বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস আজ


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মার্চ ২৬, ২০২৫, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ /
বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস আজ

‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে চায়’ (রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়)। আজ ২৬ মার্চ ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস। সত্যিই দেশের ১৮ কোটি মানুষ এবার মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে। ১৯৭১ সালে এদিন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু সে স্বাধীনতা কার্যত ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। মানুষ হয়ে পড়েছিল নিজ দেশে পরবাসী। দীর্ঘ ১৮ বছর স্বাধীনতা দিবসটি পালিত হতো মুজিব বন্দনা আর ভারতের দিল্লির দাসত্বকে মেনে নেয়ার অঙ্গীকারের মাধ্যমে।

’৭১ এর রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন দলে রাজনীতিতে সম্পৃক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় দিবসটির রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হতো না। ‘জাতীয় দিবস’ পালন মানেই ভারতীয় অতিথিদের এনে তাদের কদমবুছি করা; তাদের সম্মান জানানো রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। আর রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা খরচ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘উচ্চ থেকে আরো উচ্চতর’ অবস্থানে উঠানো হতো। গত ৫ আগষ্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মানুষ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভারতে পালিয়েছে দিল্লির পুতুল এ যুগের ঘসেটি বেগম শেখ হাসিনা। মানুষ এবার প্রকৃত স্বাধীন ভাবে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি পালনে সরকারি ভাবে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।

স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির জন্য গর্ব আর অহঙ্কারের। বাংলাদেশের সব মানুষ চিরকাল গর্ববোধ করেন যে দিনটির জন্য, সেটি আজকের এই দিন ২৬ মার্চ, ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এ ঢাকার রাজপথ রক্তে ভাসিয়ে দেয়। সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রহস্যজনকভাবে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।

আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে পঙ্গপালের মতো পড়িমরি করে ভারতে পালিয়ে যান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে উঠে। প্রতিরোধ সংগ্রামের লক্ষ্যে দামাল ছেলেরা মুখিয়ে থাকলেও প্রধান নেতা শেখ মুজিব ধরা দেয়া এবং অন্যান্য নেতারা ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। এমনি সময় ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে মেজর জিয়াউর রহমান দেশমাতৃকায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ দেন। পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ায় জাতি, সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশের বীর সন্তানেরা যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেন। যুদ্ধের ময়দানে জীবনের মায়া তাদের কাছে ছিল তুচ্ছ। তাদের ছিল না যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, ছিল না কোনো উন্নত সমরাস্ত্র।

মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা তাদের উজ্জীবিত করেছিল সাহসে, সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্ণেল (অব.) আতাউল গনি ওসমানী। দীর্ঘ ৯ মাস শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ করেছিলেন দেশের সব ধর্ম, বর্ণ, ভাষার বীর সন্তানেরা। হানাদার বাহিনীকে মোকাবিলা করে মুক্তির সংগ্রামে সফল হয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ছিনিয়ে এনেছিলেন চ‚ড়ান্ত বিজয়। জাতিকে মুক্ত করেছিলেন পরাধীনতার শৃংখল থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীনতার ৫৫ বছরে কী বাংলাদেশ প্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছে? প্রত্যাশা-আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক কতদূর। তবে দীর্ঘ দেড় যুগ পর জাতি মুক্তভাবে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব কী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে কোনো রাষ্ট্র যে ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, তাকে সার্বভৌমত্ব বলে। সার্বভৌমত্ব কোনো পরিচালনা পরিষদের বাইরের কোনো উৎস বা সংগঠনের হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করার পূর্ণ অধিকার ও ক্ষমতা। প্রকৃত অর্থে আমজনতা প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে? হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর দেশের সবকিছু পরিচালিত হয়েছে দিল্লির নির্দেশে। এমনকি দেশকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের অঙ্গ রাজ্যে পরিণত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো দেশে সফরে গেলে দিল্লির অনুমতি পত্র (এনওসি) নিতে হতো। হাসিনার পালানোর কয়েক মাস আগে চীন সফরের যাওয়ার আগে ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা চীন সফরে দিল্লির কোনো আপত্তি নেই’।

দিল্লির দাসত্ব শুরু হয় মূলত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের ২৫ দিন পর পাকিস্তান কারাগার থেকে বের হয়ে প্রথমে লÐন অতঃপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর থেকেই। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব না দিলেও জাতি তাকে (শেখ মুজিব) মুক্তিযুদ্ধে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মর্মবাণী ধারণ করতে ব্যর্থ হয়ে শেখ মুজিব ক্ষমতা গ্রহণ করেই বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ‘প্রধানমন্ত্রীর পদের বেশি ক্ষমতা না প্রেসিডেন্ট পদে ক্ষমতা বেশি’ এ নিয়ে গোটা জাতিকে ভেল্কীর মুখে ফেলে দেন শেখ মুজিব। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ভারতকে খুশি রাখতে ২৫ বছরের মুজিব-ইন্দিরা গোলামির চুক্তি করে বেরুবাড়ি ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দেশের মানচিত্রে আঘাত হানেন।

ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেয়ার চুক্তি করেন। তারপরও ‘আমার আরো ক্ষমতা চাই’ মানসিকতায় জনগণের উপর জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন। সংসদে লাল ঘোড়া দাবড়ানোর হুংকার দেন। আর পোষ্যদের লুটেরা বাহিনীতে পরিণত করেন। সেটাতেও সন্তুষ্ট না হওয়ায় দেশের সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে ’৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেন। এ সময় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী হুংকার দিয়ে উঠেন ‘পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়’। যদিও ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন।

স্বাধীনতার লক্ষ্যে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করেছেন লাখো মানুষ। ত্যাগ স্বীকার করেছেন লাখো নারী। পঙ্গু হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, যে স্বপ্ন আর আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে তা কতটা পূরণ হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল- গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র স্থান করে নিয়েছিল। সে সংবিধান ব্যক্তি স্বার্থে ১৬ দফায় কাটাছেড়া হয়েছে। শেখ মুজিব নিজের স্বার্থে ৪ দফায় কাটাছেড়া করেন। গত ৫ আগষ্টে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর সেই সংবিধান সংশোধন করা হবে নাকি বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করা হবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দুর্নাম থেকে দেশের মুক্তি মিলেছে বটে। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিস্তর ফারাক। মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে সংসদ পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলেও দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাকশাল থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭৮ সালে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে। ’৯০ এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর কয়েক বছর গণতন্ত্র ভোটের অধিকার ছিল। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মানুষ স্বভাবিক ভাবে ভোটের অধিকার পায়নি। এ সময় শাসকগোষ্ঠী দিল্লির দাসত্ব করেছে।

ভারতে পলাতক হাসিনার শাসনামলে সাড়ে ১৫ বছর ‘চেতনা’ তকমা দিয়ে জাতিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। ভারতের নীল নকশার জাতীয় সংসদের একের পর এক পাতানো নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ভারতের শাসকদের পায়ে শপে দিয়েছিল। ঢাকা কার্যত দিল্লির দাসত্ব করেছে ১৮ বছর। ভারতের অঙ্গ রাজ্যের মতো হাসিনা রেজিমে দেশ পরিচালনা করা হলেও মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন কেবল মাত্র শেখ মুজিবের অবদানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ শ্লোগান তুলে উন্নয়নের নামে বিদেশী ঋণ এনে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে।

স্বাধীন দেশের বেশির ভাগ মানুষ ছিল পরাধীন। ‘স্বাধীনতা দিবস’ ও বিজয় দিবসে কেবল ‘ভারতের অবদান স্মরণ করে’ একদলীয় ভাবে পালন করা হতো। জাতীয় দিবসগুলোতে দলীয় অলিগার্ক আর ভারতের কিছু ব্যক্তি ছাড়া দেশের মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। এবার সব মত পথের নেতাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবে। ফলে এবারের স্বাধীনতা দিবস পালিত হবে অন্যরকম আবহে।

৫৫ বছর একটা দেশের জন্য মোটেও কম সময় নয়। স্বাধীনতার এই ৫৫ বছরে কী পাওয়ার কথা ছিল এবং কী পেলাম তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ নামে জাতির মধ্যে যে বিভক্তি রেখা টেনে দেয়া হয়েছিল সেই বিভক্তি রেখা কিছুটা হলেও মিশে দেয়া গেছে ৫ আগস্টের ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে।