মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর আগে মহাবিশ্বের এক বিরল রঙিন ছবি প্রকাশ করে গোটা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা এমন ছবি এই প্রথম প্রকাশ করা হলো। ছবি তুলতে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই দলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানলপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো লামীয়া মওলাও রয়েছেন। সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল, ফোর্বস সাময়িকী।
১১ জুলাই ছবিটি প্রকাশ করা হয়। এতে যেসব তারকা ও গ্যালাক্সির ছবি ধরা পড়েছে তা ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর আগের। ছবিটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা। এ বিষয়ে নাসার কর্মকর্তা বিল নেলসন বলেন, ‘ছবিটিতে বিভিন্ন গ্যালাক্সির চারপাশে বাঁকানো গ্যালাক্সির আলো ফুটে উঠেছে। টেলিস্কোপে পৌঁছানোর আগে কয়েক কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করেছে এ আলো।’
নেলসন আরও বলেন, ‘আমরা ছবিটি দেখছি মানে ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছরের বেশি পেছনের দিকে তাকাচ্ছি।’ তিনি জানান, নাসা শিগগিরই আরও ছবি প্রকাশ করবে। সেগুলো প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগেকার। এসব ছবি মহাবিশ্বের আনুমানিক শুরু বিন্দুর কাছাকাছি। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় শুরুতে ফিরে যাচ্ছি।’
প্রকাশ করা ছবিতে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর একটি অংশকে দেখা গেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘এসএমএসিএস ০৭২৩’। ছবিতে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ ফুটে উঠেছে। মহাবিশ্বের প্রাচীনতম রূপ এটি। খবরে বলা হয়, এ ছবি নিয়ে হইচই পড়ে গেছে সারা বিশ্বে। ছবি উন্মোচন করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘নাসা অভূতপূর্ব কাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা মানবসভ্যতার জন্য এটি ঐতিহাসিক দিন।’
খবরে বলা হয় : নাসার নতুন এ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আগের হাবল টেলিস্কোপ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। এটি তৈরিতে খরচ হয়েছে ১ হাজার কোটি ডলার। গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি মহাশূন্যের উদ্দেশে রওনা দেয়। পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়িয়ে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে এ টেলিস্কোপ।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ৬.৫ মিটার চওড়া সোনার প্রলেপ লাগানো প্রতিফলক আয়না আছে এবং আছে অতিসংবেদনশীল ইনফ্রারেড তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে যন্ত্রপাতি। এ টেলিস্কোপ ছায়াপথের বেঁকে যাওয়া ওই আকৃতির ছবি ধরতে সক্ষম হয়েছে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর এ ছায়াপথগুলো স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৬০ কোটি বছর পর্যন্ত।
এ টেলিস্কোপের মূল লক্ষ্য দুটি। এক. প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্বে জ্বলে ওঠা আদি নক্ষত্রগুলোর ছবি তোলা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, দূরদূরান্তের গ্রহগুলো প্রাণ ধারণের উপযোগী কি না তা খতিয়ে দেখা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘তিন যুগ ধরে নির্মিত জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি নতুন নতুন ছবিটি দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে পারে।’
