ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার পানিসারা পশ্চিম পাড়ার ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী আব্দুর সাত্তার। দুই দশকের বেশি সময় ফুল চাষাবাদ ও ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। কোন রাজনীতিক দলের সাথে সম্পৃক্ততা নেই তিনি। ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপি ও যুবদলের লোকজন তার ফুলের ব্যবসা দখল করে নিয়েছে। এখন তিনি গদখালী বাজারে উঠতে পারছেন না।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গদখালী পাইকারি মোকাম থেকে ফুল কিনে আমি দেশের বিভিন্ন এলাকার দোকানে পাঠায়। বিএনপির কয়েকজন আমার বাড়িতে এসে হুমকি-ধামকি দিয়ে ওইসব দোকানের ব্যবসায়িদের ফোন নম্বর নিয়ে গেছে। এখন তারা ওইসব দোকানে ফুল পাঠাচ্ছে। আমি কোনো রাজনীতি করি না। তারপরও আমি নাকি আওয়ামী লীগ করি-এমন অভিযোগ তুলে বাজারে ব্যবসা করতে দিচ্ছে না। বিএনপি ও যুবদলের লোকজন আমার ফুলের ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের কাছে আমি ৭-৯ লাখ টাকা পাবো, ফুল দিতে না পারায় তারা টাকাও দিচ্ছে না। এতে পরিবার নিয়ে মানবেতর দিন যাপন করছি’।
শুধু আবদুস সাত্তার না, তার মত অন্তত ফুলের রাজধানী খ্যাত গদখালি পানিসারার ১০০ জন ফুল ব্যবসায়ির ব্যবসা জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদেরকে গদখালী পাইকারি ফুলের মোকাম ও পানিসারা খুচরা ফুলের বাজারে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব ব্যবসায়িদের আওয়ামী লীগে দলীয় কোনো পদপদবী নেই। অথচ আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে তাদেরকে মারধর হুমকি ধামকি দিয়ে ফুলের ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারমাস ধরে এসব ব্যবসায়িরা গদখালী বাজারে উঠতে না পারার কারণে অত্যন্ত মানবেতর দিন কাটাতে হচ্ছে ফুলের এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়িরা।
স্থানীয় ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়িরা অভিযোগ, বিএনপি নেতা আবুল খায়ের ও গদখালী ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফরের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবদলের কর্মী সাব্বির, আশিকুর, বাবু, শাওন ও মনিরসহ অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন গদখালী ও পানিসারা বাজারের ফুলের ব্যবসা দখল করে নিয়েছে। ৫ আগস্ট রাজনীতিক পটপরিবর্তনের পর গদখালি বাজারে অধিকাংশ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় বিএনপি নেতারা ব্যবসা করছেন। ফুলের দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলায় ফুল পাঠানো নিয়ন্ত্রণ করছেন তারা।
পানিসারা ফুলচাষি মনিরুজ্জামান বলেন, ‘তিন দশকের বেশি ফুল চাষ ও ব্যবসা করি। কিন্তু আমাদের ব্যবসা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। সাধারণ কৃষকেরা বাজারে ফুল নিয়ে গেলে বিএনপি নেতারা তাদের মতো করে দাম দিচ্ছে। চাষিদের ফুলের কাক্ষিত দাম পাচ্ছেন না। অনেকটা জিম্মিকরে ব্যবসা করছেন তারা।’
সড়ক দুর্ঘটনায় ফুল ব্যবসায়ি ও চাষী মিন্টু গাজীর একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। তিনি সাত বিঘা জমিতে জারবেরা, গাদা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করেন। আন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পর তিনি গদখালী বাজারে ফুল পাঠালে তার ফুল আটকে দেয় যুবদলের কর্মীরা। এরপর ১০ হাজার টাকা চাদা দিয়ে ওই ফুল ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে।’ ফুল ব্যবসায়ি শাহজাহান কবির বলেন, ‘১৮ বছর ধরে গদখালী বাজারে আমি ফুলের ব্যবসা করি। বিএনপি ও যুবদলের লোকজন জানিয়ে দিয়েছে, বাজারে উঠলে খবর আছে। ভয়ে চার মাস ধরে বাড়িতে বসে আছি। ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। ভাবছি, এখন চাষাবাদের দিকেই মন দিতে হবে’।
