স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সদর দফতরের নিষ্ক্রিয়তায় পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি ও আনসার বাহিনীতে এখনো ঘাপটি মেরে আছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতাকে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা-আহত করার সাথে জড়িত কর্মকর্তারা। আ’লীগ সরকারকে রক্ষায় এসব কর্মকর্তারা শুধু উচ্চ পর্যায়ে বসে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়ে বসেছিলেন না, মাঠ পর্যায়ে নির্দেশ বাস্তবায়নে নিজেরাও সশরীরে গিয়ে গুলি করেছেন আন্দোলনকারীদের উপর।
পুলিশ সদর দফতর, এসবি, ডিএমপি, র্যাব সদর দফতর, নৌপুলিশ, সিআইডি এবং এপিবিএনয়ের মতো পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট থেকে একের পর এক নির্দেশনা দিয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। আ’লীগ সরকার পতনের ৯০ দিন হলেও হত্যার সাথে জড়িত শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন ইউনিটে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হলেও বহাল তবিয়তে থেকে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন তারা।
এছাড়া ছাত্রদের হত্যার সাথে জড়িত বিজিবি ও আনসার কর্মকর্তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ দোষী বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা এবং নির্দেশদাতাদের বিচারের মুখোমুখি করা শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবি। গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর গুলির ঘটনায় একের পর এক মামলা হচ্ছে। নির্দেশদাতা হিসেবে আসামি হচ্ছেন ওই সব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশ দিয়ে হতাহত করেন তাদের গ্রেফতার না হওয়ায় জনমনে রয়েছে ক্ষোভ।
সূত্র জানায়, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও এটিইউয়ের মতো পুলিশের দুটি ইউনিটের প্রধানের পদ এখনো শূন্য। এ ছাড়া নৌপুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে বর্তমান সরকারে প্রশ্নবিদ্ধ করতে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পদোন্নতি দিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ওইসব পদে পদায়ন করা হচ্ছে না।
ফলে পুলিশ পুনর্গঠন ও সারা দেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহীদদের রক্তের বিনিময়ে দেশে নতুন সরকার গঠনের ৯০ দিন হলেও খুনের সাথে জড়িত শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়েই বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা। আ’লীগের ক্যাডারদের রেখে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার করা সম্ভব নয়।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ সদর দফতরে এখন আ’লীগের সময়ের পরামর্শ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা বহাল রয়েছেন। ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দিয়েই তারা বসেছিলেন না, মাঠপর্যায়ে নির্দেশ বাস্তবায়নে নিজেরাও সশরীরে গিয়ে গুলি করেছেন আন্দোলনকারীদের উপর। ওই সদস্যদের মধ্যে দুজন অতিরিক্ত আইজিপি, তিনজন ডিআইজি, চারজন অতিরিক্ত ডিআইজি এবং সাতজন এআইজি (এসপি) রয়েছেন।
এদের অনেকেই গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন সময় পুলিশ সদর দফতরে চাকরি করেছেন। এ সব কর্মকর্তা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে হাসান মাহমুদ খন্দকার আইজিপি থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগ করা পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে যে পরামর্শ কমিটি গঠন করেছিলেন ওই কমিটির সদস্যও ছিলেন অনেকেই। ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট আ’লীগ সরকার হাসান মাহমুদ খন্দকারকে আইজিপি পদে নিয়োগ দেয়। তিনি ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবসরে যান।
পরে তিনি স্পেনের রাষ্ট্রদূতও হন। ওই পরামর্শ কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি (পলাতক) প্রলয় কুমার জোয়ারদার, অতিরিক্ত আইজিপি আবু হাসান মুহম্মদ তারিক, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি কুরাইশ ও হাসানুল হায়দারসহ অনেকেই। এসব কর্মকর্তার নির্দেশেই সারা দেশে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের খুন ও গুমের ঘটনা ঘটে।
এমনকি সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তালিকাও তৈরি হতো পুলিশ সদর দফতরের ওই পরামর্শ কমিটির নির্দেশে। আওয়ামী সরকার পতনের আগের দিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিল ওই কমিটির সদস্য পুলিশ কর্মকর্তারা। সর্বশেষ নৌপুলিশে পদায়ন করা হয় সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত আইজিপি কুসুম দেওয়ানকে। যার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখা এবং সিআইডিতে থাকা অবস্থায় সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলীর অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু সরকার পরিবর্তনের ৯০ দিন গেলেও এসব কর্মকর্তারাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজিপির সাথে একই টেবিলে বসে বৈঠক করছেন।
