বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা,পদক্ষেপ নেয়া জরুরী


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২০, ২০২৪, ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ /
বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা,পদক্ষেপ নেয়া জরুরী

দেশের সমুদ্রসীমায় ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সুযোগে ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জেলে ও নৌযানগুলোর গভীর সমুদ্রাঞ্চল থেকে মৎস্য আহরণ সক্ষমতা এখনও অর্জন করেনি, আর নিজেদের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় কোনো দিনই মাছ ধরেনি বাংলাদেশ। এ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগের সমন্বয়হীনতায় বিশাল সমুদ্র এলাকা থেকে পেলাজিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ সমুদ্র সীমা জয়ের একদশক পার হলেও গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণের সক্ষমতা এখনও অর্জন করেনি। বঙ্গোপসাগরে মা ইলিশ রক্ষায় চলছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

চরফ্যাশনের মেঘনার তেঁতুলিয়া ও সাগর মোহনার ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার অভয়াশ্রম এলাকায় এই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ সুযোগে সাগরের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা পেরিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতীয় জেলেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এবং মাছ ধরছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার ১৭ অক্টোবর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের পানিসীমায় মোংলা বন্দরের অদূরে ফেয়ারওয়ে-সংলগ্ন গভীর সাগরে অনুপ্রবেশ করে মাছ শিকারের অভিযোগে ৩টি ফিশিং ট্রলারসহ ৪৮ ভারতীয় জেলেদেরকে জেলেদের আটক করে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। গত শুক্রবার তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ভারতীয় জেলেদের বাংলাদেশে অবাধে মাছ শিকার বন্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীদের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে জেলে ও ট্রলার মালিকরা। জানা যায়, ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশ উপকূলবর্তী এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্ধারণ করা হয়। মূলত এখানেই বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ পায়। কিন্তু জেলে এবং ট্রলার মালিকদের অভিযোগ ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সুযোগে বাংলাদেশের জলসীমায় রীতিমতো মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতের জেলেরা। রুপালি ইলিশের বিচরণের বড় ক্ষেত্রগুলো দখলে নিয়েছে তারা।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানাযায়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জেলেরা বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে বেপরোয়া মাছ শিকার করার কারণে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বঙ্গোপসাগর মৎস্য শূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে গবেষকরা আরো বলেন, এরই মধ্যে কমে গেছে মাছ। খালি হাতে ফিরছেন অনেক জেলে। এই জন্য বাংলাদেশের জলসীমায় গভীর সমুদ্রে কোস্ট গার্ডের টহল বাড়ানো দরকার, যাতে করে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মাছ প্রতিবেশী দেশের জেলেরা শিকার করে না নিতে পারে। ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ।

যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। সদস্য দেশ হিসেবে সংস্থাটিকে প্রতিবছর ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (৭৭ লাখ টাকা) পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু সক্ষমতা না থাকায় এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ শিকার করতে পারেনি বাংলাদেশ। গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দু’টি প্রতিবেশী দেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কার) জেলেরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মাছ লুটে নিচ্ছে।

সূত্র জানায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরোলেও ১০০ মিটার গভীরতার বাইরের সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে এখনো কোনো জরিপ পরিচালনা করতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পানিসীমায় মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার নিজের জলসীমার মাছই ধরতে পারে না সেখানে কিভাবে আন্তর্জাতিক পানিসীমায় মাছ শিকার করবে? প্রশ্ন ব্লু ইকোনমি ও সমুদ্র পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সির তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র সাত লাখ টন।

সূত্র আরও জানায়, সমুদ্রে ও তলদেশে থাকা বিপুল পরিমাণ সম্পদ আহরণের নীতি নিয়েছে বাংলাদেশ যাকে বলা হয় ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্র সম্পদনির্ভর অর্থনীতি। সামুদ্রিক মাছ আহরণে বিশ্বে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম। চীন বিশ্বের শীর্ষ মাছ আহরণকারী দেশ। বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা হলো, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এই এলাকায় মৎস্য আহরণ ও সমুদ্রের তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত হয়েছে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন। তারপর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণকে অগ্রাধিকারমূলক খাত চিহ্নিত করে সরকার বছরে দু’বার বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধসহ একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে গভীর সমুদ্র থেকে ২৪৮টি আধুনিক ট্রলার মাছ শিকার করছে। কোটি কোটি টাকায় বেচা-কেনা হচ্ছে এসব ট্রলার লাইসেন্স। নিয়মনীতি না মেনে যে যেভাবে পারছে মাছ শিকারে ব্যস্ত। সাগরে ৪০ থেকে ১০০ মিটার এলাকায় কোন কোন ট্রলার মাছ ধরবে, তা নির্ধারিত থাকলেও সে নিয়ম মানছে না কেউ। বড়-ছোট ট্রলারগুলো সাগর থেকে প্রতিদিন কী পরিমাণ মাছ শিকার করছে, তার কোনো সঠিক তথ্য না থাকলেও মেরিন ফিশারিজের কাছে বাণিজ্যিক ট্রলারের পরিসংখ্যান আছে।