মজার বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞানীদের হিসাবে পৃথিবীর বয়স আনুমানিক ৪৫৪ কোটি বছর (কমবেশি ৫ কোটি বছর)। এখন পর্যন্ত কোনো স্পেস টেলিস্কোপের তোলা মহাশূন্যের সবচেয়ে গহিন ও সবচেয়ে ভালো মানের ইনফ্রারেড ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে একে, কয়েক হাজার ছায়াপথ উঠে এসেছে ছবিটিতে।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, পৃথিবীতে মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউ যদি এক হাত দূরের একটি ধূলিকণার দিকে তাকান, পৃথিবীর আকাশে ঠিক ওই ধূলিকণার মতোই ক্ষুদ্র জায়গা দখল করে রেখেছে ছবিতে দেখানো ছায়াপথ গুচ্ছ। ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপের ‘নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা (এনআইআরক্যাম)’।
এখন বড় সুখবর হলো, বিজ্ঞানীরা ওয়েব টেলিস্কোপের তথ্যের গুণগত মান বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারছেন, এ ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে এ টেলিস্কোপ তার থেকেও অনেক গভীরে গিয়ে মহাজগতের চিত্র তুলে আনতে সক্ষম। এর ফলে অতিশক্তিশালী এ দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মহাশূন্যের অনেক ভিতর পর্যন্ত এখন দেখা এবং তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। আলোর গতি প্রতি সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল।
আর এ ছবিতে ছোট ছোট যে আলোর বিচ্ছুরণ রয়েছে সেগুলো ভ্রমণ করেছে ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর। নাসার গবেষক বিল নেলসন বলেন, ‘তবে আমরা আরও পেছনে ফিরে যাচ্ছি। কারণ এটা হলো প্রথম ছবি। ওরা ১ হাজার ৩৫০ কোটি বছর পেছনের ছবি তুলতে যাচ্ছে। আমরা যেহেতু জানি মহাজগতের বয়স ১ হাজার ৩৮০ কোটি বছর, তাই আমরা এখন মহাবিশ্ব সৃষ্টির একেবারে গোড়ায় ফিরে যেতে পারছি।
হাবল টেলিস্কোপকে এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে আকাশে পর্যবেক্ষণ করতে হতো। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মাত্র সাড়ে ১২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্বের গভীর থেকে এ ছবি তুলে এনেছে।’
লামীয়া বললেন, গুরুত্ব হারায়নি হাবল : জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ প্রকল্পে কাজ করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী লামীয়া মওলা বলেছেন, ‘জেমস ওয়েবের যুগে হাবল এখনো গুরুত্বপূর্ণ’। বিশাল আকারের গ্যালাক্সিগুলোর বিবর্তন আর কাঠামো পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালানো লামীয়া বলেছেন, বিষয়টি এত সরল নয়।
কারণ প্রথমত, কারিগরি গঠন বিবেচনায় নিলে টেলিস্কোপ দুটি একেবারেই ভিন্ন, পার্থক্য আছে অবস্থানেও। হাবলের আয়না আকারে ২.৪ মিটার; এর বিপরীতে ওয়েব টেলিস্কোপের আয়নার আকার ৬.৬ মিটার। অর্থাৎ হাবলের চেয়ে ওয়েবের আলোকরশ্মি গ্রহণ করার সক্ষমতা বেশি। কিন্তু দুটি টেলিস্কোপের মধ্যে তুলনা বিচার ঠিক যৌক্তিক নয়।
গত মাসে ‘দি অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নাল’-এ প্রকাশ হয় থ্রিডি-ড্যাশ নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন। এর সহরচয়িতাও ছিলেন লামীয়া। মহাকাশের যে অংশগুলোয় নতুন নক্ষত্রের গঠন হচ্ছে, ‘থ্রিডি-ড্যাশ’কে তার ম্যাপ বলে আখ্যা দিচ্ছেন লামীয়া মওলা। এর মাধ্যমে মহাকাশের বিরল বস্তুগুলোর খোঁজ করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা, এরপর ওয়েব টেলিস্কোপের মাধ্যমে আরও খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণও সম্ভব হবে।
লামীয়া মওলা বলেন, ‘হাবল পৃথিবী ঘিরে চক্কর দিলেও ওয়েব ঘুরবে সূর্য ঘিরে। ওয়েবের চেয়েও বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতে পারে হাবল। সক্ষমতার বিচারে ওয়েব বেশি শক্তিশালী, তাই বিজ্ঞানীদের কাছেও এ মুহূর্তে এর চাহিদা বেশি। ওয়েবের উপস্থিতিতে হাবলের সময় নিয়ে মহাকাশবিজ্ঞানীদের মধ্যে চাহিদা একটু কমলেও পুরনো টেপলিস্কোপটি “অপ্রাসঙ্গিক” হয়ে গেছে ভাবলে ভুল হবে।’
