মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কাছে জিম্মি বিআরটিএ, বাংলাদেশের নাগরিকের তথ্য ভারতের হাতে!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৮, ২০২৪, ৮:০২ পূর্বাহ্ণ /
মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের কাছে জিম্মি বিআরটিএ, বাংলাদেশের নাগরিকের তথ্য ভারতের হাতে!

নিজ দেশ ভারতে আধার কার্ড প্রকল্পে আজীবন নিষিদ্ধ। আফ্রিকার দেশ কেনিয়াতে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে ৯ জন পরিচালকের বিরুদ্ধে। ঘুষ-অনিয়মের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে শ্রীলংকাতেও। এমনকি টাকার বিনিময়ে নাগরিকের তথ্য বিক্রির অভিযোগও আছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে। বিতর্কিত এই কোম্পানিকেই ১২০ কোটি টাকার ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজ দিয়েছে বিআরটিএ। স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের আমলে বিতর্কিত এই কোম্পানিকে কাজ দেয়ার জন্য চারবার সংশোধন করা হয়েছে দরপত্রের শর্ত।

জানা গেছে, ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কিছুদিন কাজ বন্ধ রেখেছিল ভারতীয় এই কোম্পানি। এরপর কাজ শুরু করলেও জমে আছে কয়েক লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও স¥ার্ট কার্ড। বিআরটিএ’র পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছে না কয়েক লাখ লাইসেন্স প্রার্থী। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশে ও বিদেশে ড্রাইভিং চাকুরি প্রত্যাশীরা। মধ্যপ্রাচ্যে নিশ্চিত হওয়া চাকরি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে লাইসেন্সের স্মার্ট কার্ড না পাওয়ায়। মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এর কারণেই এই ভয়াবহ ভোগান্তি। চুক্তি অনুযায়ী বিআরটিএ-কে স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহ করতে পারছে না তারা। আবুল কালাম নামে একজন ভুক্তভোগি বলেন, তিনি গত মাসে গাড়ির স্মার্ট কার্ডের জন্য টাকা জমা দিয়েছেন বিআরটিএ-তে। তাকে স্মার্ট কার্ডের তারিখ দেয়া হয়েছে আগামী বছরের এপ্রিলে।

মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স-এমএসপি’র কাজের পরিধি বেশ ব্যাপক। অভিযোগ তার চেয়েও বেশি। ভারতের আধার কার্ড প্রকল্পে কাজ পেয়েছিল এমএসপি। কিন্তু নাগরিকের তথ্য বিক্রি করার দায়ে খোদ ভারত সরকার এই কোম্পানিকে আজীবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বের করে দেয়া হয়েছে তেলেঙ্গার সামাজিক সুরক্ষা সেবা মিসেভা প্রকল্প থেকেও। ভবিষ্যতে কোনো টেন্ডারে অংশ নিতে পারবে না কোম্পানিটি। বিতর্কিত এই কোম্পানি ভারতের বাইরেও দুর্নাম কুড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমও কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে।

কেনিয়াতে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা চলছে। ৯ পরিচালকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলছে। অথচ বিআরটিএ-এর দরপত্রের শর্ত ছিল ৫ বছরের মধ্যে দরদাতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা থাকা চলবে না। কিন্তু দরপত্র যাচাই করার যাদের দায়িত্ব ছিল তারা সেগুলো পাশ কাটাতে বাধ্য হয়েছে হাসিনা সরকারের সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে। বিআরটিএ-এর একজন কর্মকর্তা জানান, সেই সময় প্রথম দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা ছিল ফ্রান্সের সেল্প এসএএস। ভারতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি গোয়েন্দাবৃত্তি করে সেই তথ্য আগেই জেনে যায়। তারা বিআরটিএ-কে চিঠি দিয়ে ফ্রান্সের কোম্পানির ঘাটতি সম্পর্কে আগাম তথ্য জানিয়ে দেয়।

সেই সময়ে সংশ্লিষ্ট দরপত্রের সাথে জড়িত বিআরটিএ-এর একজন কর্মকর্তা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, গোপন দরপত্রের তথ্য এমএসপি জানলো কিভাবে? নিশ্চয় তাদের কাছে কোনো টেকনোলজি আছে। ওই কর্মকর্তা জানান, বিআরটিএ-তে ড্রাইভিং লাইসেন্স অথবা গাড়ির মালিকানার স্মার্ট কার্ডের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে হয়। এটা সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয় ওই কোম্পানি। তারা যে বাংলাদেশের নাগরিকের তথ্য ভারতে পাচার করছে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বরং তাদের অতীত ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, তারা বাংলাদেশের নাগরিকের সব তথ্য পাচার করেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপদজনক। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারি হাসিনা সরকারের পতনের পর ভারত যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে তাতে ভারতীয় এই বিতর্কিত কোম্পানিকে কোনোভাবেই আর রাখা উচিত নয়।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিএমইটির ইমিগ্রেশন কার্ড সরবরাহের দায়িত্ব পেয়েছিল ভারতের এই এমএসপি। কিন্তু সে যাত্রায় তারা কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। তখন বিআরটিএ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এমএসপিকে কাজ দেয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রথম দরপত্রে ৩৫ লাখ কার্ড বিতরণের কথা থাকলেও সংশোধিত দরপত্রে তা ৪০ লাখ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে এমএসপি ভারতের অন্যায় প্রভাব খাটিয়েই এ কাজ করেছিল। কারণ তখন ক্ষমতায় ভারতের দালাল হাসিনা সরকার।

বিআরটিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্সের ব্যর্থতার কারণে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে না পারায় বিআরটিএ’র সব অর্জন ম্লান হয়ে গেছে। বছরখানেক আগে আবেদন ও পরীক্ষায় পাস করেও ড্রাইভিং লাইসেন্স না পাওয়া ব্যক্তিদের ভোগান্তি চরমে। এখন পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ চালক গাড়ি চালাচ্ছেন বিআরটিএর ‘একনলেজমেন্ট স্লিপ’দিয়ে। কিন্তু স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স কার্ড না পাওয়ায় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারছেন না তারা। শুধু তাই নয় এর কারণে দুই বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষ চালক রফতনীতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অন্যান্য দেশ সে স্থান দখল করে নিচ্ছে।

জানা যায়, ২০২০ সালের ২৯ জুলাই ভারতীয় কোম্পানি মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরে ৪০ লক্ষ স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের ১২০ কোটি টাকার চুক্তি সই করে বিআরটিএ। এ চুক্তিতে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের বাংলাদেশি এজেন্ট লজিক ফোরাম। তবে চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবারই তারা সময়মতো ড্রাইভিং লাইসেন্স ও স্মার্ট কার্ড সরবরাহে বিফল হয়ে আসছে। এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য পাচার নিয়ে।