শেখ নাজমুল ইসলাম:
ভাষা আন্দোলন বলতে বর্তমান প্রজন্ম ১৯৫২ সালের আন্দোলন কেই বোঝে ৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রয়ারী "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই " স্লোগান দেওয়া ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ ৷ গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, সফিউর সহ আরো অনেকে ৷ প্রতি বছর ২১ শে ফেব্রয়ারী সেই সকল ভাষা শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্বা নিবেদন ও তাদের রুহের মাগফেরাৎ কামনার মধ্য দিয়ে পালিত হয় দিনটি ৷
ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে মুলত: ১৯৪৮সালে ৷ ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ফলে ভারত ও পাকিস্থান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয় ৷ আমাদের এই বাংলাদেশ তখন ছিলো পূর্ব পাকিস্থান ৷ এই অন্চলের মানুষ পাকিস্থান সৃস্টির যে স্বপ্ন দেখেছিলো তা বছর যেতে না যেতেই বালুর বাধের মতো ভেঙ্গে চুরমার হতে শুরু করে সেই স্বপ্ন ৷ প্রথম আঘাত হানে বাঙ্গালীর ভাষা ও সংস্কৃতিতে ৷
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রয়ারী গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দনাথ দত্ত রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যাবহারের প্রস্তাব উত্থাপন করেন ৷ খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবটির বিরোধীতা করে ৷ খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরোধীতার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে ৷ ক্লাস বর্জনের ঢেউ এসে পড়ে যশোরে ৷
২৮ ফেব্রয়ারী ঢাকার মতো যশোরে ও ( এম এম কলেজ পুরাতন হোস্টেল) এল ভি মিত্র হলে সভা করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় ৷ ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ এম এম কলেজের লেকচার হলে সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ৷ গুরুত্ব পুর্ণ সেই সভায় বক্তব্য রাখেন সুধীর রায় ,হামিদা রহমান,রন্জিত মিত্র , আলমগীর সিদ্দিক ও সৈয়দ আফজাল মিত্র ৷
তারপর ঢাকার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিন্ধান্ত অনুসারে ঢাকার মতো করে যশোরে ও ১১ই মার্চ ধর্মঘট ও মিছিলের সিন্ধান্ত নেওয়া হয় ৷ সেই ধর্মঘট সফল করার উদ্দেশ্যে ৭ই মার্চ আবার সভা ও ৮ই মার্চ সভা ও মিছিল করা হয় ৷
১০ই মার্চ যশোরের জেলা প্রশাসক নোমানী যশোর শহরে ১৪৪ ধারা জারী করে ৷ ছাত্ররা তখন জরুরী বৈঠক করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিন্ধান্ত নেয় ৷ ১১ই মার্চ শহরে মিছিল ও ধর্মঘট হয় ৷ মিছিলে ছাত্র জনতার স্লোগান ছিলো " রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই"৷ এর আগে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে আইনজীবি মশিউর রহমান ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে থাকলে ও সেদিন তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখেন ৷ সেদিন আন্দোলন থেকে ৫০ জন নেতাকে আটোক করে পুলিশ ৷
১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের দুই পর্বের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে প্রায় সব জেলাতেই শেষ পর্বের অর্থ্যাৎ ১৯৫২ সালের আন্দোলনে আলোড়ন সৃস্টি করেছিলো ৷ কিন্ত যশোর জেলা বেশী আলোড়ন সৃস্টি করেছিলো প্রথম পর্বে ৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই মার্চ ছিলো যশোরের ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বিক্ষোভময় দিন ৷ সেদিন সরকারি কর্মচারী ও ছাত্র জনতা মিলে প্রায় তিন হাজার লোক অংশ নিয়েছিলো মিছিলে ৷
১৯৪৮ সালের তুলনায় কিছুটা কম হলে ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ও যশোর গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে ৷ ২১শে ফেব্রয়ারী ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে বিক্ষোভ করে যশোরের ছাত্র সমাজ৷ তারপর ২১শে ফেব্রয়ারী হইতে ২৮ শে ফেব্রয়ারী পর্যান্ত যশোরে ধর্মঘাট ,হরতাল, শোকসভা , সমাবেশ সহ বেশ কিছু কর্ম সুচী পালন করে ৷
৭মে ১৯৫৪ সালে পাকিস্থানের গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা'কে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ৷ এবং রাষ্ট্রভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয় তার দুই বছর পর ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রয়ারী ৷ ভাষা আন্দোলনে এতো অবদান রাখার পর ও যশোরের ভাষা সৈনিক দের কথা কোথা ও তেমন ভাবে আলোচনায় আসে না ৷ দুই এক জনের নামে স্মৃতি স্মারক থাকলে ও তাদের সস্পর্কে কিছুই জানে না নতুন প্রজন্ম ৷
১৯৪৮ সালে যশোরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছিলো আলমগীর সিদ্দিক ও রন্জিত মিত্র ৷আলমগীর সিদ্দিকির নামে যশোর ইনিষ্ট্রিটিউট প্রঙ্গনে একটি হলের নাম করন করা হলে ও রন্জিত মিত্রের কথা ভূলে গেছে সবাই ৷
সাহসী কন্যা হামিদা রহমানের নামে যশোর এম এম কলেজে একটি হল রয়েছে ৷ কিন্ত দু:খের বিষয় নতুন প্রজন্মের কেউ তার বিষয়ে কিছু জানে না ৷
অপার এক ভাষা সৈনিক বেজপাড়ার আমির আহম্মেদেরনামে এলাকাবাসী দরবেশ বাড়ীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটির নাম ভাষা সৈনিক আমির আহম্মেদ বাই লেন দিলে ও পৌরসভা থেকে আজো স্বীকৃতি মেলেনী ৷ ভাষা সৈনিক শেখ আমান উল্লার নামে রয়েছে সাতক্ষীরা কলারোয়ায় শেখ আমান উল্লাহ কলেজ ৷ অপার দিকে ভাষা সৈনিক হিসাবে সুধীর কুমার রায় ও বিমল রায় চৌধুরীর পরিচিতি থাকলে ও আজো মেলেনী কোন স্বীকৃতি ৷
এছাড়া রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মনোনীত সদস্য দেবীপদ চট্রপধ্যায়, সৈয়দ আফজাল হোসেন , অশোক ঘোষ,সুনীল রায় , হায়বাতউল্লাহ জোয়াদ্দার ,আব্দুর রাকিব , আব্দূল হক শুধু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছেন ৷ যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃ ভাষাতে কথা বলার অধিকার পেয়েছি তাদের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে পৌছে দিতে সরকারী উদ্দোগ প্রয়জন ৷