ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অসহায় মানুষকে ঠেলে দেওয়ার অভ্যাস অনেক পুরনো। বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈও কম হয়নি। বাদ-প্রতিবাদের কমতি নেই। ঠিক কি কারণে এভাবে মানুষেকে অন্যায়ভাবে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে এর সঠিক জবাব কখনো দেয়নি পার্শ্ববর্তী দেশটি। কেন তারা এমনভাবে বেআইনী কাজগুলো করে যাচ্ছে; আর বাংলাদেশের সরকার হজম করে যাচ্ছে তাও সাধারণ মানুষের কাছে বোধগোম্য না। অবশ্য নানা সময় নানারকমের মেকানিজম করেও এর সুফল পাওয়া যায়নি, এর সুষ্ঠু সমাধানও হচ্ছে না।
গত কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের আবার ব্যাপক হারে পুশ-ইন কাণ্ড চলছে। আজ শোনা যায় সিলেট সীমানা দিয়ে, কাল শোনা যায় মৌলভী বাজার সীমান্ত এলাকা দিয়ে, আবার কোন দিন শোনা যায় লালমনিরহাট দিয়ে। আবার কোন কোনদিন শোনা যায় একইদিনে অনেকগুলো স্থান দিয়ে পুশ ইন করছে বিএসএফ। আতংকের বিষয় হলো কোন কোন সময় খবর আসে বাংলাদেশে পুশ ইন করার জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে কোন এক স্থানে এনে জড়ো করা হচ্ছে। যেকোন সময় তাদের পুশ-ইন করা হবে।
বিজিবির দেওয়া তথ্য বলছে, ভারত থেকে পুশ ইন করা ব্যক্তিদের মধ্যে ভারত, মিয়ানমার, বাংলাদেশÑএই তিন দেশের নাগরিকই আছেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা ২০-২৫ বছর আগে ভারতে গিয়েছিলেন এবং পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন। সেখানে তাঁরা ভারতের আধার কার্ড ও অন্যান্য ডকুমেন্ট পেয়েছিলেন। ভারতের পুলিশ বা বিএসএফ তাঁদের সেসব ডকুমেন্ট রেখে দিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন। আবার কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ভারতে নিবন্ধিত শরণার্থী এবং ইউএনএইচসিআর ভারতের পরিচয়পত্রধারী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের দিক থেকে যেটা পুশ-ব্যাক, বাংলাদেশের চোখে সেটাই পুশ-ইন। সীমান্তে পুশ-ব্যাক বা পুশ-ইন আসলে এমন একটা পদ্ধতি যেখানে ধরা পড়া ব্যক্তিদের সীমান্তে নিয়ে গিয়ে অন্য দেশের সীমান্তে ঠেলে দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ার কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই ভারতে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এই পদ্ধতি চলে আসছে, যেটা আনুষ্ঠানিকভাবে কেউই স্বীকার করে না। সাম্প্রতিক সময়ে সাগরপথেও পুশ ইন করার খবর পাওয়া যায়। যাদের সুন্দরবন দিয়ে চরের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে শোনা যায় নির্মম নির্যাতনের খবর।
শোনা যাচ্ছে, শুধু ভারতের গুজরাট এবং রাজস্থানেই গত তিন সপ্তাহে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে চিহ্নিত করেছে ওই রাজ্যগুলোর পুলিশ। তাদের দাবি, এই চিহ্নিতরা বেআইনিভাবে বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছিলেন। সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে যাদের পুশ-ব্যাক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিরাও ছিলেন, যাদের গুজরাট থেকে আনা হয়েছিল। পুশ ইন করার আগে তাদের ওপর এমন নির্যাতন চালানো হয় যাতে আবার ভারতে ফিরে যাওয়ার কথা কল্পনাতেও না আনে।
কয়েকদিন আগে রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর সীমান্তে যে পুশ-ব্যাকের চেষ্টা হয়েছিল, তা বিজিবি আর সীমান্ত বাসিন্দাদের তৎপরতায় বন্ধ হয়। তারা রাজ জেগে পাহারা বসায়। যাতে বিএসএফ কোনভাবেই তাদের সীমানা দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে না দিতে পারে। এতে সফলও হয়েছে সীমানাবাসী।