গত ১৩ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৯ -১০ সালে ১৫২টি বাণিজ্যিক ট্রলারে ৩৪ হাজার ১৮২ টন আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫৯৪ টন সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ করা হয়েছে। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা। এ এলাকা ঘিরে চলছে মাছ নিধন। তবে সাগরের ৪টি এলাকা প্রধানত মাছ আহরণের জন্য চিহ্নিত হয়ে আছে। এগুলো হলো কক্সবাজারের অদূরে ‘সাউথ প্যাচেস’, টেকনাফের পশ্চিমে ‘সাউথ অব সাউথ প্যাচেস’, দুবলার চরের দক্ষিণে ‘ছোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ এবং পটুয়াখালীর দক্ষিণে ‘মিডিল গ্রাউন্ড’। এসব এলাকায় পাওয়া যায় মাছের বড় অংশ।

সূত্র জানায়, সমুদ্রে মৎস্য আহরণে বর্তমানে ২৩১টি নিবন্ধিত বাণিজ্যিক ট্রলার রয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ২২০টি ফিশিংয়ে নিয়োজিত আছে। বাণিজ্যিক নৌযানের মধ্যে রয়েছে চিংড়ি ট্রলার, ট্রায়াল ট্রিপ বটম, বটম ট্রলার, মিডওয়াটার ট্রলার এবং মিডওয়াটার রূপান্তরিত ট্রলার। ৬৭ হাজার ৫৬৯টির সামুদ্রিক নৌযানের অনুমোদন রয়েছে। তার মধ্যে ইঞ্জিনচালিত নৌযান ৩২ হাজার ৭৫৯ এবং ইঞ্জিনবিহীন নৌযান ৩৪ হাজার ৮১০টি। গত অর্থবছরে আহরণ করা শীর্ষ ১০টি মাছ হলো সার্ডিন, ম্যাকারেল, ইলিশ, ছুরি, পোয়া, রূপবান, লইট্টা, চিংড়ি, কাঁটামাছ ও রূপচাঁদা।

সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট এর সাবেক পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অতিথি শিক্ষক গবেষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের জেলেরা সমুদ্রের ৬০ মিটারের বেশি গভীরে গিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। বেসরকারি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর সক্ষমতা থাকার পরও ১০০ মিটারের বেশি গভীরতায় ফিশিং করে না। ফলে গভীর সাগরে টুনাসহ সমগোত্রীয় মাছ শিকারে বাংলাদেশের কোনো আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি বা সফলতা নেই। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ শুধু টুনা মাছ রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ আওয়ার সির মহাসচিব আনোয়ারুল হক (গাজী আনোয়ার) দৈনিক সংগ্রামকে বলেছেন, এখনো সমুদ্র থেকে মূলত মাছ এবং চিংড়ি বেশি ধরা হয়। কারণ খাবার হিসেবে বাংলাদেশীদের ভেতরে এগুলোর চাহিদাই বেশি। তবে ইদানীং অনেক জায়গায় অক্টোপাস, স্কুইড, ক্যাটলফিস, কাঁকড়া বা ঝিনুক খাওয়ার চল তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম। জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনো সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ ধরছে। কিন্তু আধুনিক দেশগুলো সমুদ্র থেকে মাছ ধরার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক দূর এগিয়েছে। তাদের আর আমাদের সম্পদের পরিমাণ একই হলেও আহরণে তারা এগিয়ে। এজন্য আমাদেরও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করতে হবে।

সদর উপজেলার বাসিন্দা জেলে ইদ্রিস বলেন, ২২ দিন আমরা মাছ শিকারে যাচ্ছি না। তবে সরকারের কাছে দাবি চাল-ডালের সঙ্গে অল্প কিছু নগদ অর্থ দেয়ার। জেলে মামুন হোসেন বলেন, নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে ছেলে-সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে একটু কষ্ট হলেও মা ইলিশ রক্ষায় নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রেখেছি। তবে বাংলাদেশ অংশে অন্য কোনো দেশের ট্রলার মাছ শিকার করতে যেন না পারে সে দিকে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানাই। বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে যাতে অন্য দেশের ট্রলার ঢুকতে না পারে সেজন্য নৌবাহিনী কাজ করছে।

এ বিষয়ে মৎস্য বিভাগ সচেতন রয়েছে। বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন গণমাধ্যমকে জানান, মা ইলিশ রক্ষায় ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নবেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী অভিযান চলমান রয়েছে। খুলনা নৌ অঞ্চলের (জি), এনজিপি, এনডিসি, এনসিসি, পিএসসি, বিএন এরিয়া কমান্ডার, রিয়ার অ্যাডমিরাল গোলাম সাদেক গণমাধ্যমকে জানান, বাংলাদেশের জলসীমায় কেউ যাতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারে তৎপর রয়েছে নৌবাহিনী।