! রকেট জলিলের বাড়ীতে কেউ না থাকায় কাউকে ধরতে পারেনি!রকেট জলিল মামা এবং সঙ্গীরা তাৎক্ষণিক ভাবে খান সেনাদের উপর পাল্টা হামলা চালালে ২জন পাকসেনা নিহত হয় ও একজন আহত হয়! লাশ নিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পাক সেনারা জলিল নামের অন্য একজন পাবলিককে হত্যা করে যায়! ঠিক এমনি ভাবে জলিল নামের ৫ জনকে পাক সেনারা হত্যা করে!

!! ডাঃ সিরাজুল ইসলামের অভিজ্ঞতা!!

উত্তর সারসায় মুক্তি যুদ্ধের সময় ভারতের ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ থানার বয়রা ক্যাম্পে উপবিষ্ট এম, পি, জনাব তবিবর রহমান সরদার, সি ও মোজাফফর আহম্মদ, ডাঃ সিরাজুল ইসলাম, আলমাস ডাঃ, হেকিম জলিল (ডিহি) সহ সকলে উপস্থিত বসা! ডাঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, অস্ত্রের প্রয়োজন, একই সাথে অস্ত্র দেয়ার সুপারিশ করেন! তাঁদের বসাকালীন সময়ে এ্যাকশন পার্টির কয়েকজন গোকর্ণ গ্রামের ইজ্জত আলি এবং পাকশিয়ার আবু তালেব’কে ধরে নিয়ে আসে বয়রা ক্যাম্পে! এর ২দিন পর তাদের জবাই করে ট্যাংরালির মাঠে ফেলে রেখে যায় এ্যাকশন পার্টির সদস্যরা! এ বাহিনীর নেতৃত্তে ছিলেন শিববাস গ্রামের খলিল মিয়াঁ! এ ছাড়া ট্যাংরালী (শিববাস) গ্রামের আরাতন মোল্যাকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে রামদা দিয়ে হত্যা করে, হেকিম জলিল, আলমাস ডাক্তার ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা! বুলু ওরফে আঃ রাজ্জাককে গোড়পাড়া ও শেষে সাড়াতলা বাজার থেকে তাড়িয়ে ধরে তাকে মারা হয়! এ কাজও করে সাড়া তলার এ্যাকশন পার্টি!

#মুক্তি ফৌজ বনাম মুক্তি ফৌজ লড়াই#

মুক্তি ফৌজ বনাম মুক্তি ফৌজের মধ্যে একদিন লড়াই হয় গোড়পাড়া’য়! ছালামত মোল্যা ঘরের মধ্যে ছিল! তার প্রতিদ্বন্দ্বী লুতফর রহমান,বাড়ী তার ধান্যখোলা গ্রামে! উভয়পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লুতফর রহমান নিহত হয়! তার লাশ সাড়াতলা বাজারের উত্তর পশ্চিম পার্শে কবর দেয়া হয়! জুলাই’র দিকে সোহরাব ডাক্তার (ট্যাংরালী) তিনি কোন পক্ষের ছিলেন তা জানা যায় না! তবে তিনি নিরপেক্ষ ছিলেন; তাঁকে সন্ধ্যায় পুকুরে মাছ ধরার সময় বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে চোখ হাত বেঁধে সাড়াতলা এ্যাকশন পার্টির অফিসে নিয়ে যায়! তিনি ওদের নিকট একটা সিগারেট চায়! সিগারেট না দিলে পরে পানি খেতে চাইলে তাঁকে পানির পরিবর্তে প্রস্রাব খেতে দেয় ওরা! পরে তাঁকে চোখ হাত বাঁধা অবস্থায় পাশের মাঠে নিয়ে যায় এবং গোপাল সোহরাব ডাক্তারকে বুকে চাকু মেরে হত্যা করে! এর পর এ্যাকশন পার্টি গোকর্ণ গ্রামের মাস্টার দাউদ হোসেনকে ধরে নিয়ে আসে! কিন্তু তাঁকে হত্যা না করে ছেড়ে দেয়! পরবর্তীতে উত্তর সারসায় নিহত হয় গোড়পাড়া বাজারে বসবাসকারি ছমির উদ্দিন সরদার (কন্দর্পপুর গ্রামের বাসিন্দা)! তিনি মুসলিম লীগ করতেন! তাকে হত্যা করে ভারতের সোলাকিয়ার মাঠে! গোকর্ণ গ্রামের আজিজ ঢালীর বাড়ী লুটপাট করে নৈহাটি গ্রামের কাসেম মাস্টার ও বাদশা! মিয়াজ উদ্দীন নামের (বেঙ্গল রেজিমেন্ট) আর্মি রেজিমেন্ট থেকে পালিয়ে আসে (সে আলমাস ডাক্তারের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়) আবু তালেবের সুন্দরী কন্যাকে জোর করে বিয়ে করে! মুজিব বাহিনীর হারুন, করিম ও বাদশা’র নেতৃত্তে লাল, সাফাই প্রমূকরা মিয়াজ উদ্দিনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে কিন্তু ভাগ্য ভাল বলে সেই গুলি তার গায়ে লাগেনা! মিয়াজ পালিয়ে গিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় চন্দ্রপুর গ্রামে আশ্রয় নেয়! উত্তর সারসা’য় পাক বাহিনীর একটি শক্তিশালি ঘাঁটি ছিল গোড়পাড়া বাজারের দক্ষিণে বেতনার ওপারে, এস এন গাতিপাড়া’য়! এ ছাড়াও সুবর্ণখালি স্কুলের পাশে! এ্যাকশন পার্টির অপকর্মের প্রতিরোধ কল্পে বড় ভাই মহিউদ্দীন বিশ্বাস লক্ষ্মণ পুর সাহেব! ৮নং সেক্টর কমান্ডার এম এন হুদা’র সান্নিধ্যে সময় দিতেন আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শাহজাহান কবীর সাহেব! সাড়াতলা মুক্তি ক্যাম্পের জয়নাল আবেদিন চন্দ্র পুর, ফজলু মোল্যা সহ ৬০-৬৫ জনের মত! ট্যাংরালির বাউন্ডারির আকরাম যিনি ইতোমধ্যে মারা গেছেন! কাশী পুর গ্রামের মোল্যা আটলে গলহাটীর লড়ায়ে একখানা হাত হারিয়ে পঙ্গু হ্য়! সরকার থেকে সাহায্য পান!