মোটকথা হলো — অন্যায়ভাবে বেআইনীভাবে যাদের সীমানা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের ব্যাপারে নাখোশ বাংলাদেশের সরকার এবং মানুষ। কিন্তু আমরা যাদের পুশ ইন করে পাঠালে খুশি হতাম তারা হলো কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্র লীগ, ওলামালীগ, শ্রমিক লীগসহ আরও যত লীগ আছে। তারা রাতের আঁধারে সীমানা পার হয়ে পরাজিত এবং পতিত শক্তি হিসেবে অন্যায় ও অবৈধভাবে ভারতে পাড়ি দিয়েছে। কোন ভিসা ছাড়াই সীমানা পার হয়ে ভারতে চলে গেছে। ভারত কর্তৃক আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে সেখানে চলে গেছে। যারা এই দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। ভারতকে যারা অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে। যারা তাদের দালালি করেছে। যারা অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করেছে।
এদের মধ্যে রয়েছে সব লীগ, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিচারপতি এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ঈমাম পর্যন্ত। সাদা চোখে দেখলেই বোঝা যায় তারা কেন এভাবে কাউকে না জানিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কেন তাদের নিজ দেশ, নিজ মাতৃভুমি ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হলো। তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম দেশপ্রেম থাকতো তাহলেতো অন্তত দেশে থাকার সাহসটুকু থাকতো। দেশে ফিরে আসার সাহসটুকু দেখাতে পারতো।
এই সময়ে এসে আমাদের বক্তব্য হলো যারার চরম অন্যায় করেছে দেশের মানুষের সাথে। যারা খুন গুম হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচার হওয়া দরকার। তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার। অপরাধের প্রতিকার হওয়া দরকার। তাদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি হওয়া দরকার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বলি– হে ভারতীয় সীমানার পাহারাদার, তোমাদের কাছে বাংলাদেশের মানুষের আবদার– তোমরা এক এক করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিহ্নিত করে সীমানা দিয়ে পার করে দাও। অসহায় মানুষের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুশ ইন করে দাও, তাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ সাদরে গ্রহণ করেেব। তোমাদের সাধুবাদ জানাবে। তোমাদের ধন্যবাদ দিবে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে মিষ্টি পাঠাবে। হে ভারতীয় সীমানার পাহারাদারেরা তোমরা একজন একজন করে লীগ পাঠাও এক বাক্স করে মিষ্টি নাও। বাংলাদেশের মানুষ মিষ্টির বিনিময়ে তাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হলো যাদেরকে বাংলাদেশের সীমানা দিয়ে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে তারা বংশ পরম্পরায় বহুদিন ধরে গুজরাটসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে বসবাস করে আসছে। তাদের আদারকার্ডসহ নাগরিকত্বের সব অনুসঙ্গ হয়ে গেছে। তারপরও তাদের সন্দেহের তালিকায় ফেলে জোরপূর্বক ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে বলপূর্বক ঠেলে ইচ্ছার বিরু্েদ্ধ বাংলাদেশের সীমানা দিয়ে পুশইন করা হচ্ছে। এসব বেআইনী পুশ ইনের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীরা নিন্দা জানাচ্ছে। ধিক্কার দিচ্ছে। তবু থামছে না। খোদ ভারতের মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ভারত থেকে এভাবে পুশ-ব্যাক করে দেওয়া সম্পূর্ণই আইন বহির্ভূত কাজ।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বিদেশ থেকে কেউ যদি পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া ভারতে আসেন, তাহলে পদ্ধতি হলো তাকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে। বিদেশি আইনের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী মামলা হবে। ‘মামলায় যদি সেই ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে তার সাজা হবে। সাজার শেষে আদালতের মাধ্যমেই যেই ব্যক্তি যে দেশ থেকে এসেছেন, সেখানে ফেরত পাঠানো হবে। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কিংবা মুসলমান হওয়ার অপরাধে তাদের বেআইনীভাবে পুশ করে দেওয়া হচ্ছে।
