ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকার কুমিল্লার বেশ কয়েকটি চোরাইপথ দিয়ে প্রতিনিয়ত দেশে আসছে ভারতের নিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর ভেজাল চিনি। অবৈধভাবে দেশে আসা ভারতীয় চিনির মান নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি বলেও মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানেও এসব অবৈধ চিনি আসা ঠেকানো যাচ্ছে না। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
অপরদিকে সীমান্তবর্তী এলাকায় অনেকেই জানিয়েছেন চোরাইপথে আনা এসব চিনির বস্তার আড়ালে কৌশলে ঢুকছে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের ছোট-বড় চালান। অন্যদিকে কাস্টমস থেকে নিলামে কেনা চিনির স্লিপ ব্যবহার হচ্ছে চোরাই চিনির ক্ষেত্রে। সীমান্তঘেঁষা উপজেলা ব্রাহ্মণপাড়া এখন ভারতীয় চিনির ডিপো।
কুমিল্লার আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, চৌদ্দগ্রাম, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিবাহিত হয়েছে। সীমান্তের এই ৫টি উপজেলা দিয়ে চোরাচালান ও বিভিন্নরকম মাদকদ্রব্যের চালান অহরহ আসছে। তবে সীমান্তঘেঁষা ওই ৫টি উপজেলার মধ্যে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল, হরিমঙ্গল, বাগড়া, গঙ্গানগর, সালদানদী রেলস্টেশন, আশাবাড়ি, তেতাভূমি ও নয়নপুর সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবাধে ভারতীয় বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার চিনি আসছে কুমিল্লায়।
এসব চিনি মজুদ রাখার জন্য কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া এবং মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ বাজার ও বাঙ্গরা বাজার গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় গোডাউন। তারপর চোরাকারবারিদের হাত ধরে ট্রাকভর্তি চিনি চলে যাচ্ছে কুমিল্লার বড় বড় বাজার ও চাঁদপুরের হাজিগঞ্জসহ নবীনগর, বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন বাজারে।
অভিযোগ রয়েছে, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া এলাকার চোরাকারবারিরা ভারতীয় চিনি চোরাচালানের সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বাজারজাত করছে। কেবল তাই নয়, সীমান্তপথে ব্রাহ্মণপাড়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা চিনি ঢুকছে এসব বস্তার আড়ালে মাদকের (ইয়াবা, আইস) চালানও যুক্ত থাকছে। গোডাউনে চিনি মজুদের পাশাপাশি চিহ্নিত বস্তা থেকে আলাদা করা হয় মাদক। তারপর ট্রাকযোগে চিনির সঙ্গে মাদকও পাচার হচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
ভারতীয় চিনি চোরাচালানের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বাহ্মণপাড়া উপজেলার সাহেবাবাদ গ্রামের ফারুক হোসেন জানান, তিনি মাছের ব্যবসার পাশাপাশি সীমান্তপথে অবৈধভাবে আসা ভারতীয় চিনির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সাহেবাবাদ বাজারে ভারতীয় চিনি মজুদ করার জন্য তার নিজস্ব গোডাউন রয়েছে। নির্বিঘ্নে চিনি চোরাচালান ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্রাহ্মণপাড়া থানা পুলিশকে মাঝেমধ্যে ম্যানেজ করতে হয় বলেও জানান ফারুক হোসেন।
তিনি আরো জানান, ব্রাহ্মণপাড়ায় তিনি ছাড়াও রুবেল, নাইঘরের রুহুল আমিন, খোরশেদসহ আরো অনেকেই আছে যারা সিন্ডিকেট করে ভারতীয় চিনি চোরাচালান ব্যবসা করছেন। কুমিল্লা সদরের নিশ্চিন্তপুরের হামজা সিন্ডিকেটের সঙ্গেও অনেকে জড়িত। চোরাই পথে আসা এসব চিনি কুমিল্লা শহরের বাজার, ক্যান্টনমেন্ট বাজার, ব্রাহ্মণপাড়া বাজার ও চাঁদপুরেও পাঠানো হয়। চিনি সরবরাহে মিনি ট্রাক ব্যবহার করেন তিনি। আর অন্যরা বড় ট্রাকে চিনির চালান পাঠায়। চিনির আড়ালে মাদক পাচার হয় কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, এটি তার জানা নেই।
এদিকে মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজারের ভারতীয় চিনি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি চোরাইপথে আসা চিনি কিনেন না, এসব চিনি আটকের পর কাস্টমস থেকে নিলামে কিনে ব্যবসা করেন। কাস্টমস থেকে নিলামে কেনা চিনির সঙ্গে অবৈধভাবে ভারত থেকে আসা চিনি গোডাউনে মজুদ করেন এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। নিলামে কেনা চিনির বস্তা বিভিন্ন স্থানে সরবরাহকালে এরসঙ্গে মাদক চালানের সম্পৃক্ততা নেই বলেও তিনি দাবি করেন।
ব্রাহ্মণপাড়া সীমান্ত দিয়ে মাদক ও চোরাচালান বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স.ম আজহারুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ‘আমার পক্ষে রাত জেগে সীমান্ত পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়।’ ইনকিলাব প্রতিনিধিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে ইউএনও বলেন, ‘বিজিবিকে জিজ্ঞেস করুন সীমান্ত দিয়ে কিভাবে মাদক, চোরাচালান পণ্য আসে, পুলিশ কি করে? ওদের জিজ্ঞেস করুন।’
তিনি বলেন, ‘ভারতীয় চিনির সঙ্গে মাদক আসে এমন সন্দেহ থেকে আমি কিছুদিন আগে বেশকিছু ভারতীয় চিনির বস্তা আটক করে প্রত্যেকটি বস্তা খুলে সার্চ করেছি মাদক আছে কিনা, কিন্তু মাদক পাইনি। তবে চিনি চোরাচালানের মামলা হয়েছে। চিনির আড়ালে মাদক আসে বা এখান থেকে চিনির বস্তায় মাদক পাচার হয় বিষয়টি আমার সন্দেহের তালিকায় রয়েছে।’ ইউএনও জানান, মাদক, চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি ও পুলিশের টহল ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। তাদেরকে জবাবদিহিতার জায়গায় আনতে হবে।
ব্রাহ্মণপাড়ায় পুলিশকে ম্যানেজ করে চিনি চোরাচালান ব্যবসা চলছে, এমন প্রশ্নের জবাবে থানার ওসি দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্ডার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে বিজিবি। বর্ডার দিয়ে কিভাবে চিনি, মাদক আসে এটা বিজিবি বলতে পারবে। আর আমি এ থানায় নতুন দায়িত্ব নিয়ে যোগদান করেছি। এখনও এক মাস হয়নি।’
বিজিবি ৬০ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল জাবের বিন জব্বার বলেন, ‘সীমান্ত পথে বিজিবি সদস্যদের টহল ফাঁকি দিয়ে অনেক সময় চোরাই চিনি আসার খবর আমরা পেয়ে থাকি। আমাদের অভিযানে চোরাই পণ্য উদ্ধারও হচ্ছে।’