# গোড়পাড়ার অপারেশন#

পাকসেনারা গোড়পাড়ার দক্ষিণে এক কিলোমিটার দূরে আমতলা-গাতীপাড়া মাদ্রাসার আম বাগানে ঘাঁটি গেড়ে বেশ বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে! সারসা থানা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বড়ভাই আব্দুল মাবুদ ওয়্যারলেস ওবি মাস্টার ছিলেন! গোড়পাড়া’র অপারেশনে ভারতীয় শিখ সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়! ভারতের বয়রা থেকে সেলিং শুরু করা হয়! গোড়পাড়া অপারেশন শুরু হয়েছে সেলিংএর মাধ্যমে! আমরা এদিন কন্দর্পপুর গ্রামের দক্ষিণ পাশে বেতনার পাড়ে এ্যামবুস নিয়ে অবস্থান করছি! ততক্ষণে বয়রা থেকে সেলিং শুরু হয়ে গেছে! ক্যাপটেন এন হুদা সাহেবের নির্দেশে সেলিং চলছে!প্রথম সেলটা একটুখানি ভুলের কারণে গোড়পাড়া বাজারের বেতনার ধারে আব্দুল লতিফের টিনের দোকানের উপর! সাথে সাথে বিধ্বস্ত হয় ঘরটি! আর এ স্থল কামানের সেলিং আরম্ভ হয় সকাল ১০টা’র সময়! ডিহি, লক্ষ্মণপুর ও নিজামপুর এলাকার সকল গ্রাম মুহুর্মুহু কামানের সেলিংএর শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে! পাকসেনারা উত্তর সারসার আমতলা গাতিপাড়ায় অবস্থান নেয়! এরপরে আর অগ্রসর হয়নি! ফলে এ অঞ্চলের সিংহভাগ এলাকা মুক্ত! আমরা মুক্তিফৌজ বা মুক্তি বাহিনী এ সব এলাকায় নিরাপদে বিচরণ ও অবস্থান নেই! বয়রা থেকে সেলিং শুরুর সাথে সাথে আমরা তিন দিক দিয়ে ত্রিমুখী আক্রমন শুরু করি! গোড়পাড়ার মধ্যভাগের মুভমেন্টে রয়েছেন নাসির, মোজাফফর, হাইমদ্দীন, নজরুল ইসলাম ও তাদের সঙ্গীরা! পশ্চিম দিকের লক্ষ্মণপুর,খামার পাড়ায় অবস্থান নিয়েছেন বড়ভাই মহীউদ্দীন, আনসার আলি, আব্দুল মান্নান ও তাদের সঙ্গীরা! পুব দিকের কেরালখালী, কন্দর্পপুর ও বসন্তপুর এলাকায় মুভমেন্ট নিয়ে অবস্থান করছি মামা রকেট জলিল, গোসাই, আঃ রহমান, নূরমোহাম্মদ, জহুরুলশেখ এবং আমি! এ ছাড়া অনেকেই দূরবর্তী অবস্থানে থাকেন! গোড়পাড়ার আরো উত্তরে সাড়াতলা বাজারের তেতুল তলা ক্যাম্পে সার্বক্ষণিক প্রস্তুত ছিলেন ইসলাম মাস্টার, অজির আলি, কাশেম মাস্টার, হবিবর রহমান, চানুমাঝি, ছালামত মল্লিক আরো অনেকে! চলমান-