বিপুল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পর্যটন খাত


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২১, ২০২৪, ৭:১০ অপরাহ্ণ /
বিপুল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পর্যটন খাত

বিপুল সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পর্যটন খাত। লঞ্চ ও বিভিন্ন ধরনের নৌযানে সুন্দরবন ভ্রমণ এবং বনসংলগ্ন ইকো কটেজ ও রিসোর্ট ঘিরে হাতছানি দিচ্ছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে রাজস্ব আয় ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। শুধু সুন্দরবন নয়, এ অঞ্চলে খানজাহান আলীর (রহ.) মাজার ও দিঘি, ষাটগম্বুজ মসজিদসহ রয়েছে ঘুরে দেখার মতো অসংখ্য দর্শনীয় স্থান ও পুরাকীর্তি। বিদ্যমান সমস্যা ও সংকট কাটিয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা গেলে রাজস্ব আয় এবং এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবন ভ্রমণে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে পর্যটকদের। শুধু দেশের নয়, বিশ্বের দর্শনীয় স্থানগুলোরও একটি এই ম্যানগ্রোভ বন। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতি বছর লাখো পর্যটক আসেন সুন্দরবনে। বিশেষ করে ঈদ ও পূজার ছুটিতে এবং শীতকালে পর্যটকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সুন্দরবন। সুন্দরবনে গাছপালার পাশাপাশি বাঘ, মায়াবি হরিণ, কুমির, পাখি, বানরসহ আরও অনেক বন্যপ্রাণী দেখতে পারেন পর্যটকরা। এ ছাড়া জেলেদের মাছ ধরা, মধু, মোম ও গোলপাতা আহরণ দেখতেও আসেন অনেকে।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবন (টোয়াস) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের সংগঠনের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ৬৫টি এবং এর বাইরে ৫-৭টি লঞ্চ খুলনা থেকে পর্যটকদের সুন্দরবন ভ্রমণে নিয়ে যায়-আসে। তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্যুর গাইড রয়েছে প্রায় দুইশ। তিন রাত দুই দিন অথবা দুই রাত তিন দিনের প্যাকেজে প্রতিজন পর্যটকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৭-৮ হাজার থেকে ২২-২৩ হাজার টাকা। নতুন করে আরও ১০টি লঞ্চ এই খাতে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া মোংলা থেকেও ৫-৭টি লঞ্চ যুক্ত রয়েছে সুন্দরবনের পর্যটন খাতে।

প্রতিজন দেশি পর্যটকের জন্য বন বিভাগকে রাজস্ব দিতে হয় ১ হাজার ৫০ টাকা এবং বিদেশি হলে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। মোংলা থেকে ট্রলার ও জালিবোটে করে সুন্দরবনের করমজল ও হাড়বাড়িয়া এলাকায় ঘুরতে যান পর্যটকরা। সেখানে এই কাজে নিযুক্ত আছে অর্ধশতাধিক নৌযান। এ ছাড়া সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ এলাকা থেকেও একইভাবে পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে যান। তবে এই ট্যুরগুলো সকাল-সন্ধ্যা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণে যান ১ লাখ ২৮ হাজার ১৭৫ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশি পর্যটক ছিলেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৪১২ জন এবং বিদেশি ৪ হাজার ৭৬৩ জন। এ থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আয় হয় ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন ২ লাখ ১১ হাজার ৫৭ জন পর্যটক। এর মধ্যে দেশি ২ লাখ ৮ হাজার ৪৩৫ জন এবং বিদেশি ২ হাজার ৬২২ জন। এ থেকে বন বিভাগের রাজস্ব আয় হয় ৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

তবে ট্যুর অপারেটররা বলছেন, দেশি পর্যটকদের সংখ্যা বাড়লেও বিভিন্ন কারণে আগের তুলনায় কমে গেছে বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা। এর জন্য তারা প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে দায়ী করেছেন।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার জানান, আগে বনের কটকা, কচিখালি, দুবলারচর, হিরণ পয়েন্ট, হাড়বাড়িয়া, কলাগাছিয়া ও করমজল এই সাতটি স্থানে পর্যটন স্পট ছিল। নতুন করে শরণখোলার আলীবান্ধা, চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিক, খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কৈলাশগঞ্জে হয়েছে আরও ৪টি পর্যটন স্পট।

সুন্দরবন সংলগ্ন ইকো কটেজঃ সুন্দরবনে পর্যটকদের জন্য এখন নতুন আকর্ষণ ইকো কটেজ ও রিসোর্ট। বনের পাশেই গড়ে উঠেছে এসব কটেজ। পর্যটকরা সেখানে গিয়ে উপভোগ করছেন বনের নৈসর্গিক দৃশ্য। কটেজ মালিকরা জানান, ইতোমধ্যে বনের কৈলাশগঞ্জ, ঢাংমারী ও আশপাশের এলাকায় চালু হয়েছে কমপক্ষে ২৩টি ইকো রিসোর্ট ও কটেজ। এর মধ্যে জঙ্গলবাড়ি, ইরাবতী, গোলকানন, বনলতা, বনবাস, বনবিবি, বনমালী, বাদাবন, সুন্দরী, শর্মিলা, ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন, পিয়ালি, নির্বাসন জঙ্গলভিলা অন্যতম। এ ছাড়া নির্মাণাধীন রয়েছে আরও সাতটি।