ওই গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন দিল্লিস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসে কর্মরত থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সাথে কাজ করেছেন পুলিশের এক কর্মকর্তাকে পরে ২০২৩ সালে দেশে ফিরিয়ে এনে অতিরিক্ত আইজিপি করা হয়। ওই কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় এপিবিএনয়ের মতো পুলিশের ইউনিটে থেকে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
এছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিপেক্ষ ও গুলি করা হয়। র্যাবের ওই সময়ের প্রধানসহ আন্দোলনকারীদের উপর হেলিকপ্টার থেকে গুলির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে অতিরিক্ত আইজিপি ছয়জন, ডিআইজি ১২জন এবং এসপি ৩০ জন এবং অতিরিক্ত এসপি ৭০ জন রয়েছেন যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে হত্যা-আহত করার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এসব অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো সুবিধাজনক পদে বহাল রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা ও এর তদন্ত, গ্রেফতার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে। এ জন্য পুলিশ-সংক্রান্ত কিছু আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে পুলিশ বাহিনীর বড় অংশ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তদন্ত করে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় পুলিশ সংস্কার হবে না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, আন্দোলনের সময় গুলির নির্দেশদাতাদের বিষয়ে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্তে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতাদের বিষয়ে জানা গেছে। তাদের নির্দেশনাগুলো কতটুকু যৌক্তিক ছিল, বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছ। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে এবং যা চলমান থাকবে। যারা গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন তাদের অনেকেই এখনো পলাতক।
ওই নির্দেশদাতার মধ্যে অন্যতম এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার সাবেক হাবিবুর রহমান, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর-রশীদ, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার বিশ্বাস ও মেহেদি হাসান, পুলিশ সদর দফতরের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুর রহমান, পুলিশ সদর দফতরের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, শিল্প পুলিশের সাবেক প্রধান মাহবুবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদস্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য্য, ডিএমপি সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার ও ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, রংপুর রেঞ্জের অব্যাহতি পাওয়া ডিআইজি আব্দুল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার সাবেক মো. মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো. মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দফতরের জয়দেব কুমার ভদ্র ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি সাবেক প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আলমগীর কবির, মো হামিদুল আলম, শেখ রফিকুল ইসলাম। ২১তম ব্যাচের মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, মো. সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আসম মাহতাব উদ্দিন, মোহা আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো. মোকতার হোসেন ও পংকজ চন্দ্র রায়।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়। ২৪ ব্যাচের সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ। ঢাকা জেলার সাবেক এসপি মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এসপি গোলাম মোস্তফা রাসেল, ডিএমপির সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, কাজী আশরাফুল আজিম, জসিম উদ্দিন মোল্লা ও মো. শাহজাহানসহ কয়েক জনের নাম রয়েছে। এর বাইরেও পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও থানার অনেক ওসির নামও আছে তালিকায়। এ ছাড়াও গুলির নির্দেশদাতাদের মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের রেঞ্জ ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপারদের (এসপি) নাম পাওয়া গেছে।
গুলির নির্দেশদাতা বিজিবি-আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে : বিজিবি ও আনসারের সদস্যদের নির্বিচারে চালানো গুলিতে নিহতের পাশাপাশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে আহত হয়েছেন শত শত ছাত্র-জনতা। এদের মধ্যে অনেকেই অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন। বিজিবি ও আনসার সদস্যদের সাথে এ সময় সাধারণ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা। অথচ যাতের নির্দেশে বিজিবি ও আনসার সদস্যরা শত শত ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে পঙ্গু-অন্ধ করেছে সেই বিজিবি ও আনসার বাহিনী গুলির নির্দেশদাতা কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে যে কোনো সময় বড় ধরনের ঘটনা ঘটনার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুই বাহিনীর পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সব গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ছাত্রদের গুলি করে হত্যার পাশাপাশি গ্রেফতার এবং ধরে নিয়ে নির্যাতন করতে সহায়তা করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের জোর দাবি।