সরেজমিনের গিয়ে দেখা গেছে, গদখালী ফুলের মোকামে একটি ব্যানার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘নবগঠিত গদখালী ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ি কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়িদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সভাপতি আবুল খায়ের, সাধারণ সম্পাদক মো. আবু জাফর, কোষাধ্যক্ষ মিন্টু খান ও সাংগঠনিক সম্পাদক ইমামুল হোসেন’। কমিটির সভাপতি আবুল খায়ের গদখালী ইউনিয়েনের ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গদখালী ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর গদখালী ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক।
গত ৫ আগস্টের আগে এই সমিতির আহবায়ক ছিলেন, পানিসারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য ও ফুল ব্যবসায়ি শামীম রেজা এবং সদস্য সচিব ছিলেন ফুল ব্যবসায়ি খালেক সরকার। জোর করে সমিতির কার্যালয় দখলে নিয়ে কমিটির বিভিন্ন পদে নিজেদের দলীয় লোকজন বসিয়েছেন আবুল খায়ের ও আবু জাফর। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নবগঠিত গদখালী ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়ি কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও বিএনপি নেতা আবুল খায়ের বলেন, ‘এই সমিতির তেমন কার্যকারিতা ছিলো না।
তাছাড়া এতোদিন আওয়ামী লীগের লোকজনের দখলে ছিলো সমিতির নেতৃত্ব। আমরা নতুন কমিটি গঠন করেছি। এতে ফুল চাষি ও ফুল ব্যবসায়িরা খুশি’। কারো ব্যবসায় বাধা দেওয়া হচ্ছে না বলেও তিনি দাবি করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গদখালী ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর বলেন, ‘এখন বাজারের পরিবেশ ভালো। ফুল চাষিরাও খুশি। কারো ব্যবসায় বাধা দেওয়া হচ্ছে না। আপনি তদন্ত করে দেখেন’।
গদখালী ও পানিসারায় বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ ও ফুল ব্যবসা সম্প্রসারণে ৩৫ বছর ধরে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করছেন আবদুর রহিম। তিনি বাংলাদেশ ফাওয়ার সোসাইটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি যশোর ফুল উৎপাদন ও বিপনন সমবায় সমিতির সভাপতির দায়িত্বে আছেন। গদখালী বাজারে তার ব্যক্তিগত কার্যালয় রয়েছে। সেখানে তার বীজ ব্যবসার কার্যক্রম চালান তিনি। যুবদলের কর্মীরা পানিসারা গ্রামে তাকে মারপিট করে। গদখালী বাজারে উঠলে প্রাণনাশের হুমকিও ওয়া হয়। গত চার মাস ধরে তিনি গদখালী বাজারে যেতে পারছেন না। তার ব্যক্তিগত কার্যালয় চার মাস ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
আবদুর রহিম বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পানিসারা শাখার সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। আবুদর রহিম বলেন, ‘গত ৩০ বছরে আমরা ফুল চাষ ও ফুল ব্যবসা সম্প্রসারণে কোনো রাজনৈতিক দল দেখিনি। সবাই মিলেমিশে ফুল ব্যবসা ও চাষাবাদ করেছি। কিন্তু হঠাৎ কি হলো বুঝলাম না- বিএনপি ও যুবদলের কয়েকজন আমাদের ব্যবসায়িদের মারপিট করে ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে। ফুল চাষিদের বাজারে হেনস্থা করছে। আমি নিজেই জীবননাশের ঝুঁকিতে আছি। অথচ আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি না’।
এই বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী এই বিষয়ে কোন বক্তব্য দিবেন না বলে জানান। আর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘এমন কোন অভিযোগের বিষয়ে জানা নেই। তবে দলীয় নেতাকর্মীকে নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে; কেউ দলের নাম ভাঙ্গিয়ে দখলদারিত্ব করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমন অভিযোগে ইতোমধ্যে জেলায় অনেক নেতাকর্মীকে বহিস্কারও করা হয়েছে।’
আপনার মতামত লিখুন :