

ভারতে দাড়ির কারণে গত ২৩ ডিসেম্বর ভাইভা (মৌখিক) পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয় নার্সিংয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আবুবকর সিদ্দিককে। এই ঘটনার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বৈষম্য নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। পূর্ণ ইউনিফর্ম, অ্যাপ্রন এবং মাস্ক পরা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষক বারবার তাকে বলেন যে, তিনি পরীক্ষার জন্য যোগ্য নন।
দ্য অবজারভার পোস্টের সাথে আলাপকালে সিদ্দিক বলেন, ‘‘আমাকে বলা হয়েছিল যে দাড়ির কারণে আমি পরীক্ষার যোগ্য নই। আমি যখন ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে ক্ষমা চাইলাম, তখন তারা জানায় যে তারা এসব অজুহাত শুনতে চায় না। আমি তাদের বলেছিলাম, গুজরাট নার্সিং কাউন্সিল দাড়ির ব্যাপারে কোনো নিয়ম তৈরি করেনি। এমনকি গ্রুমিংয়ের জন্য থাকা ৫ নম্বর কেটে নিয়ে আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও তারা শোনেনি।’’
সিদ্দিক আরও জানান, এর আগে গুজরাট নার্সিং কাউন্সিল এই ধরনের বিধিনিষেধ বন্ধ করতে একটি নোটিশ জারি করেছে এবং শিক্ষার্থীদের অসুবিধার জন্য ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু সেই নোটিশ থাকা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ে এই বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টা দেরি এবং কলেজের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত তিনি পরীক্ষায় বসতে পারেন। সিদ্দিক জানান, গত তিন বছর ধরে তাকে একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
তিনি আরও বলেন, তার নারী সহপাঠীরাও প্রতি পরীক্ষায় হিজাব নিয়ে একই সমস্যার সম্মুখীন হন। নিরুপায় হয়ে তারা হিজাব সরিয়ে ফেলেন। তিনি ক্ষোভের সাথে জানান, এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয় বরং এটি ‘ইসলামোফোবিয়া’ বা ইসলামবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।
গত ২৪ ডিসেম্বর গুজরাটে রেলওয়ে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে একই পরিস্থিতির শিকার হন জেনিশা শাহ। গেটে নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে বোরকা ও হিজাব খুলতে বাধ্য করতে চাই। দীর্ঘ আধা ঘণ্টা যুক্তিতর্কের পর কোনো সমাধান না পেয়ে তিনি পরীক্ষা না দিয়েই ফিরে আসেন।
জেনিশা বলেন, ‘‘আমি তাদের বলেছিলাম প্রয়োজনে নারী কর্মী দিয়ে আমাকে ভালোভাবে তল্লাশি করা হোক, কিন্তু তারা অত্যন্ত অভদ্র আচরণ করে। তারা ব্যঙ্গ করে বলে যে, মুসলিমরাই শুধু তর্কে লিপ্ত হয়। আমার কাছে আমার ধর্ম ও হিজাব আমার ক্যারিয়ারের চেয়েও বড়।’’
জেনিশা সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রচারণার সমালোচনা করে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে—বেটি পড়াও ঠিক আছে, কিন্তু তাকে পরীক্ষা দিতে দিও না।’’
জেনিশার বন্ধু নিদা শেখও একই কারণে একাধিক চাকরির ইন্টারভিউ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তিনি তার কলেজ জীবনের স্মৃতি চারণ করে জানান, কীভাবে মুসলিম হওয়ার কারণে সহপাঠীদের দ্বারা ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান ও হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে তাদের।
উদুপি হিজাব আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্ট আলিয়া আসাদি এই বিষয়ে বলেন, ‘‘শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো জায়গায় যখন ধর্মীয় পরিচয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুঝতে হবে সরকার সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটি নিছক কোনো ভুল নয়, বরং এটি মুসলিমদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি গভীর ষড়যন্ত্র।’’
আরেক অ্যাক্টিভিস্ট এ.এইচ. আলমাস জানান, এই ধরনের বৈষম্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক ও আর্থিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিনি সবাইকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
বিবিধ প্রতিকূলতার মাঝেও এই শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবিচল রয়েছেন। কেউ বাধ্য হয়ে আপস করছেন, আবার কেউবা প্রতিরোধের পথ বেছে নিচ্ছেন। এত বৈষম্যের মাঝেও এই শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অটল থাকার মাধ্যমে প্রতিরোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। এটি স্পষ্ট যে, হিজাব পরা নারী বা দাড়ি রাখা পুরুষদের লক্ষ্যবস্তু বানানো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি একটি গভীর কুসংস্কার ও বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।
আপনার মতামত লিখুন :