গৃহবধূ থেকে হয়েছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। যিনি হাসলে হাসি ফুটো গোটা বাংলাদেশের মানুষের মুখে, যিনি কাঁদলে কেঁদে ওঠে গোটা বাংলাদেশের মানুষ। তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ভূষিত হয়েছেন আপোষহীন নেত্রীতে।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গণতন্ত্র, দেশ ও দেশের জনগণের জন্য আপোষহীন ভূমিকার কারণে করতে হয়েছে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার। এক ছেলেকে হারিয়েছেন, আরেক ছেলে নির্বাসিত, নিজে করেছেন কারাবরণ। কিন্তু তারপরও মাথা নত করেননি গণতন্ত্রবিরোধী, ফ্যাসিবাদীদের কাছে। মানুষের জন্য এতো যিনি এতো অত্যাচার-জুলম সহ্য করেছেন সেই নেত্রীকেও কখনো খালি হাতে ফেরত দেয়নি দেশের মানুষ। তিন তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেখান থেকেই নির্বাচন করেছেন পরাজিত হননি কখনো।
বেগম খালেদা জিয়া এখন আর কেবল বিএনপির সম্পদ নয়, তিনি এখন সারা বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা ও আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। সেই নেত্রী দীর্ঘ ৪ মাস যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে আজ দেশে ফিরছেন। গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ১০ মিনিট) কাতারের আমিরের দেওয়া ‘এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে’ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন বেগম খালেদা জিয়া। আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ১০টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় উঠবেন তিনি।
এর আগে গতকাল স্থানীয় সময় ২টা ১০ মিনিটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান নিজেই গাড়ী চালিয়ে লন্ডনের বাসা থেকে হিথ্রো বিমানবন্দরের নিয়ে যান। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে বেগম জিয়া লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। পরে তারেক রহমান মাকে বিদায় জানান। খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শর্মিলা রহমানও দেশে আসছেন।
হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় বেগম খালেদা জিয়া। হুইল চেয়ারে বসা খালেদা জিয়ার পেছনে ছেলে তারেক রহমান, ডান পাশে নাতনী জাইমা রহমান ও বাম পাশে পুত্রবধূ জোবাইদা রহমান দাঁড়িয়ে আছেন। এছাড়াও নেতাকর্মীরা চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন খালেদা জিয়ার। সবার সঙ্গে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানান তারেক রহমান। এছাড়া অন্যদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন তিনি।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে আজ বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের ঢল নামবে বলে প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের। খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার খবরে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা দেখা গেছে। দলীয় প্রধানকে স্বাগত ও অভ্যর্থনা জানাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলো। তারা এক হাতে জাতীয় পতাকা ও আরেক হাতে দলীয় পতাকা নেড়ে পুরো পথে বেগম জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাবেন।
ঢাকার প্রস্তুতি নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে আহ্বান থাকবে, কোনো যানজট সৃষ্টি না করে রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে তারা যেন খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান। এক হাতে জাতীয় পতাকা আরেক হাতে দলীয় পতাকা নিয়ে আমরা মহান নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাব। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, এশিয়া মহাদেশের নারীনেত্রীদের মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য যে কয়েকজন সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাদের অন্যতম খালেদা জিয়া। তিনি কখনো ফ্যাসিবাদের কাছে মাথানত করেননি। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দীর্ঘ ৯ মাস তিনি দুই শিশুপুত্রসহ পাকিস্তানি সেনানিবাসে বন্দি ছিলেন। এ মহীয়সী নেত্রী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার মিথ্যা মামলায় তাকে কারাগারে পাঠিয়ে নির্যাতন করে দারুণ অসুস্থ করে ফেলে। খালেদা জিয়ার অসুখের জন্য স্থানীয়ভাবে আমরা চিকিৎসা করিয়েছি, জন হপকিন্সের চিকিৎসকরাও এসেছিলেন। এরপর জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। এ কথাগুলো বলার অর্থ হলো, গণতন্ত্রের প্রশ্নে ত্যাগ স্বীকার করা তার মতো নারীনেত্রী আমাদের চোখে খুব একটা পড়ে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, তিনি আমাদের দেশের মানুষের জন্য বড় সম্পদ। শুধু তা-ই নয়, দেশের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি আমাদের আলোকবর্তিকা। যাকে সামনে রেখে আমরা সব সময় লড়াই সংগ্রাম করি। তবে জনগণের প্রতি তার যে ভালোবাসা ও দূরদৃষ্টি, সেটির নজির তিনি