গবেষণা প্রকল্প ‘থ্রিডি-ড্যাশ’-এর অংশ হিসেবে ইনফ্রারেডের কাছাকাছি তরঙ্গে মহাকাশের ছায়াপথগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হাবল টেলিস্কোপের লেগেছে আড়াই শ ঘণ্টা। লামীয়া বলেন, থ্রিডি-ড্যাশ প্রোগ্রাম হাবলের মহাকাশের বড় একটা অংশে ছবি তোলার সক্ষমতার ঐতিহ্যকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন আমাদের ছায়াপথের বাইরে ছায়াপথগুলোর রহস্য উদ্ঘাটন শুরু করতে পারি আমরা।
পাশাপাশি দুটি ছবিতে এ নীহারিকাটির নাম ‘সাউদার্ন রিং নেবুলা’। নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের তোলা বাঁ পাশের ছবিতে ‘নিয়ার ইনফ্রারেড লাইট’ ও ডান পাশের ছবিতে ব্যবহার হয়েছে ‘মিড ইনফ্রারেড লাইট’। ছবিটি ওয়েবের জন্য গুপ্তধনের অগভীর ম্যাপ হিসেবে কাজ করবে যার মাধ্যমে টেলিস্কোপটি ফেরত যেতে পারবে এমন নতুন লক্ষ্য খুঁজে নিয়ে তার গভীরে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে।
লামীয়া মওলা বলেন, ‘হাবল আর ওয়েবের মূল পার্থক্য দৃষ্টিভঙ্গিতে। হাবল অতিবেগুনী রশ্মি এবং মানবচোখে দৃশ্যমান আলোয় মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণ করলেও দীর্ঘ ইনফ্রারেড তরঙ্গে ছবি তোলে জেডব্লিউএসটি। মূল পার্থক্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি যা হাবলকে প্রাসঙ্গিক রাখবে, তা হলো হাবল আলট্রাভায়োলেট থেকে “নিয়ার ইনফ্রারেড” আলো পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
আর ওয়েব “নিয়ার ইনফ্রারেড” থেকে ইনফ্রারেড তরঙ্গের মাঝামাঝি পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। এর মানে ওয়েব অতিবেগুনী এবং দৃশ্যমান আলো পর্যবেক্ষণ করে না। আপনি যদি অতিবেগুনী রশ্মি আর দৃশ্যমান আলোয় কিছু পর্যবেক্ষণ করতে চান তবে আমাদের তা অর্জন করতে হাবলের কাছেই ফেরত যেতে হবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাবিশ্বের যে ছবিগুলো তোলা সম্ভব হবে তার সবই নির্ভর করবে হাবল থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর। ‘হাবলের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতেই আমাদের সব লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে, আর ওয়েব এখন এতে আরও বেশি তথ্য যোগ করবে। হাবল এখানে খুবই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ লামীয়া মওলার মতে, হাবল নয়, স্পিটজারের উত্তরসূরি ওয়েব।
ওয়েব হাবলের চেয়ে বেশি হাই-রেজুলিউশনের ছবি ধারণে সক্ষম এবং ইনফ্রারেড আলোর প্রতি প্রায় ১০ গুণ বেশি স্পর্শকাতর। তাই হাবল এত দিন যা করে এসেছে সে কাজ আরও বেশি সময় ধরে আরও দ্রুত করতে পারে ওয়েব। তবে ওয়েব এ ক্ষেত্রে হাবলের উত্তরসূরি নয় বা হাবলকে প্রতিস্থাপন করবে না। বরং নাসার স্পিটজার স্পেস টেলিস্কোপের জায়গা নিচ্ছে ওয়েব টেলিস্কোপ।
২০০৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কক্ষপথে থাকলেও প্রপেল্যান্ট ফুরিয়ে গেছে স্পিটজারের। রেজুলিউশেনর বেলায় স্পিটজারের চেয়ে ওয়েবের সক্ষমতা এত বেশি যে বিষয়টি অনুধাবন করা কঠিন। আকাশের ঘোলাটে অংশ হিসেবে আমরা এত দিন যা দেখতে পেতাম সেগুলো এখন স্পষ্ট ছায়াপথ হিসেবেই দেখা যাবে।
ওয়েবের মাধ্যমে কেবল হাজার কোটি বছর আগের ছায়াপথগুলোই স্পষ্ট হয়ে উঠবে এমনটা নয়, ছায়াপথের গহিনের খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যও উঠে আসবে টেলিস্কোপের ছবিতে। লামীয়া মওলা বলেন, ‘নতুন পর্যবেক্ষণে হাবল এখনো গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েবের মাধ্যমে আমরা নতুন অনেক কিছু খুঁজে পাব যা আমরা আগে চিহ্নিত করিনি।
আমরা হাবলের মাধ্যমে সেখানে ফেরত গিয়ে আবার দেখার চেষ্টা করব, হয়তো আরও বেশি সময় নিয়ে আরও গহিনে। সব মিলিয়ে হাবল গুরুত্বপূর্ণ হয়েই থাকবে।’