শহীদ মেরাজুলের মা
গত বছর ১৯ জুলাই রংপুরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত কলা ব্যবসায়ী মেরাজুল ইসলামের লাশ তড়িঘড়ি করে দাফনে বাধ্য করেছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলে জানিয়েছেন তার জনম দুঃখিনী মা আম্বিয়া খাতুন। জানান, ছেলের মৃত্যুর পর এখন দুর্বিষহ জীবন কাটছে তার বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গত শনিবার তার শাহাদতের দিনে নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন বয়োবৃদ্ধ আম্বিয়া বেগম। তখন তার চোখে ছিল শুধুই জল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শহীদ মেরাজুলের মা আম্বিয়া বলেন, ‘ গত বছর ১৯ জুলাই শুক্রবার আমার ছেলে বাড়ি থেকে গিয়ে বিকেল ৪টার সময় গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে মেডিক্যালে নিয়ে গেছে।। খবর পেয়ে আমার মেয়ে আর আমার ভাগনী মেডিক্যালে গেছে। গুলির কথা শুনে আমি মেয়েকে বলি, আমি কি যাবো।
তখন মেয়ে বলে বাহিরে খুব গণ্ডগোল, তুমি আসতে পারবে না। খোঁজাখুঁজির পর ওরা পাঁচ তলায় আমার ছেলেকে পায়। তখন আমার ছেলের চোখের পানি পড়তে ছিল। মুখে অক্সিজেন লাগানো ছিল। আমার মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে ভাই তোমার এই অবস্থা। তখন ডাক্তার বলে ওষুধ আনো। ওষুধ আনো। আমরা দ্রুত চিকিৎসা করবো। কিছুক্ষণ পর আমার ছেলের বউ যায়। সে গিয়ে স্বামীকে দেখতে চায়। ডাক্তার বলে আপনারা ওষুধ আনেন। একটু দেখার পরে তিনজনই ওষুধ আনতে যায়। ওষুধ আনার পর ডাক্তার বলে আমার ছেলে মারা গেছে।’
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের চাপে তাড়াহুড়া করে ছেলের দাফন করা হয়েছে উল্লেখ করে আম্বিয়া খাতুন জানান, ‘ওখান থেকে লাশ আনার জন্য কাউন্সিলর লিটন পারভেজকে ফোন দেয়। তখন লিটন বলে বাহিরে গোলাগুলি হচ্ছে। তোমরা মেডিক্যাল থেকে গাড়ি নিয়ে লাশ আনো। তার পর ওরা একটা গাড়ি নিয়ে লাশ বাসায় নিয়ে আসলো। তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাদের খুব তাড়া দিচ্ছে। কোনো কিছু করতে দিতেছে না। তাদের চাপে দ্রুতগতিতে ১০টার মধ্যে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা হলো। তখন আমাদের ঈদগাহ মাঠে কবরস্থানে মাটি দেয়া হলো।’
মামলার কোনো অগ্রগতি না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘আমি মামলা করেছি। এখন মামলা যে কী হইতেছে। আমি কিছুই জানি না। শুনছি দুইজন গ্রেফতার হয়েছে। এটা কোনো কথা হলো। এক বছরে মাত্র দুইজন গ্রেফতার। আমি চাই আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে। তাদের সবাইকে দ্রুত গ্রেফতার করে ফাঁসি দেয়া হোক।’
সরকারের কাছে জীবন-জীবিকার সুযোগ দাবি করে আম্বিয়া খাতুন বলেন, ‘ সরকারের কাছে আমার চাওয়া। আগে বউ বাচ্চা। তার পরে আমি শহীদ মিরাজের মা। আমার কোনো জায়গায় নাম ওঠে নাই। আমাকে কেউ ডাকেও না। সরকারের কাছে আবেদন, আমি যতটুকু পাওয়ার যোগ্য ততটুকু যেন আমাকে দেয়।
ছেলে বেঁচে থাকলে দায়িত্ব নিতো উল্লেখ করে আম্বিয়া বলেন, ‘আমি মা। আমার ছেলেটা যদি বাঁচি থাকতো। তাহলে অবশ্যই আমাকে একটু দেখতো। খাওয়াইতো। আমার তিন ছেলে এক মেয়ে। আমি অভাব-অনটনের মধ্যে চলতেছি। আমার ছেলে মারা যাওয়ার পরে যদি আমার বউ আর আমি এক থাকতাম। তা হলে সব কিছুই হইতো। আমার বউ তো এক হয় না আমার সাথে।’
শহীদ মেরাজুল ইসলাম মেরাজ খুনের ঘটনায় মা আম্বিয়া খাতুন বাদি হয়ে গত বছর ১৮ আগস্ট ২১ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামাদের নামে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার উৎপল কুমার রায়, সহকারী কমিশনার ইমরান হোসেন, সহকারী কমিশনার আরিফুজ্জামান আরিফ, এসআই মামুন, এসআই গণেশ, এসআই মজনু, সাবেক ২০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর তৌহিদুল ইসলাম, ২৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রফিকুল আলম, ৩০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম তোতা, ২৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাৎ হোসেন, ২৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহাজাদা আরমান, ২৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হারুন অর রশিদ, আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা এমপি নাছিমা জামান ববি, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল, সাবেক সহ-সভাপতি নবীউল্লাহ পান্না, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী তুহিন, জেলা যুবলীগের সভাপতি লক্ষণ চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রনি, মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হোসেন, যুবলীগ নেতা ডিজেল আহমেদ, নেংরা মামুনসহ ২১ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলাটি আদালতের আদেশে কোতোয়ালি থানায় এজাহার হিসেবে নথিভুক্ত হয় ১৯ আগস্ট। ময়নাতদন্ত ছাড়
প্রসঙ্গত গেলো বছর ১৬ জুলাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নং গেটের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে বুক উঁচিয়ে পুলিশের গুলি বরণ করে শহীদ হন শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। আবু সাঈদ হত্যার দু’দিন পর ১৮ জুলাই রংপুরের মডার্ন মোড়ে আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হন অটোচালক মানিক মিয়া। আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ১৯ জুলাই ২০২৪। সিটি বাজারের সামনে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে বাধা দেয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। প্রাণ হারান কলা ব্যবসায়ী মেরাজুল ইসলাম, বৌরানী জুয়েলার্সের ম্যানেজার মুসলিম উদ্দিন মিলন, সবজি ব্যবসায়ী সাজ্জাদ ও শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল তাহির। গুলিবিদ্ধ হন অসংখ্য মানুষ।