আমরা বলতে চাই ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে যারা সীমানা অতিক্রম করে রাতের আধারে চলে গেছে, তাদের নিশ্চয় কোন আদার কার্ড তৈরি হয়নি। নাগরিকত্ব দাবি করার মতো কোন ডকুমেন্ট তৈরি হয়নি। একজন দুজন তিন জন নয় হাজার হাজার আওয়ামী লীগার পাশের দেশে অবৈধ আশ্রয়ে আছে।
খবরে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি), মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সহযোগী সংগঠন ও জেলা-উপজেলার বিভিন্ন পর্যায়ের মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার নেতা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ভারতে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মেঘালয়সহ ভারতের আরও কয়েকটি রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের লক্ষাধিক নেতা আশ্রয় নিয়েছেন। ৯ মাসেরও বেশি সময় নিরাপদে বসবাস করলেও অবৈধ নাগরিকের বসবাস ঠেকাতে ভারত সরকারের অবস্থান আওয়ামী লীগের নেতাদের ভেতরে দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে। এদিকে গত ১০ মে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আশ্রয় নেওয়া অবৈধ সবাইকে ভারত ছাড়তে বলেছে। বাংলাদেশে ফেরার নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রায় ৫০ জন বড় নেতা ভারত ছেড়ে আমেরিকা-ইউরোপে চলে গেছেন। বাকিরাও চেষ্টা করছেন পশ্চিমা কোনো দেশে পাড়ি জমানোর। তবে দেশে ফেরার সাহস দেখাতে পারছেন না কোনো নেতা।
সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় অনুপ্রবেশ আইন আরও কঠোর করা হয়েছে। দেশটির সংসদ ভারতের নাগরিক নয় এমন কাউকে ভারতে থাকতে না দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে। ফলে ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নাগরিক নয়, এমন সবাইকে দেশটি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। না হলে অবৈধ নাগরিক হিসেবে আটক করে দেশে পাঠানোর ব্যাপারে তারা বদ্ধপরিকর। আওয়ামী লীগারদের ব্যাপারে এরকম সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে ভারতকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু কাজের কাজটি হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে।
আমরা বলতে চাই হে ভারতের দন্ডমুন্ডের মালিকেরা, তোমাদের কাছে আমাদের বিনয়ী আহ্বান, তোমরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া লীগারদের চিহ্নিত করো। তাদের রাত দিন যখন মন চায় বাংলাদেশে পুশ ইন করো। আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাদের গ্রহণ করার জন্য। বাংলাদেশের সাচ্চা নাগরিক হিসেবে বরণ করে নেওয়ার জন্য। আমরা বরং আন্তর্জাতিকভাবে লবিং করছি, আমাদের আওয়ামী লীগের নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ যারা বাংলাদেশের হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন করেছেন; যারা খুন-গুমের সঙ্গে জড়িত তাদের ফেরত পাওয়ার জন্য। তাদের বিচারের মুখোমুখী করার জন্য।
হে ভারতের সীমান্ত পাহারাদারেরা, তোমাদের কাছে আকুল আবেদন, তোমরা বেআইনীভাবে পুশ ইন করছো। তাদের বাদ দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমার দেশ থেকে অত্যাচার করে পালিয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও যারা আওয়ামী লীগের সাথে মিলে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। ব্যাংকগুলো লূট করে ফোকলা করে দিয়েছে। যারা বিদেশে শত শত বাড়ি কিনেছে। দেশের মানুষের সাথে গাদ্দারি করেছে। আমরা ২৪ ঘন্টা বসে আছি তাদের ফেরানোর অপেক্ষায়। তাদের ফেরত দিলে আমরা বাধা দেবো না। উল্টো তোমাদের সাধুবাদ দেওয়া হবে। মিষ্টিমুখ করানো হবে। অন্তর থেকে আশির্বাদও দেওয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :