এস এম মিন্টু
বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বেতার বার্তায় ডিআইজি (অপারেশন) মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি সরাসরি বেতারযন্ত্র মারফত নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘এখন থেকে কোনো পুলিশ সদস্য যদি জনসাধারণ কর্তৃক মারধরের শিকার হয় বা লাঞ্ছিত হয় সে ক্ষেত্রে পুলিশ সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করবে এবং প্রতিটি জেলার এসপিরা সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
এমন একটি অডিও বার্তা এসেছে মিডিয়ার হাতে। তবে অডিও রেকর্ডটির বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের কোনো কর্মকর্তা স্বীকার করেননি। পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বেতার বার্তায় ডিআইজি (অপারেশন) মো: রেজাউল করিমের কণ্ঠ। তবে এ বিষয়ে জানতে ডিআইজি রেজাউল করিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন। এরপর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি একটি ট্রেনিংয়ে আছি। আমার কাছে এ ব্যাপারে আরো একজন ফোন করেছিলেন। আমি বিষয়টি অবগত নই।
এ দিকে এমন বার্তা পাওয়ার পর পুলিশের মধ্যে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, পুলিশের সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে হলে পুলিশকে আরো কঠোর এবং শক্তিশালী হতে হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এই কথাগুলো বেতার বার্তায় নয়, পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘোষণা দিক।
সূত্র জানায়, বর্তমানে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে পুলিশের মনোবল একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আইন তার নিজের গতিতে চলবে। কোনো অপরাধীর কাছে মাথা নত করা হবে না।
অডিওটিতে শোনা গেছে, ‘পুলিশের লোক, সেনাবাহিনীর লোক, ডিফেন্সের লোক বা সরকারি যেকোনো কর্মচারী কোনো প্রকার কোনো আঘাতপ্রাপ্ত হবে না বাহির থেকে। কোনো প্রকার আঘাতপ্রাপ্ত হবে না, বিশেষ করে পুলিশ সুপারদের (এসপি) নিশ্চিত করবেন। অবশ্যই স্যারদের কাছে জবাবদিহি করবেন। অবশ্যই স্যারদের ম্যাসেজটা জানাবেন।’
এর জবাবে ডিআইজি রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা সবাই এক, কোনো রকম পুলিশের গায়ে হাত দেয়া, পুলিশের সাথে দুর্ব্যবহার করা, পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগ হবে। সেটি যেই হোক, কোনো সমস্যা নেই, কেউ করলে সাথে সাথে আমাকে জানাবেন। পুরো দায়দায়িত্ব আমার। প্রয়োজনে চাকরি করব না তবুও এগুলো আর সহ্য করব না।’
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর থেকেই বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সব ইউনিট এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১৬ বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়ভাবে ব্যবহারের ফলে পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পুলিশ নানাভাবে চেষ্টা করছে যাতে নিজেদের সক্ষমতা ফিরিয়ে জনসাধারণের পুলিশ হিসেবে কাজ করা যায়।
সম্প্রতি রাজধানীসহ সারা দেশে ছিনতাই, চুরি-ডাকাতিসহ খুনোখুনি বেড়ে গেছে। গতকালও রাজধানীর মতিঝিলে মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে এক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রায় ২২ লাখ টাকা সমমূল্যের ডলার অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের তথ্যে জানা গেছে, গত জানুয়ারিতে সারা দেশে ২৯৪ জন খুন হয়েছেন। এ সময় নিপীড়নের শিকার হন এক হাজার ৪৪০ নারী-শিশু। একই সময়ে ১০৫টি অপহরণ, ৭১টি ডাকাতি ও ১৭১টি চুরির ঘটনা ঘটে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে খুন হয়েছে ৯৪৭ জন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার সাত মাস পার হলেও পুলিশ তার কর্মকাণ্ডে পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। আর এ সুযোগে সক্রিয় হয়েছে অপরাধীচক্র। দিনে-দুপুরে ঘটছে খুন, ছিনতাই, রাহাজানি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার কারণে কোনো বড় অভিযানে গেলে সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর চড়াও হতে পারে- এমন ভয় থাকায় তারা ঘটনাস্থলে যাচ্ছে না।
