ড. মাহবুব হাসান
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত রাজ্যগুলোর সরকার কয়েক মাস ধরে মুসলিমদের বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলছে। এ অন্যায় আচরণের শিকার মানুষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- এরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেছে।
ওই রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রী আবার বেশ গর্বের সাথে তাদের এ বিক্ষোভ দমনের কৌশল নির্বাচনী সভাগুলোতে তুলে ধরছেন। আমার মনে হয়, এ ধ্বংসযজ্ঞ এমন এক সময়ের স্মারক যখন একটা অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও ভঙ্গুর গণতন্ত্র সবার চোখের সামনে নির্লজ্জভাবে একটা দুর্বৃত্ত ও হিন্দু ফ্যাসিবাদী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে এবং বিপুল মানুষ তাতে সোৎসাহে সমর্থন দিচ্ছে। আমরা এখন হিন্দু সাধুবেশী গুণ্ডাদের দিয়ে শাসিত হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। এদের কাছে মুসলিমরা হলো এক নম্বর গণশত্রু।
এ বক্তব্য অ্যাক্টিভিস্ট ও বুকার পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায়-এর। তিনি হিন্দু কী খ্রিষ্টান- তার চেয়েও বড় পরিচয় তিনি একজন সজাগ-সচেতন মানুষ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে শাসকদের অমানবিক ও অনৈতিক কর্মের প্রতিবাদী এক মানুষ তিনি। মানুষ পরিচয়ই সব থেকে বড় তার। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর যে ধরনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে শাসক দলের তরফ থেকে, অরুন্ধতী রায় তারই চিত্র তুলে ধরে এসব কথা বলেছেন। এই অন্যায়ের প্রতিবাদেই তিনি বলেছেন, ভারতে ‘ফ্যাসিবাদী এন্টারপ্রাইজ’ শাসন চলছে। এই ফ্যাসিবাদের তরুণ প্রজন্ম দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কী নরেন্দ্র মোদি কল্পনা করতে পারছেন? হয়তো পারছেন, কিংবা পারছেন না। পারছেন না বলেই হিন্দুত্ববাদী তরুণদের বড় একটা অংশ বুলডোজার নিয়ে নেমেছে মুসলিমদের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি গুঁড়িয়ে দিতে। ওই অন্যায় অপরাধের বর্ণনা দিয়ে জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন রাজ্য সরকারের লোকজনেরা। অপরাধ হিসেবে বলছেন মুসলমানেরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সেই অপরাধেই তাদের বাস্তুচ্যুত করা হচ্ছে, ব্যবসাস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদের উদ্বাস্তু বানানো হচ্ছে।
সরকারবিরোধী বিক্ষোভ গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কি নিষিদ্ধ? কিংবা চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে কি জনগণের প্রতিবাদ জানানো ও সামাজিক প্রতিরোধের অধিকার নেই? যদি না-ই থাকে, তাহলে অগ্নিপথ নামক প্রকল্পের বিরোধিতাকারী হিন্দু যুবকদের বাড়িঘর তো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে যায়নি সেসব রাজ্যের সরকারি রাজনীতিকরা? কেন তারা হিন্দু যুবকদের প্রতিবাদকে অপরাধ বিবেচনা করছেন না? তারা হিন্দু বলে? আর মুসলিম বলে বিক্ষোভকারী চিহ্ন দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে বসতি, ব্যবসাকেন্দ্র ইত্যাদি থেকে? এই দ্বৈত সরকারি নীতি কি প্রমাণ করে চলেছে গণতান্ত্রিক দেশ বলে চিত্রিত ও চিহ্নিত ভারতে?
২০১৪ সাল থেকে ওই সব তরুণের মনে এমন ধর্মান্ধ তরিকার জন্ম দিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি ও তার রাজনৈতিক সহচররা। মোদি বুঝেছিলেন যে, ভারতের ২০ কোটি মুসলিম ভোটের চেয়ে তরুণদের মধ্যে ধর্মান্ধতার জারক পুঁতে দেয়া গেলে নির্বাচনে বিজয় সুনিশ্চিত। আবার হিন্দু-ইজমের জয়জয়কারও অব্যাহত রাখা সম্ভব। কিন্তু তিনি বোঝেননি যে, ওই তরুণ হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যাবে একসময়, একদিন।
বিজেপি নিয়ন্ত্রিত রাজ্য সরকারগুলো যে উন্মাদের মতো প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিমদের ওপর বুলডোজার চালানোর নিষ্ঠুরতার বর্ণনা দিয়ে উল্লাস করবে, এটা ভাবতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি। সেই অপরাজনীতির সূত্রেই নূপুর শর্মার ঔদ্ধত্যপূর্ণ কুমন্তব্য বেরিয়ে আসে ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বিরুদ্ধে। নূপুর শর্মা এতটা চিন্তা করতে পারেননি যে হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা আর ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর মুসলমানদের দমন ও দলন এক জিনিস নয়। মোদি সরকার নূপুর ও জিন্দালকে পদচ্যুত করে দোষ স্খলনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে।
“এর আগে মুসলিমরা গণহত্যা, গণপিটুনিতে হত্যা, পরিকল্পিত খুন, হেফাজতে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ভুয়া অভিযোগে জেলবাসের শিকার হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়া ওই তালিকায় একটি নতুন সংযোজন। বিজেপি এটিকে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে দেখছে। গণমাধ্যমে ওই ঘটনাগুলো যেভাবে এসেছে তাতে মনে হচ্ছে, বুলডোজারকে সাধারণভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই; এতে একটি স্বর্গীয় ও প্রতিশোধমূলক শক্তি আরোপ করা হয়েছে। এর যে বিশাল ধাতব থাবা, যা দিয়ে ‘শত্রুকে বিনাশ’ করা হচ্ছে তাকে পুরাকথার অসুরবিনাশী দেবতার একটা যান্ত্রিক সংস্করণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এ বুলডোজার এখন প্রতিশোধপরায়ণ হিন্দু জাতির কাছে একটা কবজে পরিণত হয়েছে।
এমন অপকর্মের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে ভারত সরকারের লোকজন খুব জোর দিয়ে বলছেন, মুসলিমরা তাদের লক্ষ্যবস্তু নয়; তারা শুধু অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ এটি এক ধরনের পৌর কর্তৃপক্ষের রুটিন দায়িত্ব পালনের মতো। তবে এসব যুক্তি বিশ্বাসের অযোগ্য বললেও কম বলা হয়। এটা হলো এক ধরনের তামাশা, যার লক্ষ্য ভীতি ছড়ানো। শুধু সরকার নয়; অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকও জানে, দেশের প্রতিটি শহরের বেশির ভাগ স্থাপনা হয় বেআইনিভাবে অথবা আইনকে চতুরতার সাথে ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে। তা ছাড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নামে মুসলিমদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মালিককে কোনো প্রকার নোটিশ দেওয়া ছাড়াই ও কোনো প্রকার আপিল বা শুনানির সুযোগ না দিয়ে। অর্থাৎ বুলডোজারওয়ালারা এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে পারছে।” (অরুন্ধতী রায়/সমকাল/২৩ জুন, ২২)
অরুন্ধতী রায়ের এই লেখা তথ্য-উপাত্তনির্ভর। ফলে অস্বীকার করার উপায় নেই। ঠিক একই কায়দায় বাংলাদেশেও বিরোধীদের দলনে ও দমনে রাজনৈতিক তরুণ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছে যারা (হেলমেটধারী, হকিস্টিকধারী, কিরিচ, রামদা ও পিস্তলধারী) সবসময় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর। কখনো কখনো উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিরোধীদের রাজনৈতিক উচ্ছৃঙ্খলায় নামতে আহ্বান জানাচ্ছে। বিএনপি ও তার অ্যালিরা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে, এ রকম মন্তব্য করছে, তাদের আন্দোলন করার মতো শক্তি নেই, তারা কেবল লিপ সার্ভিস দিয়ে চলেছে, উসকে দিতে চাইছে তাদের। যদি বিএনপি ও তার অ্যালি সত্যই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামে এবং ভাঙচুরে মেতে ওঠে, তাহলে তার বিরুদ্ধে সরকারি তরুণরা বুলডোজার নিয়ে নামবে- এটাই বুঝতে পারছি আমরা।
এ হচ্ছে সরকারি দলের রাজনৈতিক চাল, যাতে প্রতীকী বুলডোজার নামানো যায়। ওই বুলডোজার প্রতীকী হলেও তার উন্মত্ততা কেমন হতে পারে তা অনেক রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যেই আমরা দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলে একটি মেয়েকে যেভাবে পেটালো ছাত্রলীগের ছেলেরা, সেটা ছোটো একটা ঘটনা, যা আমাদের মনে আছে, মনে আছে জনগণেরও, তা মানবতার কোন স্তরের তা আমরা বলতে পারব না। শিক্ষা ক্ষেত্রে এ রকম নারকীয় ঘটনার জন্মদাতারা আজ বুঝতেও পারছেন না যে এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তাদেরই বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চিন্তা ও ভাবনাকে যে বুলডোজারের রাজনীতিতে নামিয়ে আনবে, সেই পরিণতির কথা একবারও ভাবছে না তারা।
২.
