মানুষকে ভোটমুখী করতে হবে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মে ১৮, ২০২৪, ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ /
মানুষকে ভোটমুখী করতে হবে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক দিবস আছে। একেকটি দিবস একেক কারণে স্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭ মে তেমনই একটি দিন। ১৯৮১ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে প্রবাসজীবনের অবসান ঘটিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সময় তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। তখন থেকে তাঁরা নির্বাসিত জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনা যখন স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে যান, তখন তিনি আওয়ামী লীগের কোনো পদে ছিলেন না। ১৯৮১ সালে যখন দেশে ফেরেন, তখন তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। ওই বছরের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের ঐক্যের স্বার্থে দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়াটাও ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

শেখ হাসিনা ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন, কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভানেত্রীও নির্বাচিত হয়েছেন। অত্যন্ত কাছে থেকে দেখেছেন পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন। জেল-জুলুম-অত্যাচার-মামলা উপেক্ষা করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রাণপাত ধারাবাহিক সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও রাজনীতির একই পিচ্ছিল পথে হাঁটবেন, সেটা সম্ভবত বঙ্গবন্ধু চাননি। শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্যই হয়তো বঙ্গবন্ধু তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে দূরের মানুষ একজন পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। অথচ এক ট্র্যাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শেখ হাসিনাকেই পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নিতে হলো।

দেশের সবচেয়ে বড় এক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও পটভূমিতে। তিনি যখন স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যান, তখন তাঁর পিতা জীবিত, দেশের সরকারপ্রধান। কিন্তু তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন পিতা নেই, মাতা নেই, ভাই নেই, নেই আরও কত আত্মীয়স্বজন। এক গভীর শূন্যতার মধ্যেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু। তাঁর এই স্বদেশে ফেরা পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশের রাজনীতির আবহ বদলে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। আমাদের ভাই-বোনের সম্পর্ক। তিনি আমার ‘গুড সিস্টার’ আমি তাঁর ‘ব্রাদার’। আগেই বলেছি, ছাত্রজীবনে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও মূলধারার রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে প্রথমে খন্দকার মোশতাক ও পরে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন।

রাজাকারদের পুনর্বাসন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ, রাজনীতিবিদদের চরিত্রহননসহ অসংখ্য বিতর্কিত কাজ করেন জিয়া। জিয়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের চিরতরে দায়মুক্তির জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন পাস করেন। শুধু তা-ই নয়, হত্যাকারীদের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বানানোসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের রাজনীতির উল্টোযাত্রা শুরু হওয়ায় এবং দলীয় নেতৃত্বের সুবিধাবাদিতা ও অদূরদর্শিতার কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান যখন নড়বড়ে, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলটি যখন সাংগঠনিকভাবে দিশেহারা, ঠিক সেই সময় শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এখানে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার, আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা খুব সহজেই নির্বাচিত হয়েছিলেন, বিষয়টি কিন্তু তেমনও নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেকেই আওয়ামী লীগের সভাপতি হতে চেয়েছেন। আমার জানামতে, ডজনখানেক নেতা সভাপতি পদের প্রার্থী ছিলেন। তবে পরের ইতিহাস সবারই জানা, শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন সর্বসম্মতভাবে, তিন দিন সম্মেলন চলার পর।

এটা স্বীকার করতেই হবে যে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবন বকুল বিছানো পথে চলেনি, বরং অত্যন্ত বেদনাবিধুর ও বিপৎসংকুল পথেই তাঁকে এগোতে হয়েছে। রাজনীতিতে প্রবেশ করেই তিনি গৃহবন্দীর শিকার হন। রাজপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম করেন, জেল খাটেন এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে অসংখ্যবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক নেতা তাঁর মতো জীবননাশী ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হননি।

জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার। বঙ্গবন্ধুর আমলে যেমন বাংলাদেশ অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানের বিষদৃষ্টিতে ছিল, এখনো তেমনই আছে। তবে আশার কথা এই যে, শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে বিরুদ্ধবাদী সেই শক্তিমান রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সখ্য না গড়ে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরে এসেও দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহই প্রকাশ করেছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির খবর।

নিন্দুকের দৃষ্টি কখনোই ভালো কিছু দেখে না। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা যেসব দুঃসাধ্য কাজ সাধন করেছেন, তা কারও পক্ষে সম্ভব হতো কি না, জানি না। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের (যেমন: জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হিজবুত তাহরীর) মূলোৎপাটন করেছেন। এগুলোকে যারা ছোট করে দেখতে চায়, তারা প্রকারান্তরে চোখ থাকতেই অন্ধ।

বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও অগ্রগতির সঙ্গে একাকার হয়ে আছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এটা যত দিন বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে না পারবে, তত দিন বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই, কোনো পরিকল্পনাই টেকসই হবে না। আর সেখানেই অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হাত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যার ফল এখন আমরা সব ক্ষেত্রে পাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধুর নামে আজ ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখতে শেখ হাসিনাকেই ভূমিকা নিতে হবে এবং তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবেই সেই দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বসভায় সুনাম অর্জন করছে। অর্থনীতির ভিত্তি সবল হয়েছে। মানুষের জীবনমানেরও উন্নয়ন হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত ও কার্যকলাপ পরিহার করতে হবে। দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজ নেতা-কর্মীদের দল থেকে বহিষ্কার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সাংগঠনিক ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে উজ্জ্বল করতে হবে। দলের নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে। আওয়ামী লীগের কাছেই মানুষের প্রত্যাশা বেশি। কেননা, মানুষ দেখছে, তাদের আশা পূরণের পথেই শেখ হাসিনা হাঁটছেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে উচ্চতম স্থানে নিয়ে গেছেন। মানুষ বুঝতে পারছে, আসলেই দেশের উন্নতি হচ্ছে। এখন সব দিক সামাল দিয়ে ঠান্ডা মাথায় সরকার ও দল পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশের এখন বড় বাধা অনিয়ম ও দুর্নীতি। সব সেক্টরে অনিয়ম ও দুর্নীতি যতটা সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি জায়গায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে আইনের শাসন।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এখন শেখ হাসিনার চোখের দিকে তাকিয়েই স্বপ্ন দেখছে। শেখ হাসিনার স্বপ্ন আর সাধারণ মানুষের স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা নিজেকে এবং বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছেন। তিনি আওয়ামী নৌকার বইঠা হাতে নিয়েছিলেন বলেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।

তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কসহ যেসব বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা আছে, সেগুলো নিয়ে শেখ হাসিনাকে এখন ভাবতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেমন ভোটারের খরা ছিল ভোটকেন্দ্রে, উপজেলা নির্বাচনেও একই অবস্থা। একসময় ভোট ছিল আমাদের মানুষের কাছে অনেকটা উৎসবের মতো।

অথচ এখন সেই ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া নেতিবাচক মনোভাব দূর করতে না পারলে দেশে টেকসই উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করা সহজ হবে না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গারে যতটা উৎসাহী, কোনো সমস্যার গভীরে গিয়ে তার সমাধানের পথ খোঁজায় ততটাই অনীহা।

শেখ হাসিনার কাছে যেহেতু মানুষের প্রত্যাশা বেশি, সেহেতু তাঁকেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির বর্তমান সংকট সমাধানের উপায় বের করতে হবে।