দিয়েছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে দুই মিনিটের বক্তব্য দিয়ে। সেই বক্তব্যে তিনি সবকিছু তুলে ধরেছিলেন। তিনি প্রতিরোধ-প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসার মাধ্যমে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা শুধু ঢাকার নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকার নির্দেশনা দিয়েছি। কিন্তু বেগম জিয়া তো সারাদেশের মানুষের আবেগের কেন্দ্র স্থল। উনাকে এক পলক দেখার জন্য ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ ছুটে আসবে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে বরণ করতে মহানগর উত্তর বিএনপির পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। বিমানবন্দর থেকে হোটেল লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত এলাকায় মহানগর উত্তর বিএনপির ২৬ টি থানা ৭১ টি ওয়ার্ড এবং ৬২০ টি ইউনিটের সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হাতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা নিয়ে অর্ভ্যথনা জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেত্রিকে বরণ করে নেয়া হবে। এছাড়াও দীর্ঘ ১৭ বছর পর নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিনী ডা: জোবায়দা রহমান, তাকেও বরণ করতে আমরা প্রস্তুত।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে সারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং বিএনপির প্রত্যকটি নেতাকর্মীদের ভিতরে যে উচ্ছ্বসিত মনোভাব, যে আনন্দিত মনোভাব এবং সাধারণ মানুষের যে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার তৈরি হবে প্রিয় নেত্রিকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য। সেই বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার ঠেকানোর সামর্থ্য আমাদের কারো নেই।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রত্যাশা করছেন, বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার আগে থেকেই বিমানবন্দর এলাকায় সাধারণ মানুষের ঢল নামবে। সকলেই প্রিয় নেত্রীকে এক পলক দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন। এছাড়া কেবল ঢাকা কেন্দ্রীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীও যাতে উপস্থিত থাকে সে জন্য সকল সংগঠনই কাজ করছে।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার দিনে প্রতিটি সংগঠন পৃথকভাবে বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত অবস্থান গ্রহণ করবেন। বিমানবন্দর এলাকা থেকে লা মেরিডিয়ান হোটেল পর্যন্ত অবস্থান নেবেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মীরা। লা মেরিডিয়ান থেকে খিলক্ষেত পর্যন্ত ছাত্রদল, খিলক্ষেত থেকে রেডিসন পর্যন্ত যুবদল, রেডিসন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম পর্যন্ত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি, আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী করবস্থান পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক দল, বনানী করবস্থান থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত কৃষক দল, কাকলী মোড় থেকে বনানী শেরাটন হোটেল পর্যন্ত শ্রমিক দল, বানানী শেরাটন হেটেল থেকে বনানী কাঁচাবাজার পর্যন্ত ওলামা দল-তাঁতী দল-জাসাস-মৎসজীবী দল, বনানী কাঁচাবাজার থেকে গুলশান-২ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা দল ও সকল পেশাজীবী সংগঠন, গুলশান-২ গোলচত্ত্বর থেকে গুলশান এভিনিউ রোড পর্যন্ত মহিলা দল, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা তাদের সুবিধামত স্থানে অবস্থান গ্রহণ করবেন।
যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম নয়ন বলেন, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানাতে লাখ লাখ মানুষের ঢল নামবে। ওই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলেরই প্রায় ৭০ হাজার নেতাকর্মী উপস্থিত থাকবেন।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেন, বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ম্যাডামকে পতাকা নেড়ে অভ্যর্থনা জানবেন। তিনি জানান, নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সেদিন লাখো মানুষের ঢল নামবে প্রিয় নেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে। তাই সকলে যাতে সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান করতে পারে সে বিষয়ে আমাদের দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব তানভীর আহমেদ রবিন বলেন, সারাদেশের মানুষের প্রাণের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ চার মাস পর দেশে ফিরছেন। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। আমরা প্রত্যাশা করছি সেদিন বিমানবন্দর থেকে শুরু করে গুলশান পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের ঢল নামবে।
গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। লন্ডন ক্লিনিকে টানা ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বাসায় লন্ডনের ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন।###