কে নামের আগে কী লিখবে তা নিয়েও যদি ডিবি কথা বলে, তাহলে তো খুব মুশকিল। তাহলে তো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের নাম থেকে খুব শিগগির ‘চাষী' বাদ দিতে হবে। তিনি তো জীবনে কোনোদিন চাষাবাদ করেননি। ডিবি কি ৮০ বছর বয়সি চলচ্চিত্র পরিচালককে ধরে নিয়ে গিয়ে বলবে, ‘‘আপনি কেমন চাষী যে নামের আগে চাষী লাগিয়েছেন? আর যেন আপনার নামের আগে চাষী না দেখি!''
বলা তো একেবারেই উচিত হবে না।
কিংবা পল্লিকবি জসিমউদ্দীনের নামও কি বদলাতে পারবে ডিবি? বলতে পারবে, ‘‘একটা মানুষ কবিতা, গদ্য, গান লিখেছেন, ঠিক আছে, তাই বলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা একজন নামের আগে ‘পল্লি' ব্যবহার করবেন?'' পল্লিকবি কেটে ডিবি কি পারবে আজ থেকে শিক্ষককবি জসিমউদ্দীন সর্বস্তরে চালু করতে?
তা-ও তো ভীষণ অনুচিত হবে!
অথবা যে মানুষটির ডাকনাম ছিল কালু, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করে চট্টগ্রামের এক স্কুলে যে তিনি শিক্ষকতাও করেছিলেন তা খুব বেশি মানুষ জানে না বলে ডিবি কি পারবে বলতে, ‘‘দুদিন শিক্ষকতা করলেই কাউকে ইতিহাসের পাতায়ও চিরকাল ‘মাস্টারদা' লিখে যেতে হবে- এমন কোনো কথা আছে নাকি?'' আর ডিবি বললেও কাল থেকে কি সবাই মাস্টারদা সূর্যসেনকে সূর্য সেন, ওরফে কালু নামেই শুধু চিনতে শুরু করবে?
এমন তো কখনো সম্ভব নয়, তাই না?
সেভাবেই হিরো আলমকে ‘হিরো' বাদ দিতে বললেও ‘হিরো' শব্দটি চিরকালের জন্য মুছে দেয়া মনে হয় সম্ভব হবে না।
হ্যাঁ, চাষী নজরুল ইসলামের মতো জনাব আলমও নিজে নিজেই নামের আগে পছন্দের একটি শব্দ যোগ করেছেন। এবং হিরো আলম নামটি এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। তাতে যারা জানেন, তাদের কাছে চাষী নজরুল ইসলাম যেমন ‘সত্যিকারের চাষী' হয়ে যাননি, হিরো আলমও সেভাবে সবার কাছে কোনোদিনই অভিনয় জগতের সেরা ‘হিরো' হয়ে যাবেন না।
নজরুল ইসলাম যেমন নামের আগে ‘চাষী' যোগ করলেও প্রকৃতপক্ষে এবং প্রধানত চলচ্চিত্র পরিচালক, তেমনি আরশাফুল হোসেন আলমও মূলত একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটার। তার কন্টেন্ট যাদের পছন্দ নয়, তারা দেখবেন না। যারা দেখবেন, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়ত মজা পাওয়ার জন্য দেখবেন। কারো কাছে তার অভিনয়, গান সব কিছুই মনে হবে ‘কমেডি'। আবার কেউ কেউ হয়ত ‘ভুল সুর', ‘ভুল কথা', ‘ভুল উচ্চারণের' রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীতই খুব পছন্দ করবেন। তাতেও দোষের কিছু নেই।
আজ এই মুহূর্তে যদি ঢাকার কোনো এক জায়গায় রাস্তার পাশে কোনো ‘সুবিধাবঞ্চিত' মানুষকে শেক্সপিয়ার পড়তে দেখা যায়- তার হাত থেকে বই কেড়ে নেয়া কি ঠিক হবে? তার ইংরেজি ভুল বলে বলতে হবে, ‘‘এই বই যেন কোনোদিন আর তোর হাতে না দেখি!'' বললে তো শেক্সপিয়ারেরও অমর্যাদা। তার সৃষ্টির স্বাদ কোনো খেটে খাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া মানুষও নিতে চাইছেন- এ তো যে কোনো শিল্পস্রষ্টার জন্যই মহানন্দের!
ডিবির নির্দেশ এবং আচরণ সম্পর্কে গণমাধ্যমকে হিরো আলম বলেছেন, "আমার সম্মানবোধ বলতে কিছু আছে। কিন্তু তারা সেই সম্মানবোধ দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি। নাগরিক হিসেবে আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করার কথা ছিল তা করেনি। বাংলাদেশের কোনো আইনে নেই যে আমার নাম পরিবর্তন করতে হবে, এমন আইন নেই যে আমি নির্দিষ্ট কোনো গান গাইতে পারবো না, অভিনয় করতে পারবো না।"
হিরো আলমের দাবি সত্যি হলে তার সঙ্গে খুবই অন্যায় হয়েছে।এমন আচরণ দিয়ে পুলিশ বা ডিবি পুলিশ কোনোদিন সত্যিকার অর্থে ‘জনগণের বন্ধু' হতে পারবে না। জনগণের বন্ধু হতে হলে মানুষের মন বুঝতে হবে, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে জানতে হবে। ভালো শিল্পীর যেমন কণ্ঠে সুর থাকতে হয়, ‘শুদ্ধ সুর ও কথায়' গাইতে হয়, ‘ভালো' পুলিশেরও তেমনি সবার আগে থাকতে হয় মনুষত্ব। মনুষত্ব সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় মানবিক আচরণে।
গান গাইতে বারণ করা, নাম বদলাতে বলা, চেহারা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করা, দুর্ব্যবহার করা-এসব আইনসঙ্গত নয়, কাঙ্খিতও নয়। এমন আচরণের জন্য ডিবির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত আবার হিরো আলমের কাছে যাওয়া, তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করা। হিরো আলমেরও উচিত যে কোনো কাজ ভালোভাবে করার চেষ্টা করা। লেখাপড়া শিখতে চাইলে যেমন শেখা যায়, সংগীত আর অভিনয়ও তেমনি শেখা যায়, শিখে উন্নতিও করা যায়। শিখে উন্নতি করা না গেলে বিশ্ব কোনোদিনই ‘আধুনিক' হতো না, মানুষ আদিম যুগেই থেকে যেতো।
এই প্রতিবেদনটি জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চে ভেলের বাংলা ভার্সন থেকে নেওয়া। এই প্রতিবেদনের সম্পূর্ণ দায়ভার ডয়চে ভেলের।