চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ‘এ’ গ্রুপে জিতলে টিকে থাকবে আশা, হারলেই বিদায়। এমন সমীকরণ নিয়ে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। তাতে শুরুটা মোটামুটি ভালোই ছিল- প্রথম ১০ ওভারে ১ উইকেটে ৫৮। কিন্তু ২১ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারিয়ে মাঝের ওভারে পথ হারায় বাংলাদেশের ইনিংস। ২ উইকেটে ৯৭ রান থেকে দ্রুতই বাংলাদেশের স্কোর হয়ে যায় ৫ উইকেটে ১১৮। ধস সামাল দিতে এরপর ক্রিজে যেন নোঙর ফেলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। সময়োপযোগী দুটি জুটিতে দলকে দিশা দিলেও দীর্ঘ করতে পারেন নি ইনিংস। তার বিদায়ের পর কিছুটা লড়াই করে জাকের আলী অনীক।
তবে সেটিও দিতে পারেনি স্বস্তির পূঁজি। গতকাল পিন্ডিতে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে বাংলাদেশ ৯ উইকেটে থামে ২৩৬ রানে। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২৩ বল আর ৫ উইকেট হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় নিউজিল্যান্ড। তাতে বাংলাদেশকে বিদায় দিয়ে সবার আগে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করল মিচেল স্যান্টনারের দল। কিউইদের এই জয়ে এই গ্রুপ থেকে শেষ চার নিশ্চিত হয়ে গেছে ভারতেরও। এই চার দলের বাকি দুটি ম্যাচ রয়ে গেল শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী।
বলতে গেলে এদিন বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে ডট বলের ফেরে। ধারাভাষ্যকক্ষে বিদেশি সাবেক ক্রিকেটারদের মধ্যে অতিরিক্ত ডটের প্রসঙ্গে চলেছে বিস্তর আলাপ। অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ওপেনার ম্যাথু হেইডেন টাইগারদের অতিরিক্ত ডট দেওয়া নিয়ে করেছেন সমালোচনা। টসে হেরে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের প্রায় পুরোটাই এগিয়েছে শম্বুক গতিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ এমন ব্যাটিং পারফরম্যান্সের উপযুক্ত বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘প্রথম গিয়ার থেকে ফিফথ গিয়ার’! স্ট্রাইক বদল করতে ব্যর্থ হয়ে টানা ডট, এরপর বড় শট খেলতে গিয়ে বিদায়। বাংলাদেশ শেষমেশ ইনিংসের সমাপ্তি টেনেছে ১৮১টি ডট দিয়ে! এরমধ্যে ছিলো তিনটি লেগ বাই। চলমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আর কোন ইনিংসে এত বেশি ডট দেখা যায়নি। পাওয়ারপ্লেতে ৪০টি বলে রান বের করতে পারেননি বাংলাদেশি ব্যাটাররা। মাঝের ওভারের খেলা গড়তেই হয় যেখানে নিয়মিত স্ট্রাইক বদলের মাধ্যমে, সেখানে ১৮০ বলের মধ্যে ১০২টি ডট দিয়েছেন টাইগাররা। ১১তম ওভার থেকে ৪০ ওভার পর্যন্ত, এই সময়ে ৫ উইকেট হারিয়ে ১১৪ রান এসেছে। শেষ দশ ওভারে ৩০ ডট দিয়ে ৬৪ রানে এনেছে বাংলাদেশ।
এদিন মাইকেল ব্রেসওয়েলের মতো অফ স্পিনারের উপর বাংলাদেশ কোন চাপ প্রয়োগ করেনি। নিজের পুরো ১০ ওভার তিনি করে গেছেন টানা। ডট দিয়েছেন ৪৩টি। তার বোলিংয়ে ২৬ রানের বিনিময়ে ৪টি উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। দলটি মিচেল স্যান্টনারের বাঁহাতি স্পিনে দিয়েছে ৩১ ডট। ডানহাতি পেসার কাইল জেমিসনের বোলিংয়েও সমান সংখ্যক ডট এসেছে। উইলিয়াম ও’রর্কের সামনে ১০ ওভারের ৪২ বল রান ছাড়া পার করেছে বাংলাদেশ। ম্যাট হেনরি ৯ ওভারে ৫৭ রানে পেয়েছেন ১ উইকেট। ডানহাতি এই পেসার ২৯ বলে কোন রান খরচ করেননি। গ্লেন ফিলিপস দুই ওভার করে ডট দিয়েছেন পাঁচটি।
অতিরিক্ত ডট নিজেদের সবশেষ ওয়ানডে সিরিজেও বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে। গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল সফরকারীরা। ক্যারিবিয়ানে বাংলাদেশি ব্যাটাররা প্রত্যেক ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটারদের থেকে বেশি বল ডট দিয়েছিলেন। তিনটি ম্যাচেই বাংলাদেশের ডট পার্সেন্টেজ ছিল পঞ্চাশের উপরে। শুরুতে তানজিদ হাসানকে নিয়ে ভালোই ব্যাট করছিলেন। তাঁদের ৪৫ রানের জুটি ভাঙে ব্রেসওয়েলের করা নবম ওভারে। ২৪ বলে ২৪ রান করা তানজিদ ভালো করেননি- তা বলাই যায় এবং সেটাই সত্যি। কিন্তু পরের ব্যাটসম্যানরা যেন তানজিদকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশনেই নেমে গেলেন। পরের চারজনের মধ্যে কেবল একজনই রানসংখ্যা দুই অঙ্কে নিতে পারলেন— মেহেদী হাসান মিরাজ ১৪ বলে ১৩ রানের বেশি করেননি। বাকি তিনজন তাওহীদ হৃদয় ২৪ বলে ৭, মুশফিকুর রহিম ৫ বলে ২ ও মাহমুদউল্লাহ ১৪ বলে ৪ রান করে আউট। যাঁদের ঝুলিতে অভিজ্ঞতার কমতি নেই ও যাঁদের একাদশে ধরে রাখতে এত রদবদল- সেই মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর সম্মিলিত রান ১৯ বলে ৬!
এর মাঝে রানে-বলে কিছুটা লড়াই চালিয়ে গেছেন শান্ত। ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ও’রুর্কের বলে ব্রেসওয়েলের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ১১০ বলে ৯ চারে করেছেন ৭৭ রান। ওপেনিংয়ে নেমে ১১০ বলে ৯ চারে ৭৭ রান করেন শান্ত। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যা বাংলাদেশের কোনো অধিনায়কের প্রথম ফিফটি। তিনি ছাড়া ত্রিশ ছাড়াতে পারেন কেবল জাকের আলি (৫৫ বলে ৪৫)। আউট হওয়ার আগে জাকেরের সঙ্গে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে তুলেছেন ৪৫ রান। শান্তর আউটের পর রিশাদ হোসেনের সঙ্গে ৩৩ ও তাসকিনের সঙ্গে ৪৫ রানের দুটি জুটি গড়ে বাংলাদেশের রানটা আড়াই শর কাছাকাছি নিয়ে যান জাকের। অষ্টম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়ার আগে জাকের ৫৫ বলে তিন চার ও এক ছয়ে করেছেন ৪৫ রান। রিশাদের রান ২৫ বলে ২৬ আর তাসকিন ২০ বলে করেছেন ১০ রান। টানা ১০ ওভার বোলিং করে ২৬ রানে বাংলাদেশের প্রথম ৫ উইকেটের ৪টিই নেন নিউজিল্যান্ডের অফ স্পিনার মাইকেল ব্রেসওয়েল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের কোনো স্পিনারের যা সেরা বোলিং।
তবে ছোট লক্ষ্য নিয়েও লড়াই চালিয়ে গেছে বাংলাদেশ। তাসকিন আহমেদ যার শুরুটা করেছেন এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম সেঞ্চুরিয়ান উইল ইয়ংকে শূন্য রানে ফিরিয়ে। পরে দলীয় ১৫ রানে আরেক অভিজ্ঞ কেন উইলিয়ামসনের উইকেট নিয়ে জয়ের আশা জাগান নাহিদ রানা। ঐ পর্যন্তই। পরের গল্পটা শুধুই কিউই ব্যাটারদের রানফোয়ারা ছোটানোর। বিশেষ করে রাচিন রবিন্দ্র আর টম লাথামের দ্যুতিময় ব্যাটিংয়ে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে টাইগার বোলারদের। চতুর্থ উইকেটে এই দুজনের ১২৯ রানের জুটি নিউজিল্যান্ডের জয় তরাণি¦ত করেছে। ১০৫ বল খেলে ১১২ রানের ইনিংসে ১২টি চারই মেরেছে রবিন্দ্র। জয় থেকে একটু আগে ৭৬ বলে ৫৫ রানে থামেন লাথাম। বাকি পথটুকু অনায়াসেই পাড়ি দেন গ্লেন ফিলিপস (২৮ বলে ২১) ও মাইকেল ব্রেসওয়েল (১৩ বলে ১১)।