ভারতের প্রবাসী মানুষের সংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ ৪৬ হাজার। তারা প্রতি মাসেই মোটা অঙ্কের রেমিট্যান্স পাঠায় দেশে। ওই প্রবাসীদের অর্ধেকই থাকে তিনটি মুসলিম দেশ- সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩০ লাখ ৪২ হাজার, সৌদি আরবে ২০ লাখ ৬০ হাজার, কুয়েতে ১০ লাখ ভারতীয় কর্মসূত্রে বাস করছে।
নূপুর শর্মা মুহম্মদ সা:-এর সম্পর্কে যে নির্মম ও ধর্মান্ধ মন্তব্য করেছে, তার জন্য ভারত সরকার কেন শশব্যস্ত হয়ে নূপুর ও জিন্দালকে পদচ্যুত করেছে মুসলিমবিদ্বেষী তরুণরা না বুঝলেও মোদি সরকার বেশ ভালোভাবে বুঝেই ওই পদক্ষেপ নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কড়া প্রতিবাদ জানানোটা যদি অ্যাকশনে পরিণত হয়, মানে ভারতের রেমিট্যান্স আয়কারীদের পর্যায়ক্রমে দেশে ফেরত পাঠায়, তাহলে বিপুল ভারতের বৈদেশিক আয়ে ঘাটতি দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত ওই দেশগুলো যদি তাদের তেল ও গ্যাস সরবরাহ বিক্রি ও বন্ধ করে দেয়, তাহলে ভারতে জ্বালানি সঙ্কট চরমে পৌঁছাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা জানি, ভারত এখন বিপুল পরিমাণ তেল আনছে রাশিয়া থেকে। সেটা রাশিয়ার অনুরোধই হোক বা ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের সুযোগ নিয়েই হোক, তা দীর্ঘমেয়াদে ভায়াবল হবে না। কারণ দূরত্ব ও সময় একটি বড় ফ্যাক্টর। আর পরিবহনও সেই সাথে জড়িত।
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) বা উপসাগরীয় সহযোগী সংস্থার সদস্য আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কাতার, ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২১-২২ সালে আমিরাত ছিল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাণিজ্যের পরিমাণ ৭২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, সৌদি আরব চতুর্থ বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২১-২২ সালে বাণিজ্যের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, কাতার পঞ্চম স্থানে, তার বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, কাতারের বাণিজ্য পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার। এক নম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদারিত্ব ১ দশমিক ১৯ ট্রিলিয়ন ও চীনের ১ দশমিক ১৫ ট্রিলিয়ন। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভেঙে যাক, তা কোনো পক্ষই চায় না, চাইতে পারে না। ভারত কি সেই নেতিবাচক পথে যাবে?
এসব মুসলিম দেশ ওআইসির সদস্য। তারা যদি অ্যাকশনে যেতে চায় কিংবা ভারতের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর অনৈতিক ও উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতির উন্মাদনার বিরুদ্ধে যায়, আমরা জানি ও মানি যাবে না, তারপর সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা তো দেখেছি, রাশিয়া হুমকি দিলেও ইউরোপের দেশগুলোতে সহসাই গ্যাস ও তেল সরবরাহের পাইপ বন্ধ করে দেয়নি। এখন পর্যায়ক্রমে রাশিয়া সেই পথে হাঁটছে। আর ইউরোপে জ্বালানি সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
আমরা কি মুসলিম দেশগুলোর ওই রকম একটি বা একাধিক পদক্ষেপ নিতে দেখব ভবিষ্যতে? উন্মত্ত রাজনীতির টুঁটি চেপে ধরতে না পারলে একদিন বড় রকম খেসারত দিতে হতে পারে। সেটা ভারতের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের রেসে থাকা সংগ্রামী জাতির জন্যও খারাপ হতে পারে। সামান্য একটি রাজনৈতিক লাভের লোভ যদি সংবরণ করা না যায়, ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার অন্ধ নেশার রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে সামনের দিনগুলোতে সত্যই সাধারণ মানুষের ভাগ্যে নেমে আসবে চরম দুর্ভোগ ও দুর্ভাগ্য। আমরাও কী সে রকম একটি পরিস্থিতির দিকে ধাবমান?