ফলে অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছে না। আর এ কারণে বাড়ছে অপরাধের মাত্রা। এ ছাড়া জুলাই আন্দোলনে এক হাজার ৯৪টি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এখনো পুলিশের বিভিন্ন শাখায় পর্যাপ্ত গাড়ি দিতে পারেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ কারণে পুলিশের যানবাহন সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। যানবাহন সঙ্কটের কারণে জরুরি ভিত্তিতে তারা অপারেশনে যেতে পারছে না।
এ ছাড়া পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্বাচিত সরকার এলে নতুন উদ্যমে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ কারণে অনেক পুলিশ সদস্য পূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন না। এ ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের স্পটভিত্তিক চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। যেসব স্থান থেকে তারা চাঁদাবাজি করে থাকে, সেখানে ৫ আগস্টের পর তারা কম যাচ্ছেন। কারণ চাঁদা চাইতে গেলে জনগণের রোষানলে পড়তে হতে পারে, এমন ভয়ে তারা সেখানে যাচ্ছেন না। এতে সেখানে চাঁদাবাজ চক্র সক্রিয় হয়েছে। এতে পুলিশের টহল জ্যামিতিক হারে কমে গেছে।
এ ছাড়া ঢাকাসহ তৃণমূলপর্যায়ে বদলির প্রভাব, অ্যাকশনে গেলে শাস্তির ভয় এবং ডিএমপির ক্রাইমবেজ না বোঝা ও বদলি হওয়ার পর নতুন স্থানের পথঘাট না চেনার কারণে পুলিশ পুরোপুরি সক্রিয়ভাবে কাজ করছে না। আর এসব কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে পুলিশ অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করায় সারা দেশে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এর ফলে পুলিশের কিছু সদস্য ট্রমায় ভুগছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পুলিশকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ, মোটিভেশনাল ট্রেনিং দেয়া ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।
অন্য দিকে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে মানুষ বেপরোয়া হয়ে গেছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে। মানুষের মধ্য থেকে পুলিশের ভয় কেটে গেছে। পুলিশ টহলে গেলে তাদের ওপর আক্রমণ করতে দ্বিধা করছে না। এতে পুলিশ ম্যারাথন টহলে ভয় পাচ্ছে। যাদের টহলে পাঠানো হচ্ছে, তারা টহল না দিয়ে সড়কের এক পাশে বসে থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজধানীর কাওরানবাজার ও চট্টগ্রামের একজন ওসিকে দিনে-দুপুরে শত শত মানুষের সামনে হামলা করে মারধরের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এতে পুলিশের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।
রাজধানীর কাওরানবাজার ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল ও সমাজবিরোধী কিছু ব্যক্তির অসৌজন্যমূলক ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা পুলিশ বাহিনীর জন্য ‘মর্মান্তিক, চরম উদ্বেগজনক ও আশাহত করার মতো’। বিবৃতিতে বলা হয়, পুলিশ বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জানমালের নিরাপত্তা ও অপরাধ দমনে নিরলসভাবে কাজ করছে। এটি জনগণের সেবায় নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান।
মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের অবদান গর্বের অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। তবে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় কিছু অসৎ ও অপেশাদার কর্মকর্তার ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, যা পুলিশ বাহিনীর জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জানায়, বর্তমানে বাহিনীর সদস্যরা নতুন উদ্দীপনা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করতে কিছু উচ্ছুঙ্খল ও শান্তি-ভঙ্গকারী ব্যক্তি পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছে, যা জনমনে হতাশা তৈরি করছে। পুলিশ বাহিনী এসব চ্যালেঞ্জ পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে পুলিশ বাহিনী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
আপনার মতামত লিখুন :