ম্যানগ্রোভ হ্যাভেন ইকো রিসোর্টের মালিক রেজাউর রহমান স্বপন বলেন, এসব ইকো রিসোর্ট ও কটেজের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ বাড়ছে। এর মাধ্যমে স্থানীয় অনেকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এলাকার বাজারে বেচাকেনাসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে। তিনি বলেন, ইকো কটেজ ও রিসোর্ট ঘিরেও পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

সুন্দরবন শর্মিলা ইকো কটেজের শর্মিলা সরকার বলেন, এখানে আসা পর্যটকরা সহজেই নৌযানে করে সুন্দরবন ঘুরে দেখতে পারেন। এ ছাড়া তারা বনজীবী এবং বনসংলগ্ন মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি, প্রথা, আচার-বিশ্বাস সম্পর্কে পরিচিত হবে পারেন।

খুলনার আরও কিছু পর্যটন স্পটঃ সুন্দরবন ছাড়াও খুলনায় ঘোরার জন্য রয়েছে আরও বেশ কিছু স্পট। ওই স্পটগুলো ঘিরেও রয়েছে পর্যটন খাত উন্নয়নের ব্যাপক সম্ভাবনা। খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি ঘিরে রয়েছে ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’। চলতি বছর সেখানে যান প্রায় ২০ হাজার দর্শনার্থী এবং এ থেকে রাজস্ব আয় হয় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। কবিগুরুর পূর্বপুরুষের ভিটা রয়েছে রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে।

তেরখাদা উপজেলার চরকুশলা গ্রামে ভুতিয়ার বিলে প্রায় ৪০ হেক্টর এলাকায় রয়েছে পদ্মফুলের সমাহার। অনেকে এখন এই বিলটি পদ্মবিল নামেই চেনেন। প্রতি বছর অনেক লোক ঘুরতে যান সেখানে।

নগরীর ৭ নম্বর ঘাটে ভৈরব নদের তীরে রয়েছে মনোরম পরিবেশে বসার জায়গা। এর পাশে ৪ নম্বর ঘাট থেকে রূপসা সেতু ও রূপসা রেল সেতু পার হয়ে কাজীবাছা নদী পর্যন্ত চালু আছে রিভার ক্রুজ। এ ছাড়া অনেকে দেখতে যান রূপসা সেতু, রূপসা রেল সেতু, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর। নগরীর মুসলমানপাড়া এলাকায় রয়েছে নির্মাণশৈলীতে অনন্য, দৃষ্টিনন্দন ও সুউচ্চ মিনার সংবলিত তালাবওয়ালা মসজিদ।

খুলনায় এলে পর্যটকদের কেউ কেউ দেখতে যান কয়রা উপজেলার আমাদি এলাকার মসজিদকুড় মসজিদ। এটি প্রায় ৫শ বছরের পুরোনো মসজিদ। পাইকগাছা উপজেলার রাঢ়ুলি গ্রামে রয়েছে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি রায়) বাড়ি। দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রামে ‘যেজন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’– এর কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বাড়ি। এ ছাড়া রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহল আমিনের সমাধিসৌধ।

ষাটগম্বুজ মসজিদ ও খানজাহানের (রহ.) মাজারঃ দেশে ইউনেস্কো ঘোষিত তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী ও মুসলিম স্থাপত্যের এই অপূর্ব নিদর্শনটির প্রতি আকর্ষণ রয়েছে দেশের পর্যটকদের। ধারণা করা হয়, পীর খানজাহান আলী (রহ.) ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

ষাটগম্বুজ নাম হলেও মসজিদটিতে মূলত গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদে প্রবেশের প্রধান গেটের ডান পাশে রয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। এখানে প্রাচীন মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলকসহ খানজাহান আমলের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে। আছে খানজাহানের দিঘির ঐতিহ্যবাহী ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ কুমিরের মমি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর এখানে ঘুরতে এসেছেন ৪৮ হাজার ৮৭৫ জন দেশি ও ১২৪ জন বিদেশি পর্যটক। এ থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১২ লাখ ৬৭ হাজার টাকা।

বাগেরহাট শহরে রয়েছে খানজাহান আলী (রহ.) মাজার। এ মাজারের সামনে আছে বিশাল আকৃতির আরেকটি দিঘি। দিঘিতে মিষ্টি পানির কুমির আছে দুটি। দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে ৯ গম্বুজ মসজিদ।

সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ কলবাড়ি এলাকায় রয়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন বরসা রিসোর্ট, মুন্সীগঞ্জে সুশীলনের টাইগার পয়েন্ট, জেলা প্রশাসনের আকাশলীনা ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র ও দেবহাটায় রয়েছে রূপসী ম্যানগ্রোভ রিসোর্ট। সাতক্ষীরা সদর এলাকায় পুকুরের মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেকভিউ ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, শহরের কাছে মোজাফফর গার্ডেন। এসব স্থানে ঘুরতে যান অসংখ্য পর্যটক।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ডিসিপ্লিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. খান মেহেদী হাসান বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে আগের তুলনায় ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। পদ্মাসেতু চালুর পর রাজধানীর সঙ্গে খুলনার যোগাযোগ সহজ হয়েছে। খুলনা অঞ্চলে পর্যটনের অনেক স্পট রয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা গেলে এই খাত এ অঞ্চলে রাজস্ব আয়ের একটি বড় মাধ্যম হতে পারে।