সব নবী-রাসূলই মানুষ ছিলেন। সবাই মায়ের উদর থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন। (আদম আ: ব্যতীত) নবীজী সা:-ও মানুষ ছিলেন। তবে আমাদের মতো সাধারণ নয়, অসাধারণ মানুষ। নবীরা মাসুম বা নিষ্পাপ। রাসূল মুহাম্মদ সা: হচ্ছেন সৃষ্টি এবং আল্লাহ হচ্ছেন স্রষ্টা। আল্লাহ তাঁকে যেই পজিশন বা মর্যাদা দিয়েছেন এর চেয়ে বেশিও করা যাবে না, কমও না। সীমা অতিক্রম কখনো যাবে না। রাসূল সা: সম্পর্কে সঠিক মর্যাদা বা ধারণা জানতে হলে কুরআন-হাদিসের কাছে যেতে হবে।
আল্লাহ পাক নবী-রাসূল কেন পাঠিয়েছেন? তাঁদের কেন অনুসরণ করতে হবে? তাঁদের দাওয়াত কী ছিল? দাওয়াত পেশ করার পর সমকালীন অবিশ্বাসীরা কী ধরনের আচরণ করেছিল? তাদের কেন বিশ্বাস করতে হবে?
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। জগতে যত সৃষ্টি রয়েছে তন্মধ্যে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। বনি আদমকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন বলে কুরআনে ঘোষিত হয়েছে। মানুষ সৃষ্টিগতভাবে মাটির তৈরি, ফেরেশতারা নূরের তৈরি এবং জিন আগুনের তৈরি। মাটির তৈরি মানুষই নূরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তা নূরের তৈরি ফেরেশতাদের সিজদার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। আর ফেরেশতার মর্যাদা মানুষের চেয়ে কখনো বেশি নয়। ফেরেশতাদের স্বাধীনভাবে করার কিছু নেই, তারা সব কিছুতে আল্লাহর আদেশ মেনে চলেন।
সুতরাং নবীকে আল্লাহ মানুষ হিসেবে পাঠিয়ে আমাদের প্রতি কত বড় এহসান করেছেন- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তারা (কাফেররা) বলে, এ কেমন রাসূল যিনি আহার করেন, হাটে বাজারে চলাফেরা করেন, তাঁর নিকট কেন ফেরেশতা নাজিল হয় না, যে তাঁর সাথে থেকে সতর্ক করবে অর্থাৎ নবী হিসেবে সত্যায়ন করবে?’ (সূরা ফুরকান-৭)
দেখুন, তখনকার কাফেররা মনে করত কোনো ফেরেশতাই তাদের নবী হবে। যিনি আহার করেন, বাজারে যান, বিয়ে-শাদি করেন তিনি কেমন করে নবী হবেন? কাফেরদের জবাবে অন্য আয়াতে বলা হয়েছে-‘বলুন, যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা বসবাস করত তাহলে আমি ফেরেশতাদেরকে রাসূল বানিয়ে পাঠাতাম।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৯৫)
এর চেয়ে সহজ কথা আর কি হতে পারে? যেহেতু পৃথিবীতে মানুষই বসবাস করে তাই মানুষের মধ্য থেকেই নবী বানিয়েছেন আল্লাহ। মানুষের সমস্যা সমাধান করতে তো মানুষই লাগবে, ফেরেশতারা কী বুঝবে মানুষের সমস্যা সম্পর্কে?
অন্য আয়াতে আরো বলা হয়েছে- ‘আপনার আগে আমি মানুষদেরই রাসূল করেছিলাম, যাদের উপর ওহি আসত। যদি তোমরা না জানো তবে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও।’ (সূরা আম্বিয়া-৮) আল্লাহ তাঁর নবীকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য বলেছেন- ‘বলুন, আমি তোমাদের মতোই মানুষ এবং আমার প্রতি ওহি নাজিল হয় এ মর্মে যে, তোমাদের ইলাহ বা মাবুদ একমাত্র মাবুদ।’ (সূরা কাহফ-১১০ এবং হা-মিম-সিজদা-৬)
এটি কেবল আমাদের নবীই নন; বরং সব নবীই নিজ নিজ জাতির উদ্দেশে এ কথা বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের মতো মানুষ মাত্র।’ (ইবরাহিম-১১) রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমি তো একজন মানুষ। আমিও তোমাদের মতো ভুলে যাই। সুতরাং আমি (সালাতে কিছু) ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিও।’ (বুখারি-৪০১, মুসলিম-৫৭২) তিনি আরো বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। আমি তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কোনো কিছু আদেশ করলে তা গ্রহণ করবে। আর নিজস্ব রায় থেকে কিছু বললে আমি একজন মানুষ মাত্র।’ অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে আমারও ভুল হতে পারে। (মুসলিম-২৩৬৫, মিশকাত-১৪৭) বস্তুত ফেরেশতারা হলো নূরের তৈরি, জিনেরা আগুনের তৈরি এবং মানুষ হলো মাটির তৈরি। (মুসলিম-২৯৯৬, মুমিনুন-১২, আনআম-২)
আমাদের মনে রাখতে হবে, এ পৃথিবীর সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষই আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। আর নবী-রাসূলরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ মানুষ, আদর্শ মানুষ। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বা রাসূল হলেন মোহাম্মদ সা:। সব মানুষ এসেছে মাটির তৈরি প্রথম নবী ও মানুষ হজরত আদম আ: থেকে। মানুষের গঠন উপাদান শুধু মাটি নয় আরো অনেক পদার্থ আছে। তার পরও সাধারণভাবে মানুষ মাটির তৈরি, ফেরেশতারা নূরের তৈরি এবং জিন হলো আগুনের তৈরি। মানুষ তৈরি মানুষই আল্লাহ কাছে মর্যাদার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ।
রাসূল সা: কেমন মানুষ ছিলেন? আগের আলোচনায় বুঝা গেল, সব নবীই মানুষ। এটি স্বীকার করতেই হবে যে, সব মানুষই আদমের সন্তান আর আদম হলো মাটির তৈরি। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেছেন, ‘কুল্লুকুম মিন আদম ওয়া আদম মিন তোরাব।’ ‘তোমরা সবাই আদম থেকে উদগত আর আদম হলো মাটির তৈরি।’ এ তো গেল সব মানুষের গঠনতত্ত্ব। প্রতিটি মানুষের গঠনতত্ত্ব বা প্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহর বর্ণনা নিম্নরূপ- ‘ইন্নি খালেকুল ইনসান মিন ত্বিন।’
‘হে নবী! বলে দিন) নিশ্চিতভাবে আমি (আল্লাহ) মানুষকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা ছোয়াদ-৭১)
আলেমদের একটি অংশবিশেষ বলছেন, রাসূলুল্লাহ সা: হচ্ছেন নূরের তৈরি। অন্যপক্ষ বলছেন, তিনি হচ্ছেন মাটির তৈরি। উভয়পক্ষ কুরআন-হাদিস থেকে নিজ নিজ সমর্থনে দলিল পেশ করছে। সূরা আল মায়েদার ১৫ নং আয়াতে মুহাম্মদ সা: যে নূরের তৈরি সে কথা বলা হয়েছে বলে সরলপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, এ আয়াতটি হচ্ছে ‘ক্বাদ যা আকুম মিনাল্লাহি নুরুন ও কিতাবুন মুবিন।’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে অবশ্যই তোমাদের কাছে নূর এবং স্পষ্ট বিধান গ্রন্থ এসেছে।’
এখানে আল্লাহর রাসূলকে নূর বলা হয়েছে এবং স্পষ্ট বিধান হলো কুরআন। সূরা আহজাবের ৪৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে নবী! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে, উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’ (‘দায়্যিয়ান’ ওয়া ‘সেরাজাম’ মুনিরা)
নূর এবং সিরাজাম মুনিরের একটু ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। নূর অর্থ- আলো বা জ্যোতি। মুনির অর্থ- উজ্জ্বল, সিরাজ অর্থ বাতি বা প্রদীপ। সিরাজাম মুনিরা অর্থ আলোর বাতি। এ দু’টি আয়াতের সাদামাটা অর্থ হলো- তোমাদের কাছে আলো এসে গেছে। আর এসে গেছে উজ্জ্বল বাতি। আলোর কাজ হলো অন্ধকার দূর করা।
পবিত্র কুরআনে চাঁদের আলোকে বলা হয়েছে নূর, আর সূর্যের আলোকে বলা হয়েছে ‘দিয়া’। (সূরা ইউনুস-৫)
অন্ধকার ঘুচানোই আলোর কাজ। জাহেলিয়াতের অন্ধত্বই প্রকৃত অন্ধকার। এটি স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, জাহেলিয়াত দূরীকরণের একমাত্র মেডিসিন দ্বীন ইসলাম। অতএব, সূরা আল মায়েদায় বর্ণিত নূর যে সাধারণ অর্থে নয় এবং তা মুহাম্মদ সা: নন; বরং তা ইসলাম, এটিই যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবও বটে।
সূরা আল আহজাবে বর্ণিত সিরাজাম মুনিরা (উজ্জ্বল বাতি) দ্বারা মুহাম্মাদ সা:-এর গুণাবলি বা দায়িত্ব বুঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে, নবী মুহাম্মদ সা: হচ্ছেন সাক্ষী, সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি দাওয়াতদানকারী এবং আল্লাহর অবাধ্যতাজনিত পাপাচারের অন্ধকার বিদূরিতকারী উজ্জ্বল বাতিস্বরূপ। এ আয়াতদ্বয়ের কোথাও কাউকে নূরের তৈরি বলা হয়নি।
ইসলামকেও কুরআনে বিভিন্ন স্থানে নূর বলা হয়েছে। সূরা ছফের ৮ ও ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি ইসলামের দিকে আহূত হয়েও আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে; তার চেয়ে অধিক জালেম আর কে? আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ প্রদর্শন করেন না। তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ এই আয়াতে ইসলামকে নূর বা আলো বলা হয়েছে।
আবার নূর দ্বারা সমস্ত আসমানি কিতাব এবং ইসলামকেও বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চিতভাবে আমি নাজিল করেছি তাওরাত, তাতে আছে হেদায়েত এবং নূর।’ (সূরা আল মায়েদা-৪৪, সূরা আন নিসা-৯১)
অতএব, ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি এবং তাঁর রাসূলের প্রতি এবং নূরের (কুরআন) প্রতি যা আল্লাহ নাজিল করেছেন (আত তাগাবুন, ৪ : ৮) নূর অর্থ আল্লাহপ্রদত্ত বিধান ও বিধান গ্রন্থ। যেমন আল্লাহ বলেন- ‘এটি হচ্ছে একটি কিতাব একে আমি নাজিল করেছি, যাতে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে (মিনাজ জুলুমাতে ইলান নূর) আনা যায়।’ (ইবরাহিম, ১৪ : ১, আল ছফ, ৬১ : ৮)
নূর মূলত আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তিনি নিজেই নূর। যেমন আলোর ওপর আলো যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে তার আলোর প্রতি পরিচালিত করেন। (আল নূর, ২৪ : ৩৫) (নূরুন আলা নূর-ইয়াহদি ইলা নূরিহি মান ইশায়া)।
রাসূল সা: কিসের তৈরি এই প্রশ্ন অবান্তর? তাঁকে মানতে হবে আদর্শ মানব হিসেবে এবং তাঁর প্রদর্শিত বিধানকে। মহানবী সা:-এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। বিশেষ করে তাঁর স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, হুকুম-আহকাম। এগুলো অনুসরণ করলে শুধু সঠিক পথের সন্ধান পাওয়া যাবে তা নয়; বরং আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদানে ধন্য হওয়া যাবে।
মহান আল্লাহ বলেন- ‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সূরা-আহজাব-২১) প্রকৃতপক্ষে তিনিই মানুষকে সঠিক ও সরল পথের সন্ধান দিয়েছেন। তার সার্টিফিকেট স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন- ‘আপনি তো অবশ্যই সরলপথ প্রদর্শন করেন।’(সূরা আশ শূরা-৫২) আবার আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে রাসূল সা:-এর ইত্তেবা বা অনুসরণ করতে হবে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে রাসূল সা:! আপনি তাদের বলে দিন তোমরা যদি প্রকৃতই আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমার অনুসরণ করো, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সূরা আলে ইমরান-৩১)