বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকতে মাঠের প্রধানবিরোধী দল বিএনপিকে পাত্তা না দিয়ে উল্টো দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ শীর্ষ নেতাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল থাকতো আওয়ামী লীগ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্বৈরসরকারের ভয়াবহ পতনের পর দলটির অবস্থান যখন শূন্যতে নেমে এসেছে ঠিক তখনই বিএনপির সাথে তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ মিত্র ও দুঃসময়ের সহযোগী জামায়াতের মধ্যে কিভাবে ফাটল ধরানো যায় সেই ছক কষছে আওয়ামী লীগ। এজন্য বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ও আত্মগোপনে থাকা নেতারা ইনিয়ে বিনিয়ে বিএনপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রতি অনুসমর্থন জানাচ্ছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহায়তায় বিএনপির সাথে সখ্য গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা তদবির করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি-জামায়াতের আদর্শিক অবস্থান দুই মেরুতে হলেও ১৯৯৯ সালে চার দলীয় জোট গড়ে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়লাভের মাধ্যমে তারা সরকার গঠন করে। এরপর ১/১১ থেকে শুরু করে গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। ওই সময় থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটে ভাঙন সৃষ্টির একটা প্রচেষ্টা ছিল আওয়ামী লীগের। ওই সময় সফল না হলেও গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের নজিরবিহীন পতনের পর থেকে সেই ভাঙনের ষড়যন্ত্র আবারো শুরু করেছে বলে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রী ও এমপিদের সবাই আত্মগোপনে চলে যান। খোদ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাসহ আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগই এখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে অবস্থান করছেন। এ দিকে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকার গঠনের পর থেকেই বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে চাপ তৈরি করছে। অপর দিকে জামায়াত ইসলামী সংস্কার কাজের জন্য সরকারকে একটি যৌক্তিক সময় দিতে চায়। এ নিয়ে মূলত বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের মাথায় এসে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব কিছুটা বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের মতে, অতীতে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলেও অনুকূল পরিবেশ পেয়ে তাদের আদর্শ প্রচারে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। এই প্রতিযোগিতার মাঝখানে সুযোগ নিতে চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আদর্শিক দ্বন্দ্বের সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে এ দেশে পুনর্বাসন হওয়ার পথ খুঁজছে। এর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে লড়ছে প্রতিবেশী দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্টের পর পরই নির্বাচন হলে বিএনপি নিরঙ্কুশ ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে বিএনপির সেই আশা ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে এবং জামায়াতের অবস্থান ততই দৃঢ় হচ্ছে। আগামী দুই-তিন বছর যদি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকে তাহলে জামায়াতের অবস্থান আরো পোক্ত হবে আর বিএনপি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে- এমন ধারণা বিএনপির মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও আগামীতে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে ফিরতে না পারলে এই অনুপস্থিতিতে জামায়াত বেষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের সাথে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তারা নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে- বিএনপির ভারতপন্থী অংশকেই বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়টা বোঝানো হচ্ছে। বিএনপির ভারতপন্থী ওই অংশকে এটাও বোঝানো হচ্ছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা জামায়াতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে- যার প্রেক্ষাপটে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ভবিষ্যতে আরো দুর্বল হয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
এই অবস্থায় অসাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে বিএনপির পাশে থেকে সমর্থন দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগই একমাত্র শুভাকাক্সক্ষী দল- এমন ধারণা জোরালো এবং যৌক্তিক দিক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এতে ভেতরে ভেতরে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ভারতপন্থী প্রভাবশালী অংশটি আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ছে- যা তাদের কৌশলী বক্তব্যে ফুটে উঠছে।
আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাথে আলাপকালে জানান, পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে এবং বিএনপির অনুসমর্থন পাওয়া না গেলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ দেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পথ সহসায় খুলছে না। তা ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন। আগামীতে জাতীয় সরকার গঠন হলে সেখানে আওয়ামী লীগ থাকবে না- এটা দলের শীর্ষ নেতারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন।
সেই উদ্বেগের জায়গা থেকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে জামায়াতের সাথে বিএনপির ঐক্যের ফাটল ধরানোর বিকল্প নেই। তাদের মধ্যে বিভেদের দেয়াল কিভাবে তৈরি করা যায়- সেজন্য বন্ধুপ্রতিম ভারতকে কাজে লাগানো হচ্ছে। ভারতও মনে করে, এ দেশে আওয়ামী লীগই তাদের একমাত্র সোল এজেন্ট। আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন না হলে এ দেশে ভারতের অবস্থানও আগের জায়গায় ফিরে আসবে না- এটাও ওই দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে ভারতকে ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিগত দিনে নির্বাচন, সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বিএনপি-জামায়াত ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছে। কিন্তু দুটি দলের আদর্শ তো ভিন্ন-এটা বুঝতে হবে। তাদের মধ্যে কিছু সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে এটা ঠিক। পথচলায় মত দ্বিমত থাকতে পারে, থাকবে- এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো স্বৈরাচারী দলের পুনর্বাসনের জন্য কেউ কাজ করবে-এটা মোটেও ঠিক নয়। এ বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন। শ্রীলংকায়ও তাদের সঙ্কট নিরসনে এখন জাতীয় সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করছে। জাতীয় সরকার গঠন হলে বিএনপি-জামায়াতের বৃহত্তর অংশগ্রহণ থাকবে। জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হলে তখন আর এই সমস্যা থাকবে না। এ দেশে যাতে আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই পুনর্বাসন না হয় সেজন্য বিএনপি-জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ইকতেদার আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আদর্শিকভাবে দুটো আলাদা দল হলেও বিএনপি-জামায়াত একটি ঐতিহাসিক জোট। এখন হয়তো কিছু সমস্যা হচ্ছে, কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি তাদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগও চাইবে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যে ফাটল ধরুক। তারা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছে, এই সুযোগে তারা রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করবে। আমি মনে করি, দেশের প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থে সব ভেদাভেদ, মতদ্বৈধতা ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতি গঠনে বিএনপি-জামায়াতের কাজ করা উচিত। তাহলে তাদের কল্যাণ হবে, দেশেরও মঙ্গল হবে। অন্যথায় আবারো বিপর্যয় ঘটবে।